মীজান রহমান: সময় যার কাছে ঋণী
শওগাত আলী সাগর
‘মুষলধারে তুষার পড়ছে’- ব্যাকরণের দৃষ্টিতে কথাটা সঠিক হবে কী না তা নিয়ে আমার নিজেরও সংশয় আছে। এই মুহূর্তে অবশ্য এর বাইরে কোনো উপমা মাথায় আসছে না। পুরো ডিসেম্বর মাসটা জুড়েই সকাল-সন্ধ্যা বরফে ঢেকে থাকা প্রকৃতি, ক্রিসেন্ট টাউন থেকে বের হয়ে ডেনটনিয়া পার্ককে হাতের বাঁয়ে রেখে ড্যানফোর্থে হেঁটে যাওয়ার পুরোটা সময়ই বুকের ভেতর কেমন একটা হাহাকার টের পাই। সাত সমুদ্র আর তেরো নদীর অপর পাড়ের ভিন্ন সংস্কৃতি একটা দেশে একজন নবাগতের জন্যে পরিবেশটা যে কতোটা ভয়াবহ তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো বুঝে ওঠা কঠিন।
বুকের উথাল-পাতাল নদ ভাঙার সেই সময়টায় ‘অন্যমেলা’র মতো এক চিলতে জানালা না পেলে নির্ঘাৎ দম আটকে মারা যাবার উপক্রম হতো। হ্যাঁ, ড্যানফোর্থে তখন পর্যন্ত একমাত্র বাংলা বইয়ের দোকানটি নতুন আসা একজন অভিবাসীকে কতোটা যে মানসিক শক্তি যুগিয়েছে তার বিবরণ দিতে গেলে অনেক দীর্ঘ ফিরিস্তি লিখতে হবে । তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা নানা নামের নানা স্বাদের বইগুলো কখন যে নীরব ভালবাসা হয়ে উঠেছে টের পাইনি। ভালবাসা বলবো কেন, বরং বলি বইগুলো হয়ে উঠেছিলো নির্ভর করার মতো এক অবলম্বন।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বইগুলোর তাকিয়ে থাকা, এটা সেটা নিয়ে নাড়চাড়া করা, হঠাৎ কোনো একটা বই নিযে এক কোণায় বসে পড়তে শুরু করে দেওয়া...ভাগ্যিস অন্যমেলার কর্ণধার সাদী আহমদ তাতে আপত্তি করেন নি। এপার-বাংলা, ওপার-বাংলার নামীদামী লেখকদের বইগুলোর অনেকগুলোই পরিচিত, বেশ কিছু আগে পড়াও। নতুন অভিবাসী বলেই কী না কে জানে, আমার চোখ উড়ে বেড়ায় কানাডায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি লেখকদের বইগুলোর মলাটের উপর। সাদ কামালী, ইকবাল হাসান, সৈয়দ ইকবাল, আকতার হোসেন, সালমা বাণী, আমি নামগুলো পড়ি, মলাট খুলে লেখকদের আদ্যোপান্ত বিবরণ পড়ি বইয়ের ভেতর সাঁতার দেওয়ার চেষ্টা করি, আর ভাবি- বাহ, প্রবাসে থেকেও এঁরা বাংলা সাহিত্যের মূলধারার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পেরেছেন। আস্তে আস্তে এঁদের অনেকের সঙ্গে পরিচয়ও হয়ে যায়।
মীজান রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে সেখানেই। না, লেখকের সঙ্গে নয়, তাঁর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে । দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, কিংবা সাহিত্য পত্রিকায় উপরে উল্লেখিত অনেকের লেখার সঙ্গে আগে পরিচয় ঘটলেও মীজান রহমানের লেখার সঙ্গে এই প্রথম সাক্ষাৎ। অন্য কিছু নয়, একজন প্রবাসী লেখক—কেবলমাত্র এইটুকু ভাবনায় তাড়িত হয়ে তাক থেকে মীজান রহমানকে টেনে নেই। আশ্চর্য ! সেই যে অন্যমেলার তাক থেকে মীজান রহমানকে নামালাম, তাঁকে আর ছাড়তে পারলাম না। শব্দ চয়নে আধুনিকতা, বাক্য গঠনের ভিন্নতাতো বটেই, জীবনকে ভিন্নচোখে দেখার অপরসীম এক ক্ষমতা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে ধরে রাখে। অন্যমেলার এক কোনায় বসে আমি মীজান রহমানের সঙ্গে নিবিড় এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি।
