সাল ১৯৯২। আমি তখন মাস দুয়েকের জন্য মস্কোতে এসেছিলাম। উঠেছিলাম মাঝারী সারির আরিয়েখাবা হোটেলে। হোটেল না বলে ওটাকে হোস্টেল বলাই শ্রেয়!
কেন বলছি;
মস্কোতে প্রতি সপ্তাহে প্রচুর বাঙ্গালী আসছে তখন।
কম্যুনিজমের খোলস থেকে বেরিয়ে আসা যেন পুনর্জন্ম লাভকারী রাশিয়ায় শুধু বাংলাদেশ নয়-বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই তখন ছাত্র আসছে। তবে তাদের সবারই মুল লক্ষ্য ছিল মুলত রাশিয়ার প্রান কেন্দ্র মস্কো।
মস্কো নগরী তখন সারা বিশ্বে নানা রঙের নানা জাতির পদভারে মুখর! যদিও প্রায় সবাই আসছিল স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে কিন্তু তন্মধ্যে অতি অল্প সংখ্যকই সত্যিকারে পড়ালেখার উদ্দেশ্য নিয়ে আসত। বেশীরভাগেরই ধান্দা ছিল যে কোন উপায়ে ইউরোপের অন্য কোন দেশে মুলত ইতালী বা জার্মানিতে পাড়ি জমানোর।
বিশেষত যারা ছিল আমাদের মত দরিদ্র দেশের। কলেজ ইউনিভার্সিটি গুলো বিদেশী ছাত্রদের ভর্তির ব্যাপারে প্রথমে প্রচুর আগ্রহ দেখালেও একসময় তাদের আগ্রহে ভাটা পরল। তার কারন প্রথমত তাদের হোস্টেলগুলোতে এত ছাত্রের থাকার সংস্থান ছিল না।
দ্বীতিয়ত ভাষাগত সমস্যা; অধিকাংশ ছাত্রই নিজেদের ভাষা ছাড়াও অন্তত মোটামুটি কাজ চালানোর ইংরেজী জানত। তারা মুলত ভাব বিনিময়ের জন্য এই ভাষার উপর ভর করেই ভিনদেশে এসেছে। কিন্তু তখন সমগ্র রাশিয়াতে ইংরেজী জানা লোকের সংখ্য ছিল নেহায়েত নগন্য। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এর ব্যাতিক্রম নয়। ফলে তারা হিমসিম খাচ্ছিল নবাগত ছাত্রদের পড়াতে ।
তৃতিয়ত কারন যেটা সেটা আমাদের জন্য অবশ্যই লজ্জাজনক। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র বিশেষত যারা বাংলাদেশ, পাকিস্থান, –ভারত,শ্রীরঙ্কা ,ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া থেকে এসেছিল তারা প্রধানত আদম ব্যাপারীর খপ্পরে পড়ে বাধ্য হয়েছিল নকল সার্টিফিকেট করাতে। সেটা যখন প্রকাশ পেল তখন রাশিয়ার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বিদেশী ছাত্র ভর্তি করতে অনীহা প্রকাশ করল।
স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যারা এসেছে তাদের প্রত্যেকেরই ভিসার মেয়াদ ছিল মাত্র ১৫ থেকে ৩০ দিন।
মস্কো এসে থিতু হতে হতে এর সিংহ ভাগ সময় ফুরিয়ে গেল। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর তখন একমাত্র উপায় ছিল কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া।
সদ্য আগত ছাত্র অছাত্র সবাই মরিয়া হয়ে উঠল যে কোন উপায়ে ভর্তি হওয়ার জন্য। অনেকেই মস্কো ছেড়ে ছুটল অন্যান্য শহরে বা গ্রামে। তবে যাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধূমাত্র সুযোগ বুঝে অন্য দেশে পাড়ি জমানোর তারা সহজে মস্কো ছেড়ে নড়তে চাইল না।
