*পুরোটাই স্পয়লার। লেখাটি না পড়ে ঘুরে আসুন। নিরাশ হবেন না।
সারারাত বাসে ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বন্ধুর ডাকে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি পাহাড়ী রাস্তায় চলছে বাস। যে উঁচু পাহাড়ের হাতছানিতে খাগড়াছড়ি যাওয়া, তাতে বাড়তি কিছু এক্সাইটমেন্ট যোগ করে ছোট ছোট টিলার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা এই পথ। বলা যায় দুর্দান্ত কোনো সিরিজ শুরুর আগে পাইলট এপিসোড।
সকাল দশটায় খাগড়াছড়ি সদরে বাস থেকে নামলাম। সেখান থেকে বাসে করে যাত্রা শুরু দীঘিনালার উদ্দেশ্যে। অবশ্যই বাসের ছাদে বসে। দৃষ্টিপথ ৩৬০ ডিগ্রি। টিকেট কেটেও বাসের মধ্যে না বসে ছাদে বসাটা হেল্পারের কাছে বিষ্ময়করই ছিলো। তবে চারপাশ দেখতে না পেলে পাহাড়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। যাই হোক উত্তেজনার পারদ উর্ধ্বগামী করে দীঘিনালায় পৌঁছলাম। সেখান থেকে চাঁদের গাড়িতে করে সাজেকের পথে যাত্রা। গাড়িতে যাত্রী আমরা তিনজন। আর্মি ক্যাম্প থেকে সঙ্গী হলেন এক সৈনিক। অতঃপর চাঁদের গাড়ির ছাদে করে উঁচু নিচু পাহাড়ী রাস্তায় ছুটে চলা। এবার সিরিজের আসল উত্তেজনা শুরু। বিশাল ঢাল বেয়ে প্রায় ৭০ কি.মি. গতিতে নেমে যাওয়া, বিশাল ডাল বেয়ে উপরে ওঠা আর বিপদজনক গতিতে বিপদজনক সব বাঁক নেওয়া রক্তের অ্যাড্রেনালিন বাড়িয়ে তোলে। দীঘিনালার পরে বাঙালী বসতি আর আছে বলে মনে হয় না। যারা আছে তারা ব্যাবসা কিংবা চাকরীর জন্য। কিছুদূর পরপরই আদিবাসীদের বসতি চোখে পড়ে, তবে সংখ্যায় বেশ কম। প্রতিটি বাড়ির সামনেই কিছু ছেলেমেয়ে, আমাদের দেখে হাত নাড়ছে। বাঘাইহাটিতে যাত্রাবিরতি। এরপর আবার ছুটে চলা। এবার চোখে পড়লো পাহাড়ী নদী। উঁচু রাস্তা থেকে দেখা মেলে নিচ দিয়ে ছুটে চলা নদী। একপাশে ঢাল আরেক পাশে পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ার ওপর দিয়ে চোখে পড়ে আরো উঁচু পাহাড়। অবশেষে পৌঁছে গেলাম সাজেক ভ্যালির গেইটে। গেইটের সামনে পাহাড়ের ঢাল থেকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। পাহাড়ের খাদে জমে আছে কুয়াশা। বিমোহিত সে সৌন্দর্যে আমরা। আর্মির সেই ভাইয়ের ডাকে মনে পড়লো এখনো অনেক বাকী। ঢুকে পড়লাম সাজেক ভ্যালিতে। প্রথমেই এক আদিবাসী পাড়া, রুইলুই। নারী শিশুরা রাস্তার পাশে বসে আছে। দীঘিনালা থেকে দুর্দান্ত গাড়ি চালিয়ে এসে পাড়ায় ঢুকেই আমাদের চাঁদের গাড়ির গাড়িয়াল গাড়ি তুলে দিলো আদিবাসীদের ছাগলের ওপর। স্পিড কম থাকায় হঠাৎ ব্রেক। শুধু পা-টাই ভাঙলো। শুরু হলো আদিবাসীদের চ্যাঁচামেচি। সেই সৈনিক ভাইয়ের মধ্যস্থতায় জরিমানা দিয়ে এগিয়ে গেলাম আরো সামনে। কিছুক্ষণ আর্মি ক্যান্টিন "রক প্রশান্তিতে" বসে রুইলুইয়ের এক গেস্ট হাউজে গিয়ে চেক ইন দিলাম।
