আমাদের ড্রাইভারের সাথে দেখি সবার সখ্যতা। কেউবা হাত তুলে কেউবা মাথা নেড়ে কিংবা দুয়েকটা শব্দ ছুড়ে তার তার কুশল জিজ্ঞেস করছে । ড্রাইভারও সহাস্যে প্রতিউত্তর দিচ্ছিল ।
চারপাশটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসতেই দুর থেকে নজরে এল দার্জিলিং শহর । হালকা মেঘের চাদরে ঢাকা। সহস্র বিজলী বাতি এত দুর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সারা পাহাড় জুড়ে পিদিম জ্বলছে । সেও এক অপরুপ দৃশ্য তবে মেকি -প্রকৃতি সৃষ্ট নয় ।
দার্জিলিংয়ে পৌছলাম পৌনে সাতটা নাগাদ। শিলিগুরি থেকে এতটুকু পথ আসতে সময় লেগেছে আড়াইঘন্টার মত।
এস ডি লামা রোডে অবস্থিত আামাদের হোটেল খুজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হলনা। তবে ক্লান্ত শরিরে অনেকটা পথ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে হল।
হোটেলের রিসিপসনে গিয়ে ‘রাজদরবার ’থেকে দেয়া একখানা খাম এগিয়ে ভদ্রলোক হাসি মুখে খাম খানা খুলে ওদের দেয়া চিঠিটার উপর চোখ বুলিয়ে একখানা মোটা রেজিস্ট্রেশন খাতা খুলে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলেন নাম ধাম পাসপোট নাম্বার লিখতে - আর বেয়ারাকে চাবি ধরিয়ে দিয়ে বললেন , আমাদের ব্যাগ নির্দিস্ট রুমে পৌছে দিতে । আমি বাধা দিলাম - এটা নিজেই বয়ে নিব। ব্যাগ দুখানা এমন ভারি নয় যে অন্য কারো সাহায্য লাগবে।
রিসেপসনের ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে ব্যাগ দুখানা ফের কাধে ঝুলিয়ে সিড়ি বেয়ে দোতালায় আমাদের রুমে ঢুকতেই মনটা দারুন ভাল হয়ে গেল। সুপরিসর রুম , মেঝেতে কার্পেট বিছানো -জানালায় সুদৃশ্য ভারি পর্দা। দামী আসবাবে সজ্জিত টিভি ফোন(রুম সার্ভিস, লোকার ও এস টি ডি) তো আছেই । বাথরুমখানাও বেশ বড় পরিচ্ছন্ন । ওরে-ব্বাস তিনশো রুপিতে এতকিছু !
তবে রুমের মধ্যে প্রচন্ড ঠান্ডা যেন জমাট বেধে আছে । ওখান থেকেই বলেছিল রুম হিটার নিতে চাইলে অতিরিক্ত ৪০ রুপি ভাড়া দিতে হবে । প্রথমেই বেশী খরচ করতে মন চাইছিল না সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এখানে এসে যদি দেখি ঠান্ডার প্রকোপে রুমে টেকা দায় তাহলে নিয়ে নিব। এখন মনে হচ্ছে নিতেই হবে।
দেশে একটা ফোন করে আমাদের পৌছানোর খবর জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন। হোটেল রুম থেকে আই এস ডি কল করা সম্ভব নয় - বাইরে যেতে হবে । গরম পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে গরম পোষাক গায়ে গলিয়ে দুজনে ফের বের হলাম।
রিসেপসনে চাবি রাখতে গিয়ে বুড়িমারীতে পরিচিত হওয়া সেই ভদ্রলোক ও তার পরিবারের সাথে দেখা। একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনাদের না সিকিম যাবার কথা?
ভদ্রলোক আমার প্রশ্নে কেন যেন একটু বিব্রত বোধ করলেন। উত্তর দিলেন ওনার স্ত্রী ;‘হ্যা হ্যা যাব। এখান থেকেও তো যাওয়া যায়। আপনারাও এ হোটেলে উঠেছেন? যাক ভালই হল।
আমি হেসে বললাম ,‘ হ্যা তা বেশ তো। দেখা হবে।
তার বছর পাঁচেকের ছোট্ট পুতুলের মত মেয়েটাকে একটুখানি আদর করে বেরিয়ে পরলাম। মনের মধ্যে একটু খানি খটকা লাগল। ওদের তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম দার্জিলিং যাবে কিনা? ওনারা তখন মুখ বেঁকিয়ে বলেছিলেন ‘ওখানে কতবার গিয়েছি। দার্জিলিং দেখার কিচ্ছু নেই!’ তবু কেন এলেন?!!
