তখন আমার বয়স আর কত হবে ১০-১৫ বছর, আমার মা খালার সাথে একটি অসাধারন সিনেমা দেখছিলাম হলে যেয়ে। সে আমলে হলে যেয়ে ছবি দেখার পরিবেশ ছিল। আমি বলছি ২৫-৩০ বছর আগের কথা। ছবির নাম ছিল “আনারকলি” এত দিনে আমি ভূলে গেছি কে ছিল আকবরের ভূমিকায় কে ছিলেন সেলিম আর কে ছিলেন “আনারকলি”। আকবর ছিলেন সম্ভবত দারাশিকো। যাই হোক সেই শৈশবে এর নিটোল প্রেম কাহিনী আমার মনে দাগ কাটছিলো। মারাত্মক এক রোমান্টিক আবহ বিরাজ করত আনারকলি- সেলিমের প্রেম কাহিনী আমার মনে। এতদিন তাই জানতুম, আকবরের গোয়ার্তুমিতে একটি অসাধারন প্রেম কাহিনী শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কয়দিন আগে এ্যালেক্স রাদারফোর্ডের “Ruler of the world” বইটি পড়ে মারাত্মক ধ্বাক্কা খেলাম।
কি আছে Ruler of the world বইটিতে? চলুন দেখি, নওরোজের অষ্টম দিনে সবে মাত্র সূর্য অস্ত গেছে সবাই আমোদ প্রমোদে ব্যাস্ত। স্বয়ং সম্রাট আকবরের উপস্থিতিতে। এটাই তখন কার রেওয়াজ বাংলা নববর্ষের আনন্দে সম্রাট নিজেই উপস্থিত থাকতেন। সম্রাটের জন্মদিনের পর এটাই সবচেয়ে জাকঝমক পূর্ন অনুষ্ঠান।
মধ্য্ রাত সমাগত। সম্রাট আকবর ঊঠে দাড়ালেন। সভা স্তদ্ধ। ঘোষনা দিলেন, তুরস্কের সুলতান তার জন্য দু’মাস আগে বিরল সৌন্দর্য্যের একজন ইটালীয় নর্তকী উপহার পাঠিয়েছেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন আনারকলি কারন মেয়েটির গায়ের রং ছিল ডালিমের দানার মতো লাল টসটসে।
রাজ ভৃত্যরা জলসা অনুষ্ঠানের চারিদিকে কৃত্রিম ধোয়া সৃষ্টি করলেন। যা ছিল চন্দন কাঠের তৈরী। সুবাসিত ধোয়ার মধ্য থেকে বের হয়ে আসল আনারকলি। একটি অর্ধ স্বচ্ছ ওড়নায় তার দেহের ওপরের অংশ আচ্ছাদিত। নীচে একটি ঢোলা পাজামা। আনারকলি তার দু বাহু ওপরে তুলে সমগ্র দেহটি দোলাতে আরম্ভ করল। নেই কোন বাদ্য যন্ত্র, কেবল তার হাতের চুড়িগুলোর সংঘর্ষে সৃষ্ট মূর্ছনা আর নুপুরের কিন্নরই তার সঙ্গী। বুনো সর্পিল ভাবে নেচে চলল আনারকলি। তার মানে প্রথমত আনারকলি ছিল সম্রাট আকবরের জন্য প্রেরিত তুরস্কের সুলতানের ইটালীয় শয্যা সঙ্গিনী।আনারকলি শুধু নাচ নয়, কাব্য, সাহিত্য ও সঙ্গীতেও ছিলেন পারদর্শী।
নৃত্যরত আনারকলি শেষ মূহুর্তে যখন টান দিয়ে তার ওড়না ফেলে দিয়ে আকবরকে কুর্নিশ করে মোমবাতির প্রকম্পিত আলোতে শাহজাদা সেলিম দেখলেন তার মুখ মন্ডল ডিম্বাকৃতি এবং থুতুনিতে চিড় আছে। নাকটি ছোট কিন্তু খাড়া। তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় তার চোখ যা সেলিম আগে কখন ও দেখেনি, সেগুলি গাঢ় নীল অথবা বেগুনীর মধ্যবর্তী কোন রং। সেলিমের হৃদ স্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। আনারকলি কে তার পেতেই হবে, এ ছাড়া কোন উপায় নেই, সেলিম ভূলে গেল আনারকলি তার বাবার রক্ষিতা।