আর এই সুযোগে মস্কোতে কিছু ভুয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠল।
অতিরিক্ত টাকা উপার্জনের আশায় মস্কো সহ অন্যান্য শহরের ইন্সটিটিউটগুলো তাদের ধারন ক্ষমতার থেকে অনেক বেশী ছাত্র ভর্তি করতে শুরু করল। আমার বিশ্বাস ভুয়া প্রতিষ্ঠান নির্মান ও অতিরিক্ত ছাত্র ভর্তির প্লানটা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু ব্যবসায়ী ও পুরোনো ছাত্রের।
তবে এসব প্রতিষ্ঠানে যারা ভর্তি হল তাদের কাছ থেকে সুকৌশলে অঙ্গিকার নামা করিয়ে নিল যে তারা শুধূমাত্র ভিসা পাবে কিন্তু তাদের থাকার কোন সংস্থান কতৃপক্ষ করতে পারবে না। তাছাড়া তাদের ক্লাসে ঢোকার অধিকারও থাকবে না।
ভিসার ব্যাবস্থা হওয়াতেই অনেকে খুশি হল। সেসব তথাকথিত ছাত্ররা যারা অন্য কোথাও থাকার ব্যাবস্থা করতে পারেনি তারা কেউ কেউ একা অথবা দলবদ্ধ ভাবে বাসা বাড়া করে থাকতে লাগল।
বাসা ভাড়া দিয়ে যে টাকা আয় করা সম্ভব, রাশানরা এর আগে জানতকিনা আমি সন্দিহান! ডলারের বিপরীতে রুবলের মুল্যমান অনেক কম হওয়ায় বিদেশীদের কাছে সে ভাড়া নেহায়েৎ নগন্যই মনে হল।
অবশিষ্ট যারা ভাল বাসা খূজে পেল না বা খোজার ব্যাপারে কোন আগ্রহই দেখাল না (অনেক ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা বিদেশী আতংক ও বাড়ি মালিকের পূর্ব পরিচিতের রেফারেন্স না দিতে পারার জন্য তারা বঞ্চিত হল)তারা আশ্রয় নিল এসব মাঝারী মানের হোটেলে মাসিক চুক্তিতে। এইসব ভাড়াটেদের বেশীর ভাগই ছিল একটু সৌখিন সেই সঙ্গে আলসে টাইপের।
আদম ব্যাপারীরাও তাদের ক্লায়েন্টদের থাকার জন্য এসব হোটেল রুম ভাড়া করত! বিনিময়ে দেশ থেকে আসা নিরিহ সরল ও অল্প শিক্ষিত(বেশীর ভাগ)লোকদের কাছ থেকে ভাড়ার কয়েকগুন টাকা উসুল করে নিত।
আমি যে হোটেলে ছিলাম সেখানে শিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত ছাত্র ব্যাবসায়ী আদম মিলিয়েপ্রায় শ’খানেক বাঙ্গালী ছিল। হোটেলের দুটো ফ্লোরের বেশীরভাগ জুড়ে ছিল তাদের বাস। বাকি ফ্লোর গুলোর অধিকাংশ বোর্ডারই ছিল জর্জিয়া, তাজাকস্থান, আর্মেনিয়ান ও আজেরবাইজানের।
তন্মধ্যে তাজাকরাই ছিল সবচেয়ে ভদ্য ও নম্র। আজেরবাইজানীদের বেশীর ভাগই মুসলমান সম্প্রদায়ের। মুখে ধর্মের প্রতি প্রচুর অনুরাগ দেখালেও তারা তাদের ধর্ম সন্মন্ধে প্রায় অজ্ঞই ছিল। প্রকৃতিতে ছিল তারা চরম উগ্র।
আজেরবাইজানী ছেলে যাদের সাথে আমার তাদের দেশের মানে, আজারবাইজানের বাইরে পরিচয় হয়েছে তারা বেশীর ভাগই ছিল উগ্র ও অসভ্য। রাশান মেয়েরা আজেরবাইজানী-দের প্রচন্ড ভয় পেত সেইসঙ্গে ঘৃনাও করত।