সি লেভেল থেকে সাজেক প্রায় ১৫০০+ ফুট উঁচুতে। কিন্তু সাজেক থেকে পুর্বে তাকালে একরাশ হতাশায় ডুবিয়ে উদয় হয় লুসাই পাহাড়। সাজেক ভ্যালির হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে লুসাই দেখলে নিজেকে অনেক বেশী ক্ষুদ্র মনে হয়। আসামের এক বাজারও চোখে পড়ে উপর থেকে। বিকেলটা পাহাড়ের ঢালে বসে লুসাই দেখে কাটলো। ধীরে ধীরে কুয়াশা এসে সামনের ছোট ছোট পাহাড়ের খাঁদগুলো ঢেকে দেয়। তখন মনে হয় কতগুলো সাদা নদী বয়ে যাচ্ছে। সূর্য নামে কমলকের উপর দিয়ে। আকাশে অদ্ভুত সব রঙের মেলা তখন। সূর্য ডুবে যাওয়ার পরেও পাহাড়ের পেছন থেকে আলো খেলা করে। রঙ বদলায় মেঘ। তারপর ডুবে যায় সূর্য আর ঝুপ করে আঁধার নামে পাহাড়ের আরেক পাশে। মেঘের আড়াল থেকে হঠাৎ উঁকি দেয় আধভাঙা চাঁদ। মেঘ থাকায় তারার দেখা মেলেনি। দূরে বৃষ্টি হচ্ছিলো। বজ্রপাতের আলোয় আগুন রাঙা হয় মেঘ। নির্জন চারপাশ। রাতে "রক প্রশান্তিতে" ডিনার। পাহাড়ের ঢালে রক প্রশান্তি। বারান্দায় বসে ডিনার। দূর থেকে শীতল বাতাস ভেসে আসে আর সাথে আসে অজানা কোনো পাখির ডাক। সামনে ঘন অন্ধকার আর জঙ্গল। ডিনার শেষে গেস্টহাউজে ফিরলাম। ফাঁকা রাস্তা। কোথাও কেউ নেই। আমরা তিনটি প্রাণী হেঁটে চলেছি। রুইলুইয়ে ঢোকার পর রাস্তার দুই পাশে দেখা যায় আদিবাসীদের জটলা। একসাথে গান শুনছে। দুয়েক ঘরে হয়তো টেলিভিশনও আছে। সবাই একসাথে বসে দেখছে। গেস্টহাউজে ফিরেই ঘুম। খুব ভোরে উঠতে হবে।
খুব ভোরে উঠে বের হলাম। উঁচু এক টিলায় দাঁড়িয়ে দেখলাম সূর্যদেবের উত্থান, লুসাইয়ের পেছন থেকে। নিচের পাহাড়গুলো ঘন কুয়াশায় কিংবা মেঘে ঢেকে আছে। এরপর চাঁদের গাড়িতে করে গেলাম কমলকে, সাজেকের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ও আদিবাসী পাড়া। কমলকের নিচে গাড়ি রেখে হেঁটে উপড়ে ওঠা। উচ্চতা ১৭০০+ ফুট। পাড়ায় ঢুকতে তিন/চারটি সিঁড়ি। আর পাশেই অনেক বছর আগের উপজাতি নেতাদের কবর। টম্বস্টোনে লেখা তাদের নাম। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চারপাশে তাকালে নিজেকে মনে হয় দেবতা। নিচের ছোট ছোট পাহাড়গুলি যেন মাথা নিচু করে আছে আমার সামনে। কমলক তেকে নামার সময় দেখলাম পাহাড়ী মেয়েরা কলসীতে পানি নিয়ে উঠছে। পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে যখন চারপাশ দেখছি, তখন পাহাড়ী হুঁকা হাতে এক ছেলে এসে বলে পাহাড়ী সিগ্রেট, খাবেন নাকি? অত বড় বাঁশের হুঁকায় দম দেয়ার সাহস তখন হয়নি। কমলক থেকে গেস্ট হাউজে ফিরেই চেক আউট। এবার ফেরার পালা। ঢালু রাস্তায় অনেক স্পিডে সাঁই করে নেম যাওয়া, আবার ঢাল বেয়ে উপরে ওঠা। গাড়ির ছাদে বসে সে ওঠানামা করার রোমাঞ্চকর