আগে বারকয়েক যাবার পরিকল্পনা করলেও বিভিন্ন কারণে যাওয়া হচ্ছিল না। এবার অনেকটা হুটহাট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম বিছনাকান্দি যাচ্ছি। সঙ্গী হল আরও ৭ জন ক্লাসমেট।
আবহাওয়া সত্যিকার অর্থেই ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও আরামদায়ক। সকাল ১০ টায় আম্বরখানা পৌঁছে হাদারপাড়ের উদ্দেশ্যে সিএনজি অটোরিক্সায় উঠলাম। ভাড়া জনপ্রতি ৮০ টাকা।রাস্তার অবস্থা সব জায়গায় খুব বেশি ভালো না হলেও অটোরিক্সা নিয়ে কখনও চাবাগান, কখনও দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, রাস্তার দুধারে গগনচুম্বী বৃক্ষ, কখনও পাথর ভাঙ্গার কারখানা। তবে পরিবেশ একেবারেই বদলে গেল সালুটিকর পার হওয়ার পর। পাহাড়ী ঢলে পথের দুই ধারেই দুচোখ যতদূর যায় শুধু পানি আর পানি। অনেক জায়গায় রাস্তাতেও পানি উঠে গেছে। গাছগুলো যেভাবে পানিতে ডুবে আছে দেখলে আনমনে ভেবে বসতে পারেন, ড্রাইভার সাহেব কি ভুল করে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে নিয়ে আসলো নাকি? সে অর্থে যাত্রা পথেই ভ্রমণের অর্ধেক পয়সা উসুল, কোন প্রকার ভ্রমণ বিরক্তির তো প্রশ্নই উঠে না। আর আপনি স্পটের যত কাছে যাবেন মেঘের দেশের অস্পস্ট নীলাভ পাহাড়গুলো তত স্পষ্ট হতে থাকবে। কীভাবে সময় চলে যাবে টেরও পাবেন না।
সকাল ১১:৩০ নাগাদ হাদারপাড় বাজারে পৌঁছলাম। মিনিট দুয়েক হাঁটলেই ঘাট। সারি সারি ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির ইঞ্জিনচালিত নৌকা বাঁধা আছে সেখানে।
জানা ছিলো নৌকার ভাড়া ৪০০ টাকার বেশি না। তবে সেখানে গিয়ে যে দর শুনলাম, তাতে চক্ষু চরাকগাছ। ১২০০ টাকা চাচ্ছে একটা নৌকার ভাড়া। বড় নৌকা ৩০০০ টাকা। তবে শুধু বিছনাকান্দি না, মোট ৩ টা ছড়া (ঝর্না) ঘুরিয়ে আনবে। বাকি দুটো হল পাংথুমাই এবং লক্ষণছড়া। ঘাটে আমাদের সিনিয়র ব্যাচের আরও ৮ জন সাস্টিয়ান বড় ভাইদের পেয়ে গেলাম। সবাই মিলে রাজি হয়ে গেলাম। ২৪০০ টাকায় বড় নৌকা ভাড়া করলাম। এক্ষেত্রে খরচ জনপ্রতি ১৫০ টাকা। তবে টাকার চেয়ে ৩ টা স্পট একসাথে ঘুরে আসাটাই বেশি লোভনীয় মনে হয়েছিলো। তবে শুধু বিছনাকান্দির যেতে হলে নৌকার ভাড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি হওয়া উচিৎ না, যাতে ৮/৯ জন অনায়াসে যাওয়া যাবে।
এখন আপনার দুইপাশে পিয়াইন নদীর পানি, দুইপাশে গাছপালা, সুবিশাল মেঘছোয়া-সবুজ কিংবা নীলাভ পাহাড়, মাঝে মাঝে ঘরবাড়ি। নদীতে গোসল করতে থাকা অথবা নদীপাড়ে বসে খেলা করতে থাকা পিচ্চি-পাচ্চা, বাঁধভাঙ্গা দুষ্টুছেলেপেলের দল কিংবা অন্য কোন নৌকার ভ্রমনপিয়াসু মানুষগুলো যখন আপনাকে দেখে আনন্দে হাত নাড়াবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনিও দেখবেন কখন যেন ওদের দিকে হাত উঠিয়ে নাড়িয়ে যাচ্ছেন।
পৌনে একটার দিকে আমরা পৌঁছলাম পাংথুমাই গ্রামের "বড়হিল" ঝর্নার কাছে। এই অপরুপ ঝর্নার রূপে বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আসলে কিছুই করার ছিলো না। কারণ এর উৎপত্তি স্থলটা ভারতে অবস্থিত। কী আর করার, রূপে মুগ্ধ হয়েই থাকতে হল, ছুঁয়ে দেখার সাধ পুরন হল না। অবশ্য ঝর্নার জলে গোসল করতে বাঁধা নেই। একজন তো নেমেই পড়লো পানিতে। ফিরতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না কিন্তু ৫ থেকে ১০ মিনিট পরেই আমাদেরকে অনেকটা বাধ্য হয়ে ফিরতে হল। কারণ এখনও যে আরও ২ জায়গায় যেতে হবে।