আমাদেরকে তারা তাদের সাথে মিশতে নিষেধ করত। আমরাও যথাসম্ভব ওদের কে এড়িয়ে চলতাম, তবে তারা কেন যেন আমাদের সাথে বিশেষ করে বাঙ্গালীদের সাথে গায়ে পড়ে মিশতে চাইত ও খুব ভাল ব্যাবহার করত। উপেক্ষা করতে চাইলেও একসময় ভয়ে অথবা তাদের আন্তরিকতায় মিশতে বাধ্য হতাম।
রাশিয়াতে(বিশেষত;মস্কোতে) অন্যান্য প্রদেশের লোকের মধ্যে ইউক্রাইন ও আজারবাইজানী ছিল সংখ্যাধিক তবে রাশানদের মাঝে ইউক্রাইনীদের চেনা একটু মুশকিল হত। আজেরবাইজানীদের সহজেই চেনা যেত।
তাদের চেহারা ছিল আফগাণী বা ইরাকীদের মত। তবে পথে ঘাটে প্রচুর আজারবাইজানী পুরুষ লক্ষ্য করা গেলেও নারীদের সংখ্যা ছিল নগন্য প্রায় শুন্যের কোঠায়। এর কারন হয়ত, ধর্ম সন্মন্ধে তাদের জ্ঞান যত সীমিতই হোকনা কেন মেয়েদেরকে ইসলাম ধর্মের কড়া অনুশাসন মেনে চলতে হত।
আজারবাইজানী ছেলেরা ভাগ্যন্বেশনে,পড়ালেখা বা ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে মস্কো বা রাশিয়ার অন্য শহরে আসতো তারা বেশীরভাগই অবস্থান করত ছোট খাট হোটেল বা হোস্টেলে। মেয়েদের হয়তো পুরুষদের কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে দেয়া হত না সেইসঙ্গে আবাসন সমস্যার জন্য তাদের কে আসতে দেয়া হত না।
আজারবাইজানীদের সাথে একটু মেলামেশা করে উপলদ্ধি করলাম এরা বাইরে যতই উগ্র বা অসভ্য হোকনা কেন মনটা খুব ভাল ,উদার ও সাহসী, কিন্তু কথাবলার সময় যেকোন শব্দ শুরু বা শেষ করত গালি দিয়ে -যদিও রুশ ভাষায় এদের জড়তা ছিল স্পষ্ট। ওদের কথা শুনে ধারনা হয়, কোন আজারবাইজানী রুশ ভাষা শেখার শুরুতেই বাজে শব্দগুলো আত্মস্ত করত। রাশান মেয়েদের সন্মন্ধে খুব বিশ্রী (আদি রসাত্মক )মন্তব্য করে মজা পেত। রুশ মেয়েদেরকে তারা সেক্স ডল ছাড়া আর কিছু ভাবত না। আমাদেরকে উপদেশ দিত তাদের সাথে যেন দৈহিক সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক না করি।
এরা কেন যেন রাশানদের প্রচন্ড ঘৃনা করত আর তাদের যত ক্ষোভ ছিল রুশ মেয়েদের প্রতি। নির্জন রাস্তায় একাকী কোন রুশ মেয়েদের দেখলে তাদের উদ্দেশ্যে খারাপ উক্তি বা বিশ্রী অঙ্গ ভঙ্গী করত। রুশ ছেলেরাও তাদের বিশেষ ঘাটাত না। তবে সব আজারবাইজানীই যে খারাপ তা নয়, কেউ কেউ তাদের ঘৃনা করলেও বাইরে প্রকাশ করত না।
দ্বীতিয় পর্ব-