মীজান রহমানকে পড়তে পড়তে মনের ভেতর নানারকমের প্রশ্ন তৈরি হতে থাকে। ভদ্রলোক গণিতের অধ্যাপক, বাংলাদেশ থেকে বৃত্তি নিয়ে বিলেতের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে কানাডার মতো একটি পশ্চিমা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গণিত পড়াতে শুরু করলেন। শিক্ষাগত সার্টিফিকেটের পরিধি, বয়সের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ব্যবচ্ছেদ করে তার সম্পর্কে সহজ যে উপসংহারটি টানা যেতো সেটি কেমন জানি মিলতে চায় না কিছুতেই। এই লোকটির দৃষ্টিভঙ্গি এতোটা আধুনিক হলো কিভাবে? বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি, মেঘনার পলিমাটি আর গ্রামের কিশোরী মেয়ের প্রাণচাঞ্চল্য তাঁর কলমে এতোটা প্রাণোচ্ছল ভাষা পায় কি করে ? তাঁর তো লেখার কথা ভারী ভারী ইংরেজী শব্দে গণিতের, বিজ্ঞানের জটিল সব তত্ত্বকথা। কিন্তু তার বদলে তাঁর কলমে কী না জীবনের কথা, মানবতা আর ভালোবাসার জয়গান! মীজান রহমানকে পড়ি আর মুগ্ধ হই, কখনো সুযোগ হলে তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার দুর্নিবার লোভটাকে বুকের ভেতর, মনের ভেতর চাপা দিয়ে রাখি।
ততোদিনে জানা হয়ে গেছে, মীজান রহমান উত্তর আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয় নাম। হওয়ারই কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এই লোকটি সম্পর্কে তেমন একটা জানার সুযোগ হলো না কেন ? হতে পারে সেটি আমার পড়ার সীমাবদ্ধতার কারনেই হয়তোবা । টের পাই, মীজান রহমান দেদার লিখছেন পত্রপত্রিকায়ও । সেগুলো মূলত: উত্তর আমেরিকার নানা পত্র-পত্রিকায়ই । লেখকমাত্রই ঢাকার স্বীকৃতি পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেন। মীজান রহমান কি সেখানে বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম? ভাবি, কখনো সাক্ষাতের সুযোগ হলে প্রশ্নটা তাকেই করবো।
মীজান রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগটা হতে অবশ্য অনেকটা বছরই অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। কানাডার রাজধানী শহর অটোয়ায় তার বাস, টরন্টোতে যে তিনি আসেননি এতগুলো বছর তাও নয়। নানা অনুষ্ঠানেই অতিথি হয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাতেই যাওয়া হয়নি বলেই তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হয়ে উঠে নি আর। কিন্তু দেখাটা যখন হলো, তখন মনে হলো এটাই বোধ হয় ভালো হয়েছে। মীজান রহমানের মতো মানুষদের সঙ্গে স্বল্প সময়ের সাক্ষাতে অতৃপ্তিই কেবল তৈরি হয়, তৃষ্ণাটা আরো প্রকট হয়। দীর্ঘ সময় ধরে সামনা-সামনি বসে নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, খোলামেলা কথাবার্তা বলার সুযোগটা না পেলে সেই অতৃপ্তিই আমাকে তাড়িত করতো। যার শিক্ষা, জ্ঞান, সামাজিক প্রতিষ্ঠা এতো বিশাল সেই মানুষটাই কী না বিনয়ে এতোট বিনম্র, শিশুর মতো সারল্য যার পুরো প্রকৃতিজুড়ে। ‘ফলভারে নয়ে পড়া বৃক্ষ’ কিংবা ‘অবয়বে ছোটোখাটো মানুষটি ওজনে ভয়াবহ ভারী’ ...