বাংলাদেশের প্রাচীন দূর্গনগরী বলে পরিচিত উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে এবার বৌদ্ধ পদ্মমন্দির আবিষ্কার হয়েছে। উয়ারী থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিবপুর উপজেলার ধুপিরটেকে এই মন্দির আবিষ্কৃত হয়। ২০০৯ সাল থেকে স্থানীয়ভাবে মন্দির ভিটা নামে পরিচিত একটি ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়। ২০১০ সালের ৯ জানুয়ারি পুনরায় ঐ প্রত্নস্থানে উৎখনন শুরু হয়। প্রায় তিন মাস কষ্টসাধ্য খননের পর বের হয়ে আসে ইট নির্মিত বৌদ্ধ মন্দিরটি। ১০.৬ মি দ্ধ১০.৬ মি বর্গাকার বৌদ্ধমন্দিরটির দেয়াল ৮০ সে.মি প্রশস্ত। মূল দেয়ালের উত্তর, দণি ও পশ্চিমে ৭০ সেমি. দূরত্বে সমান্তরালভাবে ৭০ সেমি. প্রশস্ত দেয়াল রয়েছে । মূল দেয়ালের চারদিকে ইট বিছানো ৭০ সেমি. প্রশস্ত প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে। প্রদণি পথের বর্হিদিকে মূল দেয়ালের সমান্তরাল ৬০ সেমি. প্রশস্ত দেয়াল বিদ্যমান। পূর্ব দিকে প্রদক্ষিণ পথ ও বারান্দা রয়েছে। এ পর্যন্ত বৌদ্ধ মন্দিরটিতে দু’টি নির্মাণ যুগ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আদি নির্মাণ যুগের ইট বিছানো মেঝের অংশবিশেষ উন্মোচিত হলেও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে আরও সময় প্রয়োজন। তবে পরবর্তী নির্মাণ যুগে পূর্ব-দণি কোণে ইট বিছানো একটি বেদী পাওয়া গিয়েছে। দ্বিতীয় নির্মাণ যুগের মেঝেতে লাল ইট নির্মিত পদ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। আটটি পাঁপড়িযুক্ত একটি পদ্ম অনেকটা অত রয়েছে।
খনন এলাকার মানুষেরা জানান এই স্থানটিকে তারা মন্দিরের ভিটা নামেই চিনতেন। তারা মাঝে মাঝে ঢোলের শব্দ শুনতে পেতেন। তাদের ধারণা ছিল বাঁশ ঝাড়ে ছাওয়া এই টেকে হয়তো কোন হারানো রতন লুকিয়ে ছিল। স্থানীয় মানুষদের সহযোগীতায় ২০০৯ সাল থেকে সেখানে খনন শুরু হয়। সুফী মুস্তাফিজুর রহমানের তত্ত্বাবধানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খনন শুরু করেন। ২০১০ সালে খনন শুরুর তিনমাস পর গবেষকরা বৌদ্ধ মন্দিরের নিদর্শন আবিষ্কার করেন। আবিষ্কৃত হয় প্রদণি পথ, বারান্দা, বেদি, পদ্ম। এসকল নিদর্শনের উপস্থিতি স্থাপনাটিকে বৌদ্ধ মন্দির হিসেবে চিহ্নিত করে। মোট সাতটি পদ্ম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়টি পদ্ম ভঙ্গুর অবস্থায় পাওয়া যায়। এগুলোর পুনরানয়ন সম্ভব বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
পদ্মের উপস্থিতি মন্দিরটিকে পদ্ম মন্দির বা লোটাস টেম্পলের মর্যাদা দেয়। বৌদ্ধ ধর্মে পদ্ম খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং বহুল ব্যবহৃত। সাধারণত ধারণা করা হয় বুদ্ধের মূর্তির বদলে পদ্ম ব্যবহার করা হয়। খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতক থেকে বৌদ্ধ ধর্মে প্রতীকের ব্যবহার দেখা যায়। আবিষ্কৃত প্রায় অত পদ্মটিতে ৮টি পাঁপড়ি পরিলতি হয়। হতে পারে ৮টি পাঁপড়ি বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টমার্গের প্রতীক। সৎ বাক্য, সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম, সৎ জীবন, সৎ সংকল্প, সৎ চেষ্টা, সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সমাধিকে অষ্টমার্গ বলা হয়। সাদা, লাল ও গোলাপী রং এর পদ্ম ফুল ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। লাল রং এর পদ্মকে সংস্কৃত ভাষায় কমল বলা হয়। এই পদ্ম প্রতীকী অর্থে হৃদয়জাত উপলব্ধিকে বোঝায়। হৃদয়ের অনুভূতি এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। বুদ্ধ ধর্ম চক্রের আটটি দন্ড দেখতে পাওয়া যায়। বুদ্ধ পদ্মের মতোই এই পৃথিবীর সকল মোহ ছেড়ে পূর্ণ বিকশিত হতে আহ্বান জানান। ধুপিরটেকে প্রাপ্ত পদ্মকে বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের পুষ্প হিসেবে উল্লেখ করা যায়। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের বিনয়াবনত অবস্থাকে নির্দেশ করে। বাংলাদেশের সমতট (কুমিল্লা) এবং পুন্ড্রবর্ধন জনপদের বগুড়া, নওগাঁ ও দিনাজপুর অঞ্চলে বৌদ্ধ বিহার, মন্দির ও স্তুপ আবিষ্কৃত হয়েছে। মন্দিরভিটা ধুপিরটেকে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ মন্দিরটি উয়ারী-বটেশ্বর তথা মধুপুর গড় অঞ্চলের বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্যা বহন করছে। অধ্যাপক সুফী জানান, ‘আমাদের হাতে এ মূহুর্তে আরো বেশ কিছু চলমান গবেষণা রয়েছে যা সমাপ্ত হলে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার বিকশিত রূপ ফুটে উঠবে।’
