বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে কতটা রাজনৈতিক সংহিতা বাড়তো বা আরো কত বেশি হতো তা জামাত-শিবির প্রকাশ্যে থাকলে বোঝা যেত। যদিও আমার ব্যাক্তিগত মতামতটি হলো তাদের নিজেদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে না পড়া। আত্মপরিচয় ঠিক রেখে সামনে এগুনো, যত কঠিন পথই হোক তা।
বিএনপিকে বহু এলাকায় সংহিতার শিকার হতে হয়, বহু এমন প্রেস নোট আসে দেখি। কোথাও বিএনপি-কে পরিচয় লুকানোর সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবচেয়ে বেশি ছাত্রলীগ করতে দেখেছি শিবিরকে, যারা আমাদের ছাত্রদলের ছেলেপিলে ধরে ধরে মারতো; পরে নানাভাবে পরিচয় নিশ্চিত করে জেনেছি সে ভেতরে ভেতরে শিবির মূলত নির্ভূলভাবে নিজেকে আওয়ামী লীগ উপস্থাপন করতেই এমন আওয়ামী ভেক ধরেছে। এ নীতি আমার পছন্দ নয়, কোনভাবেই পছন্দ নয়। আমি এমন বহু ছেলেকে বলেছি সুস্পষ্ট করে তোমার এমন আওয়ামী রূপ আমার পছন্দ নয়, তার ভেতর এমন জেদ দেখেছি হয়তো আর সে কখনো সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবনে মানে আত্মপরিচয়ে ফিরে আসবে না।
অনেকে বলে থাকেন, এমন জামাত-শিবির ভালো সময় আসলে সব তার দলে ফিরে যাবে। কিন্তু অবাধ সুবিধায় থেকে একটি ছেলে যে পুরোপুরি বায়োলজিকাল, যার রক্ত-মাংস আছে, লোভ আছে, লালসা আছে, কাম-বাসনা আছে; এবং সে সাহাবীও নয়, সাধারণ মানুষ। সে কিভাবে আরাম-আয়েশের পরিবর্তিত রূপের জীবন ছেড়ে জামাতে যাবে? সিলেট নির্বাচনে তার বাস্তব রূপটি দেখা গিয়েছিলো। কাগজে-কলমে হিসেবে দেখেন অনেক জামাত আছে, শিবির আছে! কিন্তু ভোটে দেখা গেলো দশ হাজার। তাহলে বাকি লোক গেলো কোথায়? আওয়ামী লীগে ছদ্মবেশে? তাহলে সে তো ভোটের মাঠে ছদ্মবেশটি ছাড়েনি।
অনেক সময় অনেক বন্ধুকে দেখেছি পড়েন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু পরিচয় দেয় সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এমন কি ঢাকা কলেজে পড়েও এমন পরিচয় দেয়। এগুলো আত্মপরিচয় সংকট তৈরি করে, মারাত্মক আত্মপরিচয় সংকট তৈরি করে। এমন দ্বৈত আচরণে ব্যাক্তিটি আর নিজের ভেতর থাকে না, সঠিক জায়গায়ও থাকে না, নিজস্ব দার্শনিক জগতেও থাকে না, আর এদের ভেতর তৈরি হয় প্রতিশোধের নেশা। কারণ তার ভেতর তৈরি হয় মারাত্মক রকম অস্তিত্বহীনতা ও হতাশা। তখন মনে করে এ অস্তিত্বহীনতার জন্যে যারা দায়ী তারা নাশ হোক, ধ্বংস হোক। মারাত্মক জিঘাংসা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে, এজন্যেই আওয়ামী লীগের আন্তঃকোন্দল এতটা ভয়াবহ ও প্রকট মানবিক সংকট তৈরি করে।
বিএনপিতে রূপ নেয়া জামাতেও একই কথা প্রযোজ্য।