অনুভূতি অপ্রকাশ্য। বাঘাইহাটি হয়ে দীঘিনালার পথে। সামনে আর্মির চেকপোস্ট। গাড়ির নাম্বার আর যাত্রীদের একজনের চেক আউট দিতে হয়। ঘ্যাচ করে ব্রেক করে গাড়ি থামালো ড্রাইভার। চেক আউট দিয়ে আবার চাকা গড়ালো। সাথে সাথে দুটো আর্তচিৎকার। একটি আমার আর আরেকটি গাড়ির নিচে চাপা পড়া এক কুকুরের। কুকুর আগেই দেখেছিলাম গাড়ির সামনে একদম চাকার সামনে শুয়ে আছে। ড্রাইভার দেখেনি সেটা আমি বুঝতে পারিনি। কিছুক্ষণ কুঁইকুঁই করে মারা গেলো কুকুরখানা। আর্মির এক অফিসার ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে কুকুর তুলে দিলো আমাদের গাড়িতে। কিছুদূর গিয়ে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলে ফেলে দেয়া হলো মৃত কুকুর। তারপর আবার চলল গাড়ি। বলে রাখা উচিৎ এই দুটি অ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া পাহাড়ী রাস্তায় দুর্দান্ত গাড়ি চালিয়েছে ড্রাইভার। সেই সাথে ভালো গাইড হিসেবেও কাজ করেছে। সেই ধারা বজায় রেখেই পথে আবার গাড়ি থামালো সে। তার সাথে জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে চোখে পড়লো ছোট্ট এক ঝর্ণা। নাম হাজাছড়া। বর্ষা এখনো আসেনি। জলের প্রবাহ কম। তবে তাতেই জলকেলি চলল কিছুক্ষণ। গাড়িতে ফিরে এসে আবার ছুটে চলা। থামলো একেবারে দীঘিনালায় এসে। দীঘিনালা থেকে বাইকে করে চললাম খাগড়াছড়ি শহরে। সেখান থেকে একই বাইকে আবার যাত্রা শুরু আলুটিলার পানে। আলুটিলায় ছোট একটি সুরঙ্গ আছে(যদিও যে সুড়ঙ্গে বোরখা পরা নারীরা অবলীলায় ঢুকে যায় তাকে সুরঙ্গ বলা যায় কিনা তাতে ঢের সন্দেহ আছে)। তবে মানুষের উৎপাত বড্ড বেশী। সিঁড়ি বেয়ে অনেকখানি নেমে ঢুকলাম সুড়ঙ্গে। বলে রাখি, সুড়ঙ্গে ঢোকার সময় দেখবেন আশেপাশে কেউ যেনো না থাকে। বিশেষ করে নারী ও শিশু। এরা আপনার অপেক্ষাতেই থাকবে। আপনি ঢুকলে সাথে সাথে ঢুকে পড়বে। একা ঢুকতে ভয় পায়। তারপর শুরু করবে চ্যাঁচামেচি। মশাল হাতে খানিকটা এগুলেই সুরঙ্গ শেষ। আবার বাইকে করে শহরে ফেরা। শহরের পানখাইয়াপাড়ায় উপজাতিদের এক রেস্ট্যুরেন্ট, নাম সিস্টেম রেস্তোরাঁ। লাঞ্চ করতে গেলাম সেখানে। মেন্যু- আতপ চালের ভাত, বাঁশ ভাজি, মাশরুম ভাজি, ঝাল মুরগী আর ডাল। শুনেছিলাম সিস্টেম রেস্তোরাঁয় না খাওয়া মানে নাকি বিরাট মিস। তবে খাওয়ার পর বন্ধুর মন্তব্য,"সিস্টেমে বাঁশ খেলাম এবং বাঁশ খেলাম। লাঞ্চ করে বাস স্টপে এসে বাসের অপেক্ষায়। ফোনে চার্জ নেই। বন্ধ হয়ে আছে। চার্জ দিচ্ছি । সামনে অনেক পথ। প্লে লিস্টে অনেক গান। তবে পেছনে পড়ে আছে স্বর্গ। অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। আবার আসবো হয়তো অন্য কোথাও। তবে পাহাড়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ২:৫০