পরিচিত আজারবাইজানীরা আমাদের সন্মোধন করত ’জিমলিয়া’ বলে। তাদের ভাষায় এর অর্থ ‘মাটির বন্ধু’। এ নামে ডাকার কারন ছিল প্রথমত মুসলমান দ্বিতিয়ত, এশিয়ার অধিবাসী বলে। তাছাড়া ভারতীয়দের এরা খুব সহজ সরল ও ভালমানুষ হিসেবে জানত। মনে করত এদের সাথে সহজেই হৃদ্যতার সর্ম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। আমাদের জটিল মন ও কুটিলতা সন্মন্ধে শুরুতে যে তারা অবগত ছিল না বলাই বাহুল্য। বিশাল দেহী আজারবাইজানী যখন ’জিমলিয়া’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরত তখন দারুন অস্বস্থি হত। বিশেষত; তাদের গায়ের বোটকা গন্ধ ও শারীরিক আকৃতির জন্য।
তাদের বাহুর মধ্যের্ নিজেদেরকে প্রচন্ড কৃশকায় ও ক্ষুদ্র মনে হত। অনেক ক্ষেত্রেই আবেগের অতিশয্যে এমন জোড়ে চাপ দিত যে দম বন্ধ হয়ে যেত ছাড়া পাওয়ার জন্য হাঁসফাস করতাম। আবার অনেকে এটা বুঝতে পেরে চাপটা দীর্ঘস্থায়ী করত।আমাদের অসহায় অবস্থা দেখে তারা দারুন মজা পেত। মনে মনে প্রচন্ড রাগ হলেও তাদের অনন্দ উপভোগ করতে দিতাম। ক্লিস্ট চেহারায় আমরাও হাসতাম।
আমি যে হোটেলে উঠেছিলাম সেটা আমার পুর্ব পরিচিত। এর আগে এখানে এসেছিলাম কিন্তু দু-চার দিনের বেশী থাকা হয়নি। আর সেকারনেই এখানকার অন্যান্য বাঙ্গালী বাসিন্দাদের সাথে প্রাথমিক পরিচয় হয়েছে বা সামান্য সময়ের জন্য গল্প গুজব করেছি কিন্তু ঘনিষ্টতার সুযোগ পাইনি ।
এখানে হোটেলের পরিবেশ ও সেখানে অবস্থান রত বোর্ডারদের সন্মন্ধে একটু ধারনা দেয়া প্রয়োজন;
হোটেলটাতে যেসব বাঙ্গালী ছাত্রের(!)বাস ছিল বেশীর ভাগেরই মুল উদ্দেশ্য ছিল অন্য সবার মত পড়ালেখা নয় কৌশলে অন্য দেশে পাড়ি জমানো। কলেজের অধ্যাপক থেকে শুরু করে অর্ধশিক্ষিত গ্রামের কৃষক পর্যন্ত সবাই ছিল।শিক্ষিত অশিক্ষিত যুবক মধ্য বয়সী ,ভিন্ন রুচি ও ভিন্ন পরিবেশের মানুষগুলি মিলেমিশে নিজেদের অজান্তেই গড়ে তুলেছিল একটি ‘ছোট বাংলাদেশ’।
মন খারাপ করা সকাল,একঘেয়ে দুপুর আর উচ্ছল রাতগুলো খেলা গপ্পো স্বুস্বাদু কিংবা বিস্বাদ খাবারে ভুরিভোজন আড্ডা আর প্রতিদিন নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দেয়া আদমদের নিয়ে দিন গুলো কাটছিল বেশ।
একরাতে মামুনের রুম থেকে আড্ডাবাজী শেষে আমার ঘুম চোখে আমার রুমের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাড়িয়ে গেলাম করিডোরের অল্প আলোয় দশাসই ফিগারের তিন আজারবাইজানীকে নিঃশব্দে দাড়িয়ে থাকতে দেখে।এতরাতে এদেরতো এখানে থাকার কথা না। একটু ভয় হয়; কোন কু- মতলবে এভাবে দাড়িয়ে কে জানে?
তবুও নিজেদের হোস্টেল বলে সাহসে ভর করে ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম নিজের রুমের দিকে।
বিছানায় শুতেই চোখ থেকে ঘুম উধাও। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমায়। অনেক রাত পর্যন্ত কানে এল ওদের ফিসফিসে কথা বার্তার শব্দ। অনেক চেষ্টায়ও অবশ্য একবর্ণ বুঝতে পারিনি।...ক্রমশ
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১২:২৪