এবার আসি আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব সংকটের খোঁজে। সরকারে ও প্রশাসনে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত। এটি তাও বিগত ১০/১২ বছরের পূর্বের ঘটনা। একজন মাঠের আওয়ামী কর্মীর প্রভাব প্রায় শূণ্যের কোঠায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যাম্পাসে কিছু দিন ছাত্রলীগ করা, কিছুদিন ফেসবুকে আওয়ামী লীগের ছবি ছাড়া নেতৃবৃন্দ হঠাৎ চাকুরী পাওয়া ব্যাক্তি কিন্তু আওয়ামী লীগ নয়। তারাই এখন আওয়ামী লীগের ধারক ও বাহক৷ মাঠে যারা শ্রম দেয় তারা এখন মোটামুটি ভাবে ডিমোরালাইজড, প্রায় অস্তিত্বহীন। আত্মপরিচয় সংকটের বেড়াজালে তারা হতাশ এবং ব্যাপক ক্ষোভ নিয়ে তারা রাজনীতি বিমুখ।
বাকি থাকলো বাম। মানে রাজনৈতিক প্রগতিশীল জোট আমরা যাদের বলি। এক সময় আদর্শের নিরেট স্তবকে একজন কাঠমোল্লাও বাম-কে তার সততার জন্যে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হতো। মোল্লারা এমন বলতো ঐ ব্যাক্তিটি এত সৎ যদি শুধু ইসলাম ভালো করে মানতো! তাহলে ইসলামের ব্যাপক খেদমত হতো। মানে পরোক্ষভাবে তার ব্যাক্তিক অর্জনকে শ্রদ্ধা করছে এবং অনুভব করছে। বামে আওয়ামী লীগে আত্মীয়করণ হতে হতে এখন আর নাই বললেই চলে। এখন তাদের প্রণোদনা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
পারস্পরিক আওয়ামী লীগে এবং আওয়ামী লীগের এ রূপান্তরে আওয়ামী লীগের কী আত্মপরিচয় সংকট হয়নি? দারুণভাবে হয়েছে। কোথায় জানেন? সবচেয়ে বড় জায়গায়!
সেটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত দীর্ঘ সংগ্রামের আওয়ামী লীগে এখন ভালো সংস্কৃতিক কর্মী তৈরির পথ মোটামুটি বন্ধ। অথচ যেই আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে বাউল সম্রাট আব্দুল করিম গান খেয়েছেন।
শাকুর মজিদ স্যারের "ভাটির পুরুষ" প্রামাণ্যে বাউল করিম নিজে স্বীকার করেছেন এবং গর্ব করে বলেছেন ---
" স্বাধীনতা পদক তো আমি সেদিনই পেয়ে গেছি, যেদিন মওলানা ভাসানী আমার গান শুনে পীঠচাপড়ে বলেছে করিম তুই মানুষের শিল্পী হবি"
নেতাদের প্রতি মানুষের কি ভাবাবেগ ছিলো শুধু অনুভব করুন। সংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগ মোটামুটি দেউলিয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগকে তো বাঁচাতে হবে দেশের স্বার্থেই। কে হাল ধরবে আর কে তাকে পথ দেখাবে? যাদের ভাবা প্রয়োজন তাদের ভাবতে হবে।
আসি বিএনপিতে। আপনি বিএনপিকে খুঁড়িয়ে চলা দল বলতে পারবেন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দূর্বল বলতে পারবেন। অনেক সমস্যা জর্জরিতও বলতে পারবেন। কিন্তু তাকে অস্তিত্ব সংকটে ভোগা বলতে পারবেন না, আত্মপরিচয় সংকট পড়ে যায়নি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেঁচে যাওয়া এ দল। আপনি কোন সংকটেই আর তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ফেলতে পারবেন না। মামলায়, হামলায়,গুমে-খুনে এমন কি দখলে-বেদখলে বিএনপি এক মহীরুহ হয়ে উঠা রাজনৈতিক দল।
বাংলাদেশের স্বার্থে আরো একটি বড় দলকে দাঁড়ানো প্রয়োজন, সেটি যেকোন ফর্মেটেই আওয়ামী লীগ হোক আমরা চাই। কিন্তু সরকারে মিশে যাওয়া এ আওয়ামী লীগের কি হবে? আওয়ামী লীগে মিশে যাওয়া জামাতেরই বা কি হবে?
আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বড় ক্রাইসিস।