
প্রায় ১৫-২০ বছর আগের কথা। আমি তখন ক্লাস ১/২এ পড়ি। ছোট চাচার পরিবারের সাথে চাচাতো, ফুফাতো অনেক গুলো ভাইবোন মিলে আমরা সবাই মিলে গেলাম একটা পারিবারিক পিকনিকে, তিস্তা নদীর পারে। নদী মানেই নৌবিহার। কিন্তু গ্রুপ নিয়ে ওঠার মত নৌকা পাওয়া যাচ্ছিলো না। ছোট্ট একটা ডিঙ্গি নৌকা পেয়ে প্রায় পনেরোজন লাফিয়ে উঠলাম। চাচা প্রথমে একটু গাই গুই করছিলো, সদ্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়েছেন, মাঝিকে একটা ঝাড়ি দিয়ে বললেন, ডুববে নাতো?
কি কন ছার, আমি ডুবমু নৌকা ডুববার দিমু না।
নৌকা মাঝ নদীতে গিয়ে আনএক্সপেক্টেড ঝামেলায় পড়ে গেলাম। এক পাল শুশুক নৌকার পাশে এসে নাচানাচি শুরু করে দিল। আমার ৫/৭ বছরের জীবনে এই বিচিত্র চেহারার প্রানীটা এই প্রথমবার দেখছি। টিভিতে দেখা ডলফিনের মতই, এটাও পানির উপরে ভুস ভুস করে লাফিয়ে উঠে, মজার তো। শিশুক গুলো শিশুদের মত খেলতে ভালোবাসে মনে হয়। খেলাচ্ছলে কয়েকবার নৌকায় ঢু মারলো। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় পনেরজন ওঠায় আগে থেকেই নৌকা ডুবু ডুবু ছিল। এবারে ত্রাহি অবস্থা। জানের ভয়ে সবাই গলা ফাটিয়ে চিল্লা চিল্লি। শুশুকরা স্তন্যপায়ী প্রানী, মাছ নয়। সেজন্যে ফুলকা জিনিসটাও নেই। শ্বাস নিতে একটু পরে পরে ভেসে ওঠে। আর এক দঙ্গল শুশুকের ডুবা ডুবিতে নৌকাও ডুবি ডুবি।

অল্প পানিতে শুশুক।
তখন অবাক করা একটা ঘটনা ঘটলো মনে হলো শুশুকেরা দিক পালটে শুধু একদিকে ঢেউ তুলছে যাতে আমরা নদীর পারের দিকে যেতে পারি। নিঃসন্দেহে প্রানীগুলো বুদ্ধিমান। আমাদের চিল্লা চিল্লিতে বড় কয়েকটা নৌকা এসে আমাদের তুলে নিল। সবাই মিলে ডিঙ্গি নৌকার মাঝিকে গালি গালাজ করছিলো। কয়েকজন মাঝি বললো নৌকাডুবে গেলে নাকি ডুবন্ত লোকজনদের মাঝে মাঝে সাঁতরাতে সাহায্য করে শুশুকেরা। তবে এগুলো শুধুই গল্প।
শুশুক হচ্ছে একধরনের মিঠা পানির ডলফিন। পৃথিবীতে আমাজন ডলফিন ছাড়া আর সব মিঠা পানির ডলফিন (রিভার ডলফিন) ভারতীয় উপমহাদেশে বাস করে। উপমহাদেশে ২ প্রকার রিভার ডলফিন পাওয়া যায়। ১ গাঙ্গেজ ডলফিন আর ২। ইরাবতি ডলফিন। ১৯৭০সাল পর্যন্ত এদের দুই প্রকারকেই ১টা স্পিসিস হিসাবে দেখা হত। পরে আলাদা করা হয়। ইরাবতি ডলফিনের মুখের সামনের অংশ লম্বাটে হয়, এরা পাকিস্তান এবং ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে সাধারনত সাগরের কাছা কাছি থাকে। ইরাবতী ডলফিন পুরোপুরি মিঠাপানির ডলফিন না। এরা সাগরে এবং সাগর নিকটবর্তি নদীতে (মুলত ব্রিড করতে) থাকে। গাঙ্গেজ ডলফিন তথা শুশুক/শিশু/শিশুক (Platanista gangetica ) থাকে মুলত গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ঘোলা পানির নদীতে। জন্মান্ধ এই প্রানীটাকে বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালের কিছু নদী ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। ৭০এর দশকের পর থেকে ব্যাপক জনসঙ্খ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দুষন এবং অতিমাত্রায় মাছ শিকারের ফলে আশঙ্কাজনক ভাবে এই প্রানীটার সংখ্যা কমে গেছে।