হোটেলের পাশেই ব্যাক্তি মালিকানায় চালিত ফোন বুথ। দার্জিলিংয়ে এখনো ডিজিটাল ফোন সার্ভিস চালু হয়নি (ওদের ভাষ্য মতে)। এনালগ ফোনে কমপক্ষে দশটা নাম্বারে আধাঘন্টা খানেক চেষ্টা করলাম -লাইন পেলাম না ! শেষ পর্যন্ত বুথের ছেলেটাই আমাদের পরামর্শ দিল পাশের দোকানে যেতে।
ওর কথামত গেলাম ওখানে -সেখানেও একই অবস্থা! তবে দোকান মালিক তার ওখানে যত্ন করে বসতে দিয়ে ডায়াল করার ফাঁঁকে ফাঁকে আমাদের সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। তার জানা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরন করে কখনো কোড নাম্বার চেঞ্জ করে লাইন পাবার চেষ্টা করছিলেন।
অবশেষে ফোন করার চেষ্টা ক্ষান্ত হয়ে বাংলাদেশের দেড়গুন দামে একখানা ফিল্ম কিনে ফিরে আসলাম। ফিল্মের সাথে অবশ্য একজোড়া ব্যাটারি ফ্রি ছিল।
হোটেলের রিসেপসনে এসে একটা রুম হিটার চাইলাম। ভাড়া কত জানতে চাইলে বলল -একশ’রুপি!
- কি বলেন? তবে যে ওরা বলল চল্লিশ?
প্রতিউত্তরে ম্যানেজার বলল,তারা নাকি জানে না ভুল বলেছে!’ আসলে এটা ডাহা মিথ্যে কথা। ঠান্ডা একটু বেশী পড়লে হিটারের চাহিদা বেড়ে যায়, আর সেই সুযোগে এরা অতিরিক্ত টু-পাইস কামিয়ে নেয়।
রুমের মধ্যে যে ঠান্ডা অনুভব করেছি তাতে রুম হিটার ছাড়া চলবে না। অনুরোধ করলাম ভাড়া কমাতে - অবশেষে আশি রুপিতে রাজি হল ।
রুমে ঢুকে টিভি ছেড়ে দিলাম। চ্যানেল চেঞ্জ করতে গিয়ে রিমোট খুজে পাইনা। সবখানে খোঁজা শেষে ম্যানেজারকে ফোন করলাম। তিনি জানালেন ‘বোর্ডার রিমোট চাইলে তবেই দেয়া হয়। তিনি এখন পাঠিয়ে দিচ্ছে কিন্তু যাবার সময়ে যেন কাউন্টারে ফের বুঝিয়ে দেই।'
বুঝলাম যাতে চুরি না যায় সেজন্য এ সতর্কতা! এ-মানের হোটেলে থেকে এসব জিনিসও মানুষ চুরি করে!
আলফা’র খবর শুনে মন কিছুটা বিমর্ষ হল। কাল ঈদ।
এর আগেও বহুবার নিজের পরিচিতিজনদের থেকে অনেক দুরে প্রবাসে ঈদ করেছি -তবে বাধ্য হয়ে। এবারই এর ব্যতিক্রম, ইচ্ছে করে এলাম সবাইকে ছেড়ে।
বন্ধুরা না জানি কাল কত মজা করবে? আর আমরা এখানে বিরস নিরস দিন কাটাব!