এই কথাগুলো তার সম্পর্কে অনেকেই ব্যবহার করেছেন। পোষাকী আলোচনায় মীজান রহমানকে হয়তো বা আরো নানাবিধ অলংকারে সাজানো যায়। কিন্তু মীজান রহমানকে মনে হলো সেগুলো নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। এই যে তাঁর কোনো মাথাব্যাথা নেই এব্যাপারে, এখানেই তিনি অনন্য- অন্য হাজারো ‘প্রচারপ্রিয়’ গুণীজনের বাইরে।
মীজান রহমানের মাথাব্যাথা না থাকলেও সাহিত্যানুরাগীদের মাথাব্যথা হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাঁর পাঠকমাত্রই জানেন, কি অমূল্য সোনার চাষাবাদ করে যাচ্ছেন নির্মোহ এই মানুষটি। সেই সোনার ক্ষেতের অপার্থিব ফসলগুলো কেবলমাত্র ’উত্তর আমেরিকার মানচিত্রে’ বন্দি থাকলে মীজান রহমানের তেমন কোনো ক্ষতিই হয় না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের তাতে যথেষ্টই ক্ষতি হয় বলে আমি মনে করি। মূল্যবান একটি সোনার খনির সন্ধান থেকেও বঞ্চিত থেকে যায় পাঠক সমাজ। আমরা বুঝতে পারি, পুজিঁবাদী সমাজ বাস্তবতায় আপনার ঢোল আপনাকেই বাজাতে হয়। তত্ত্বে নিভৃতচারী মীজান রহমান অভ্যস্থ নন, হওয়া সম্ভবও নয় কখনো। ঢাকার সাহিত্য সম্পাদকদের কাছে ধর্ণা দিয়ে স্বীকৃতি পাওয়ার অশোভন চেষ্টাটা মীজান রহমানকে দিয়ে কখনোই হয়ে উঠবে না। তবু যখন দেখি, কলকাতার দেশ পত্রিকায় এই মীজান রহমানের বই নিয়ে চার পাতা আলোচনা বেরোয়, তখন নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে আহা, ঢাকার কোনো পত্রিকা নয় কেন? ঢাকার মিডিয়া কেন এই সোনার খোঁজ পাচ্ছে না।
মন্ট্রিয়লের সাংবাদিক লেখক সদেরা সুজন তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘মানবচেতনার তীর্থ যাত্রী’ হিসেবে। এই শিরোনামে মীজান রহমানকে নিয়ে সদেরা সুজনের সম্পাদনায় একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট পুঁজির লড়াইয়ে জীবনবোধ কিংবা আদর্শবোধ যেখানে প্রায়শ:ই পরাজিত সৈনিকের মতো পিছু হটে যায়, সেখানে মীজান রহমান মানব চেতনার তীর্থযাত্রী হিসেবেই নিজের কর্তব্য শেষ করেন না, তীর্থ যাত্রার সেই কাফেলাটার নেতৃত্বের আসনেও আসীন হয়ে পড়েন। মীজান রহমান নিজে সেদিকে তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ না করলেও তার পাঠকরা কিন্তু সেই তীর্থ যাত্রায় তার পেছনেই সারিবদ্ধ হতে থাকেন। মানুষ হিসেবে, লেখক হিসেবে অসাধারন শক্তি আর প্রতিভার অধিকারী মীজান রহমানের জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে পেরে মনে হচ্ছে, বোধ হয় প্রজন্মের ঋণ খানিকটা হলেও শোধবার সুযোগ হলো, যদিও জানি প্রজন্মই কেবল নয়, সময় এবং সমাজ মীজান রহমানের কাছে ঋণীই থেকে যাবে। শুভ জন্মদিন মীজান রহমান। আপনাকে অফুরান শুভেচ্ছা।
Click This Link