শুশুকের মুখের সামনের জ সামনের দিকে বাড়ানো থাকে এবং তাতে প্রচুর দাঁত থাকে। শুশুক ঘোলা পানিতে থাকে এবং এরা জন্মান্ধ, শিকার এবং পথ চলার জন্যে শুশুক একধরনের হাইপারসনিক শব্দ করে। সেই শব্দের প্রতিধ্বনি শুনে বাদুরের মত পদ্ধতিতে চলে। আরেকদল বিজ্ঞানীর ধারনা পানিতে কট কট জাতিয় শব্দ করে এরা পানির মধ্যেই একধরনের কম্পন করে। ১জোরা ফিন থাকে এবং এরা একধরনের গন্ধ জাতীয় তেল নিঃস্বরন করে মাছদের আকর্ষন করে এবং শিকার করে। বাংলাদেশের অনেক জায়গার লোকেরা এই মাছ শিকারের লোভে শুশুক হত্যা করে এই তেল সংগ্রহ করে। স্ত্রী শুশুক আকৃতিতে বড় (এভারেজে 2.4-2.6m) এবং পুরুষ শুশুক 2-2.2m হয়ে থাকে। শুশুক সারাবছর ব্রিড করে এবং স্ত্রী শুশুক ১১ মাস গর্ভ ধারন করে (আজকে ন্যাশনাল ডিসকভারীতে দেখা প্রোগ্রাম অনুযায়ী)

আমাদের ঢাকার আশে পাশে বছর খানেক আগেও প্রচুর শুশুক দেখা যেত। গত বছর আগে পল্লবীর পিছে বেড়ি বাধে প্রতিদিন অসংখ্য শুশুক দেখেছিলাম, এখন কি অবস্থা জানিনা। দু বছর আগে রায়ের বাজার বধ্যভুমীর পিছে বছিলার সামনের নদীতে অনেক শুশুক দেখেছিলাম। এবছর এ নদীটারই অস্তীত্ব নেই। সরকার একটা বিশাল রাস্তা বানিয়েছে বছিলা পর্যন্ত নদীর মাঝ বরাবর, তাই স্রোত না থাকায় নদীটাই মরে গেছে। জায়গাটুকু কয়েকটা হাউজিং সোসাইটি ভাগা ভাগি করে নিয়েছে সাথে সাথে। বছিলা নদীটার অবস্থাও করুন। একটা বিশাল সেতুর কাজ চলছে। গত সপ্তাহে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়েছিলাম। কেরানীগঞ্জ থেকে নৌকায় সোয়ারীঘাট আসার পথে কয়েকটা শুশুক দেখলাম। নদীর অবস্থা করুন। তেল, ময়লা ভাসছে, পানির রঙ পিচ্ছিল কালো। শুশুক দম নেয় বাতাস থেকে পানিতে নয় তাই বেঁচে আছে, কিন্তু এখানে মাছ থাকে না, খাবে কি? এছাড়া বাংলাদেশে জেলেদের একটা বিশাল অংশ অজ্ঞাত কারনে জালে শুশুক আটকালে সেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। দক্ষিন বঙ্গের অনেক জেলেরাই শুশুক মেরে শুশুকের তেল দিয়ে মাছ ধরে। কিন্তু বিশাল অংশ কুসংস্কার থেকে শুশুক পিটিয়ে মেরে ফেলে। অথচ IUCN এর রেড লিস্টেড থ্রেটেন স্পিসিজের তালিকায় শুশুক আছে। এছাড়া গঙ্গা অববাহিকার নদীগুলোর ক্রমশ সঙ্কোচন তো আছেই।
দেয় ডুব টুপ টুপ ঘোমটার বৌটি দেয় ডুব টুপ টুপ দেয় পান কৌড়ী। পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, বলাকা আমাদের বাংলা কবি সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষন করলেও চমতকার এই ডলফিনটার অবস্থান বাংলা সাহিত্যে গল্প কবিতায় খুব কম। শুধুমাত্র মুহম্মদ জাফর ইকবাল একটা আটকে পড়া শুশুক আর এক গ্রাম্য বালিকার বন্ধুত্ব নিয়ে চমতকার একটা বই লিখেছিলেন। বকুলাপ্পু।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:১৪