পরের লক্ষ্য লক্ষণছড়া। নৌকা নিয়ে ঘুরে ঐদিকে যাওয়ার পথ আছে বলে জানালেন মাঝি। তবে তা সময়সাপেক্ষ। তিনি আমাদের গ্রামের ভেতর দিয়ে হাটা রাস্তায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। ৫ মিনিট বললেও সময় লাগলো ১৫ মিনিট। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটা হল একটা সুন্দর ব্রীজ সমেত ছড়াটা এখানেও ইন্ডিয়ার দখলে। তবে সেটা জানার আগেই আমাদের মধ্যে একজন হেঁটে প্রায় কাছাকাছি চলে গেলো। যা কে আবার নিয়ে আসলো স্থানীয় বাংলাদেশী এক কিশোর। যাই হোক, আবারো দূর থেকে দেখা। নোম্যান'স ল্যান্ডের পিলারের উপর বসে ছবি তুলতে ভুল হয়নি।
আর ভারতীয় বাড়িঘর একদমই ৫/৬ কদম দূরত্বে ছিলো। তবে শীতল পানিতে এবারেও আমাদের মধ্যে ২ জন নেমে পরতে ভুলে করেনি। এই ছবিটা ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীতঃ
যাহোক, গ্রামের দোকান গুলো থেকে হালকা চা, বিস্কুট থেকে এবার রওনা দিলাম বিছনাকান্দির দিকে।
একঘন্টার মধ্যেই ( ৩ টার দিকে) ঐ পিয়াইন নদীর শাখা ধরেই পৌঁছে গেলাম বিছনাকান্দি।
বর্ষাকাল বলেই নৌকায় যাতায়াত করা যায়, শুকনা মৌসুমে এক ঘন্টার মত হাটতে হয় বলে জানতে পারলাম। ছুটির দিন বলেই হয়ত দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশ ভালোই ছিলো। জায়গাটায় পৌছার পর কিছুক্ষণ বিমুগ্ধ নয়নে শুধু চেয়ে ছিলাম। সত্যিকার অর্থেই ছবির চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। তারপর হুড়মুড় করে নেমে পড়লাম পানিতে। নিজেদের মধ্যে জলকেলি চলল, নানান ঢঙ্গে ছবি তোলা চলল নানান ঢঙ্গে ছবি তোলা। দুই পাশে আকাশচুম্বী পাহাড়, তার মাঝে বয়ে চলা ঝরনার স্রোত। পানি একেবারে পরিষ্কার, স্বচ্ছ, এবং টলমলে। আর ছোট-বড় নানান আকৃতি আর রঙের পাথর তো আছেই। পানি এত স্বচ্ছ যে পানির তলার পাথর কিংবা নিজের ডুবে থাকা পা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।
মেঘ, পাহাড়, পাথর আর নদীর মিতালি এই বিছনাকান্দি। কাশ্মীর যাইনি কখনও, তবে ছবির কাশ্মীরের চাইতে কম সুন্দর না আমাদের বিছনাকান্দি। নানান রঙ বেরঙের পাথরের একটা সাম্রাজ্য। সামনে এগুনোর চেষ্টা করতেই আবার বাঁধা। এবারও ভারতের দখলে। সত্যি কথা, এবার মহান নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সাহেবের কথা মনে পড়লো। তিনি বলেছিলেন "আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার।" এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল নিজের অজান্তেই... ।
অবশ্য পানিতে নামলে অবশ্যই সাবধান হওয়া উচিৎ। বর্ষাকাল বলে স্রোতও অনেক বেশি। বড় ছোট, মসৃণ পাথরের সাথে সাথে অমসৃণ ও ধারালো পাথরে সংখ্যাও কম না। ভয়াবহ স্রোত আর পাথর যেকোন সময় দুর্ঘটনা ডেকে আনতে পারে।
সোয়া চারটার দিকে আমরা রওনা দিলাম হাদারপাড়ের দিকে। আসার পথে বেশ শীত শীত লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো শরীর একটু উষ্ণতা খুঁজছে। বাকি সময়টা আমাদের পক্ষে কথা বললেও এবারে আবহাওয়া আমাদের পক্ষে ছিলো না। একটু একটু বৃষ্টি শুরু হল। সাথে আমদের একটু একটু কাঁপুনি। ধোঁয়া থাকলেও ছইয়ের নিচে ইঞ্জিনের গরমটা বেশ আরামদায়কই মনে হচ্ছিলো তখন। আধাঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাদারপাড়।
হাদারপাড়ে অনেক সিএনজি অটোরিক্সা পাওয়া যায় আম্বরখানা আসার। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলাম আম্বরখানা। আসার পথটাও মেঘ কেটে গিয়ে বিকেলের ঐ মিষ্টি রোদের মতই মিষ্টি ছিলো। আর ভ্রমনটাও...। শুধু আফসোস... ব্যাপারটা এমন হল যে, প্রেমিকা ত্রয়ের অনিন্যসুন্দর রুপলাবন্যে বিমুগ্ধ হয়ে আঁখিদ্বয় ভিজল বটে, একটা বারের জন্যও ছুঁয়ে দেখা দূরে থাক, কাছে যেতে পারলাম না
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:০৫