এ সময় সেলিম আর আকবরের মধ্যে চলছিলো ব্যাক্তিত্বের এক ঠান্ডা লড়াই। সেলিম যেনতেন উপায় আকবরকে আঘাত করে আনন্দ পেত। আসলে রাজকীয় রক্তে রক্তর বন্দন থেকে ক্ষমতা আর ব্যাক্তিত্বের দ্বন্দ বড় হয়ে দেখা দেয়। আনারকলিকে পেতে সেলিম ঘুষ দিয়ে হাত করেন সম্রাট আকবরের খাজানসারা কে। খাজানসারা হল হেরেমের রক্ষী।
আকবর তিন সপ্তাহের জন্য শিকারে গেলে খাজান সারা অতি গোপনে অনারকলিকে শাহজাদা সেলিমের খেদমতে হাজির করেন।পরবর্তীতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আনারকলিও তার প্রেমে মজেছিলেন। তারা অভিসারে যেতেন। তবে তাদের মধ্যকার দেখা সাক্ষৎ গোপন রাখা হতো। তাদের রোমাণ্টিক সম্পর্কের সময় আনারকলির বয়স ছিল চল্লিশের কোঠায় কিংবা তার চেয়ে বেশি। শাহজাদা সেলিমের বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। তিনি ছিলেন তখন অন্তত তিনটি পুত্র সন্তানের পিতা।
পরবর্তীতে সেলিম আকবরের জীবনি লেখক অতি বিশ্বস্ত আবুল ফজলের বুদ্বিতে ধরা পড়েন যে আনারকলি আর সেলিম প্রেমে মজেছেন। শেষবার যখন সেলিম গোপনে আনারকলির সাথে প্রসাদ থেকে আধা মাইল দূরে রবি নদীর তীরে এক ভগ্নস্তুপের মধ্যে দেখা করতে যান তখন আকবরের সেনাদের হাতে ধরা পড়েন।
আকবর বন্দী করে আনারকলিকে হেরেম খানয় নিয়ে যায় সেখানে সেলিমের উপস্থিতে আনারকলিকে জ্যান্ত কবর দেবার শাস্তি দেয় যেন আনারকলি তিলে তিলে মারা যায়। পরে জানা যায় সেলিমের অনুরোধে তার দাদী হামিদা সম্রাট আকবরের মা আনারকলিকে গোপনে বিষ সরবরাহ করে যেন কষ্ট পেয়ে না মারা যেয়ে এক বারে মারা যায়। এই হল ইতিহাস।
আমাকে কষ্ট দিল আমার এত প্রিয় একটা প্রেমিক যুগল আসলে পবিত্র প্রেম না এক অসম ব্যাভিচারে লিপ্ত ছিল। কে ছিল আনারকলি? আনারকলি ছিল এক ইতালীয় সওদাগরের সুন্দরী কন্য। যে তার পিতার সাথে আফ্রিকার উত্তর উপকূল থেকে সওদাগর জাহাজে করে যাত্র করে ত খন তার বয়স মাত্র ১৫। জলদস্যুরা তার বাবাকে হত্যা করে তাকে অপহরন করে এবং ইস্তাম্বুল ক্রীতদাস বাজারে এক পতিতালয় মালিকের কাছে বিক্রি করে।
পতিতালয়ের মালিক তাকে পুরুষদের মনোরঞ্জনের যথোপযুক্ত শিক্ষা দেয়। এরপর এক ধনাঢ্য ব্যাক্তির কাছে বিক্রি করে। ওই ব্যাক্তি তাকে কিছুদিন পর তুরস্কের সুলতান এর কাছ নজরানা পাঠায়। সেটি আকবরের কাছে আসার বছর চারেক আগের ঘটনা।