মাহমুদ বাইরে গেছে সাবান স্যাম্পু আর লোশন কিনতে -এখুনিই হয়তো ফিরে আসবে। আমি এই ফাঁকে বাথরুমে গেলাম গোসল সারতে। ইষ-দুষ্ণ পানি গায়ে পরতেই সারা শরির চিন চিন করে উঠল । বেশ লাগছিল । ভেবেছিলাম অনেক সময় নিয়ে গোসল করব। কিন্তু বিধি বাম- মিনিট পাঁচেক পরেই গরম পানির স্টক ফুরিয়ে গিয়ে ঠান্ডা পানির ধার এসে সুচের মত বিধতে লাগল। দেয়াল জুড়ে যতগুলো নব ছিল সব ঘুরিয়েও একফোঁটা গরম পানির দেখা পেলাম না! কি সমস্যা এখনো সাবান স্যাম্পু কিছুই গায়ে মাখিনি।
মাথার চুলগুলো ধুলো বলিতে জটা ধরে গেছে। আর সারা গায়ে পাতলা ময়লার আস্তরন -সাবান ছাড়া যাবেনা। অগত্যা টাওয়েল পরে ভেজা শরিরে হিঁ হিঁ করে কাঁপতে কাঁপতে মাহমুদের জন্য অপেক্ষা। ভাগ্য ভাল ও খানিক বাদেই ফিরে এল। সে আসতেই আমি সংক্ষেপে আমার অবস্থা বর্ণনা করে রুম সার্ভিসে খবর দিতে বললাম ।
রুম বয় আসতেই রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বললাম ‘ কি ব্যাপার গরম পানি নেই কেন?
সে বাথরুমে ঢুকে পানির কল সবগুরো নেড়ে চেড়ে বলল ‘ গিজারের গরম পানির স্টক খতম হয়ে গেছে। আভি ইন্তেজার কারনা পড়েগা ।
‘কি...?কতক্ষন ?
‘আধাঘন্টা থেকে একঘন্টা।
বলেকি অ্যা! ‘এ-তক্ষন কি আমি ভেজা শরিরে অপেক্ষা করব?
সে আমাকে শান্তনা দিয়ে বলল,‘ দেখি আপনার নাহনেকি লিয়ে গরম পানির বন্দোবস্ত করছি।’.সে বাংলা ভাল জানেনা - সেজন্য বাংলা হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছিল।
আমিও তেমন করে বলি,‘ঠিক হ্যায়...ইন্তেজার করি।'
খানিক বাদে দু-বালতি গরম পানি এনে দিলে -বহু সময় লাগিয়ে ইচ্ছেমত গোসল করলাম। এরপর থেকে অবশ্য গোসলের সময় আগে থেকেই বালতি ভরে গরম পানি এনে রাখতাম।
গোসল সেরে ফের রুম সার্ভিসে ফোন করে বললাম কাউকে পাঠাতে খাবার অর্ডার দিব। রুম বয় আসতেই জিজ্ঞেস করলাম,এখানে ব্রান্ডি পাওয়া যাবে?
সে বিষন্ন মুখে বলল,‘না সাহাব -আভি বার বন্ধ হয়ে গেছে । একটু আগে বললে হত -বাহারসে আনা পড়েগা।
‘তুমি আনতে পারবে?
‘আমি একজন লোককে পাঠিয়ে দিচ্ছি । ও ম্যানেজ করে দেবে।’ এখন কি খাবার অর্ডার দিবেন?’
মেন্যু দেখে দেখে খাবার অর্ডার দিলাম । দামটা একটু বেশী । এক কাপ কালো চা বার রুপি ! অবশ্য বাইরের থেকে আবাসিক হোটেলের দামটা একটু বেশীই হয়। প্রথমে একটা চিকেন রাইস আর রুটি আলুর দম আনতে বললাম।
সে বেরিয়ে যাবার কিছু পরেই দরজা নক করার শব্দ হল ।
-কে? খোলাই আছে। ভিতরে আসতে পারেন।
দরজা ঠেলে ইউনিফর্ম বিহীন চতুর চেহারার একটা ছেলে ঢুকল। যেন তাকে একটা ভীষন বিপদে ফেলে দিয়েছি চেহারায় এমন একটা ভাব ফুটিয়ে বলল,‘আপনাদের কোন ড্রিঙ্ক লাগবে?
‘ব্রান্ডি পাওয়া যাবে ?
‘পাওয়া যাবে তবে অনেক দুর থেকে আনতে হবে । দাম একটু বেশী পড়বে।
‘কত বেশী?
‘এই ধরেন পচিশ- ত্রিশ রুপি।
‘সমস্যা নেই। বোতলের দাম কত?