১৮৮৫ সালে শিবপুর উপজেলার আশরাফপুর গ্রামে আবিষ্কৃত ২টি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, রাজা দেবখড়গ ৭ম শতকে এই অঞ্চলের চারটি বিহার এবং বিহারিকার ব্যয় নির্বাহের জন্য কিছু ভূমি দান করেন। আবিষ্কৃত বৌদ্ধ মন্দিরটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও দেবখড়গের লিপিস্যা অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে আনুমানিক ৭ম শতকের বলে মনে করা যায়। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব বুদ্ধিজম গ্রন্থে বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা ২য় শতকে শুরুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৫ শতকের উয়ারী দুর্গ নগরে খ্রিস্টপূর্ব স্তরে নবযুক্ত মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আয়ান গ্লোভার নবযুক্ত বিশেষ মৃৎপাত্রকে বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত বলে মত প্রকাশ করেন। এই বিষয়ে সুফী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আয়ান গ্লোভারের মতামত সঠিক হলে বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা শুরুর ইতিহাসে একটি যুগান্তকরী পরিবর্তন আসবে।’
উয়ারীর সাথে এই মন্দিরের সম্পর্ক কি তা জানতে চাইলে মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ উয়ারী দূর্গ নগরীকে কেন্দ্র করে আরো অনেকগুলো প্রত্নস্থান রয়েছে। শিবপুরে প্রাপ্ত বৌদ্ধ মন্দিরের সময়কাল এখনো নির্ণিত না হলেও এর সাথে উয়ারীর সম্পর্ক অনুমান করা যায়। কারণ একটি সভ্যতার শুরু এবং বিস্তৃতি ও ধ্বংসের সময়কাল লম্বা। বিস্তৃত এলাকা নিয়েই গড়ে ওঠে কোন সভ্যতা। ফলে এই মন্দিরের সাথে উয়ারীর সম্পর্ক অথবা যোগাযোগ থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আরো গবেষণা এবং খননের ফলেই এসব বিষয়ে নানা তথ্য দেয়া যেতে পারে। এই মন্দিরের প্রাপ্তি উয়ারী এবং তার আশপাশের সর্ণোজ্জ্বল সভ্যতার নিদর্শনকেই তুলে ধরে।’ উয়ারী-বটেশ্বরে এর আগেও বিভিন্ন বৌদ্ধ নিদর্শন পাওয়া গেছে। উয়ারীতে প্রাপ্ত নবযুক্ত মৃৎ পাত্র ও স্টাম্পড্ মৃৎপাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক। তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মীয় আচারের সাথে এর সম্পর্ক থাকতে পারে। উয়ারীতে প্রাপ্ত লাঙ্গল বা তীরের ফলা, খড়গ, হাতকুঠার, নেকড়ে, ঘটদেবী, হৃদয়, দাঁত, চোখ ইত্যাদি প্রতীক বিশেষ কোনো দর্শন-চিন্তার ফল বলে মনে করা হয়। যেমন, কুঠার দ্বারা শত্রু ধ্বংস, কচ্ছপ দ্বারা দীর্ঘ জীবন, হাতি দ্বারা সার্বভৌমত্ব বোঝায়। উয়ারীতে প্রাপ্ত বিশ্বাস-প্রতীকসমূহ কৃষি-সম্ভূত প্রকৃতিপ্রেমী এক জাতিসত্তার পরিচয়বাহী। সর্বমোট ৪৮ টি প্রত্নস্থান নিয়ে উয়ারী নগর-সভ্যতার বিস্তৃতি চিহ্নিত করা হয়। উয়ারীকে অবশ্য এই নগর-সভ্যতার কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা। নদীতীরবর্তী উয়ারী অঞ্চলটি ছিল একটি বাণিজ্যকেন্দ্র, এর পাশ দিয়ে বহমান ব্রহ্মপুত্র নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে দণি ও দণি-পূর্ব এশিয়া হয়ে সুদূর রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। উয়ারীর ভূ-প্রাকৃতিক বিন্যাস এবং উয়ারীতে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন বাণিজ্য-কেন্দ্র হিসেবে উয়ারীর সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রতীক রূপে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণে রৌপ্যমুদ্রা স্থানটিকে প্রাক-নাগরিক জনপদ ও পরবর্তীকালের নাগরিক সভ্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বৌদ্ধ মন্দির দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১০ দুপুর ১:৫৩