আনারকলিকে একটি দেয়ালের ভেতর জীবন্ত চাপা দেয়া হয়। লাহোরে পাঞ্জাব সচিবালয় প্রাঙ্গনে মল রোডের পাশে একটি বিরাট সৌধ। ধারণা করা হয় যে, ১৬১৫ সালে প্রেমাসক্ত শাহজাদা সেলিম তাজমহলের পূর্বগামী হিসাবে এ সৌধ নির্মাণ করেন। সৌধটি জনসাধারণের জন্য উন্মু্ক্ত। বর্তমানে ভবনটি একটি মোহাফেজখানা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে বর্তমানে পাঞ্জাবের রেকর্ড অফিস। ব্রিটিশ আমলে জায়গাটি একটি গীর্জায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। মল রোডের নিকটবর্তী একটি বাজারের নাম আনারকলি। আনারকলির নামানুসারে এ বাজারের নামকরণ করা হয়। পাকিস্তানে এটি হচ্ছে প্রায় ২ শো বছর আগের সবচেয়ে পুরনো বাজার। সৌধটি অষ্টাভুজাকৃতির। মাঝখানে একটি বিশাল ছাদ। ৮টি অষ্টভুজাকৃতির গম্বুজ। গম্বুজগুলো স্তম্ভের ওপর নির্মিত। একসময় সৌধের চারপাশে ছিল একটি বাগান।
একটি স্তম্ভে আল্লাহর ৯৯টি নাম এবং দুই পংক্তির একটি ফারসি কবিতা:
তা কিয়ামাত শুকর গুইয়াম কারদিগারি কিশ রা
আহ, গার মান বাজ বিনাম রু ইয়ার-ই-খুশ রা
আমি রোজ কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করবো
আহ, আমি কি একবার আমার প্রিয়তমার মুখ দেখতে পারবো?
কবরের উত্তর মাথায় নিচে উল্লেখিত এ শব্দ ক’টি উৎকীর্ণ:
মজনু সেলিম আকবর।
সবকিছু মিথ্যা হলেও উপরে উল্লেখিত উৎকীর্ণ কথাগুলো তো মিথ্যা নয়। উৎকীর্ণ লিপির ভাষা হচ্ছে কারো হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ার যন্ত্রণা। সেলিমের নাম লেখা থাকায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, ভুক্তভোগী শাহজাদা সেলিম ছাড়া আর কেউ নন। আনারকলি হয়ত বারবনিতা ছিলেন কিন্তু সেলিম ছিলেন আনারকলির প্রেমে মাতোয়ারা
সৌধে সংখ্যা এবং কথায় দু’টি তারিখ। পূর্ব পাশে ১০০৮ হিজরি (১৫৯৯-১৬০০ সাল) এবং পশ্চিম পাশে ১০২৪ হিজরি (১৬১৫-১৬ সাল)। প্রথম তারিখটি হচ্ছে আনারকলিকে মৃত্যুদণ্ড দানের এবং দ্বিতীয়টি সৌধ নির্মাণের।
আনারকলিকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯২৮ সালে লাভস অব অ্যা মোগল প্রিন্স নামে প্রথম একটি ছবি নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৩ সালে ভারতে আনারকলি নামে আরেকটি ছবি নির্মাণ করা হয়। ছবিতে আনারকলি চরিত্রে অভিনয় করেন বীনা রায়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে আনারকলি নামে আরেকটি ছবি মুক্তি পায়। নূরজাহান হলেন ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে কে. আসিফ পরিচালিত মোগল-ই-আজম মুক্তি পায়। এ ছবিতে আনারকলি চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেত্রী মধুবালা। ছবিটির কিছু অংশ ছিল রঙ্গীন। ২০০৪ সালে পুরোপুরি রঙ্গীন ছবি হিসাবে মোগল-ই-আজম মুক্তি পায়। ২০০৩ সালে শোয়েব মনসূরের স্বল্পদৈর্ঘ্য ধারাবাহিক মিউজিক ভিডিও ইশকে ইমান আলী আনারকলি চরিত্রে অভিনয় করেন।
সূত্রঃ http://en.wikipedia.org/wiki/Anarkali
Ruler of the world by Alex Ratherford
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৭:৫৪