‘পয়েন্ট সেভেন ফাইভ লিটার দু’শ পঁচিশ থেকে চল্লিশ রুপি ।
টাকা বের করে তার হাতে দিতেই সে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল । ড্রিঙ্ক করার কোন ইচ্ছেই ছিলনা । শুনেছি প্রচন্ড ক্লান্তিতে ব্রান্ডি নাকি টনিকের কাজ করে । দু পেগ পেটে গেলেই মুহুর্তে ক্লান্তি উধাও ! সর্দি কাশী গা ব্যাথা হালকা জ্বরে ম্যাজিকের মত কাজ দেয় । কোথাও কেটে ছড়ে গেলে , মচকে গেলে কিংবা ঠান্ডায় জমে গেলে ব্রান্ডিকে ওষুধের বিকল্প হিসেবে ব্যাবহার করা যায়। পর্বত আরোহী কিংবা মেরু যাত্রীরা 'অতিরিক্ত শক্তির' জন্য চায়ের সাথে ব্রান্ডি মিশিয়ে খায় ।
ব্রান্ডি মুলত তৈরি হয় আঙ্গুর ফার্মেন্টেড করে (পচানো কিংবা গাজানো) বানানো ওয়াইনকে বক যন্ত্র দিয়ে পাতন বা চোলাই করে । ব্রান্ডি শব্দটা এসেছে ব্রান্ড বা পোড়ানো থেকে। পরে জেনেছি ভারতীয় ব্রান্ডিতে সেই মুল উপাদান ওয়াইন একফোটাও থাকেনা। এত থাকে ডাইলুটেড অ্যালকোহল(মিশ্রিত অ্যালকোহল) ও ব্রান্ডির সিনথেটিক সেন্ট। এ পানীয় শরিরের জন্য বেশ ক্ষতিকর!
প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিলাম -কিন্তু খাবারের চেহারা দেখেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ।আন্দাজ করতে পারলাম এ খাবার সুস্বাদু হবে না। রুটিগুলো আধা পোড়া শক্ত,লালচে আলু দম যেন মুখ বেকিয়ে ঝোলের মধ্যে গা ডুবিয়ে আছে। চিকেন বিরিয়ানীও তথৈবচ।
বিস্বাদ এ খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে কোনমতে গলা দিয়ে নামানো। রুম বয় ফের আসতে ওকে ইচ্ছেমত ঝাড়লাম এমন বাজে খাবারের জন্য। ও বেচারা মুখ কাচুমাচু করে বলল, তাদের মুল সেফ নাকি ছুটিতে গেছে। নতুন বাবুর্চি নাকি ততটা অভিজ্ঞ নয়। কাল থেকে নাকি সে আমাদের দিকে স্পেশাল নজর দিবে।
ওর বিষণ চেহারা দেখে আমার খারাপই লাগল। বেশী ঝাড়ার জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হলাম।
একটু শান্ত হয়ে ওকে ফের একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়ে আসতে বললাম ব্রান্ডি দিয়ে খাবার জন্য।
ততক্ষনে অরিন্দম ব্রান্ডি নিয়ে হাজির । টাকা নাকি কম লেগেছে ! বাড়তি টাকা ফেরৎ দিতে চাইলে আমি তাকে রেখে দিতে বললাম । টাকাটা পকেটে রেখে ও ফিরে যেতে কেন যেন ইতস্তত করছিল । আমি ওক অফার করলাম ব্রান্ডি খেতে । সে মনে হয় এইটেই চাচ্ছিল ,‘ উৎফুল্ল চিত্তে বলল একটু পরেই এসে খেয়ে যাবে।’
ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের অবস্থাও ভয়াবহ! একেকটা আলু লম্বালম্বি মাত্র চার খন্ড করে লবন মেখে কোন মতে তেলে ভেজে দেয়া। ভিতরটা এখনও কাচা। বাইরের চেহারা শতবর্ষী বুড়োর ত্বকের মত।
খাবার শেষে দু-পেগ কোন মতে গিলে টিভি ছেড়ে শুয়ে পড়লাম। যাযাবরের সেই বিখ্যাত চরিত্র ‘আধারকারের’ মত বলতে হয় -এই জঘন্য জিনিস যে মানুষ কেন খায়’? ব্রান্ডি না ক্লান্তি কার অনুগ্রহ জানিনা কিন্তু সে রাতে ঘুম হয়েছিল ভাল।
-তৃতিয় পর্ব শেষ।
রাতের দার্জিলিং ছবিটি - সংগ্রহিত।
প্রথম পর্বের জন্য: Click This Link
পরের পর্বের জন্য: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:০৬