চলুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে লেবাননের নির্বাচনে আসন বণ্টন করা হয়। মুলত ধর্ম এবং জাতি বিবেচনায় লেবাননের নির্বাচনে আসন বণ্টন করা হয়। লেবাননের জাতীয় সংসদে মত আসন সংখ্যা ১২৮ টি। এই ১২৮টি আসনের মধ্যে খ্রিষ্টানদের জন্য বরাদ্দ থাকে ৬৪ টি আসন এবং মুসলিমদের জন্য ৬৪টি আসন। লেবাননের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০.৪% খ্রিষ্টান। প্রশ্ন আসতে পারে ৪০% অধিবাসীরা কেন ৫০% আসন পাবে! তবে লেবাননে আসলে গত ৬০ বছরে খ্রিষ্টানদের জনসংখ্যা কমে গিয়েছে। ১৯৩২ এবং ১৯৫৬ সালের জরিপে লেবাননের মোট জনসংখ্যার মধ্যে খ্রিষ্টান ছিল ৫৩-৫৬%। পরবর্তীতে গৃহ যুদ্ধের কারনে তাদের একটি অংশ পালিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
খ্রিষ্টানদের জন্য বরাদ্দকৃত ৬৪ টি আসনের মধ্যে আবার আর্মেনীয় ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১ টি আসন, প্রটেস্টাইন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১ টি আসন, সংখ্যালঘুদের জন্য ১ টি আসন। আর্মেনীয় অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৫ টি আসন, গ্রিক ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৮ টি আসন, গ্রিক অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১৫ টি আসন এবং সর্বচ্চো ৩০ টি আসন বরাদ্দ রয়েছে মারনিতে খ্রিষ্টানদের জন্য।
মুসলিমদের জন্য যে ৬৪ টি আসন রয়েছে সেখানেও ভাগ রয়েছে। দুরুজরা মুসলিম না হলেও তাদের মুসলিমদের ভাগে ফেলা হয়েছে কারন এদের রীতিনীতি অনেকটা মুসলিমদের মতন। দুরুজদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৮ টি আসন, আলাওয়াইতরা শিয়াদের ক্ষুদ্র একটি অংশ হলেও তাদের পৃথক বিবেচনা করা হয় আর তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২টি আসন। বাকি ৫৪টি আসনের ২৭ টি শিয়া মুসলিম এবং ২৭ টি সুন্নি মুসলিমদের জন্য বরাদ্দকরা রয়েছে।
লেবাননের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে হলে কোন দলকে কমপক্ষে ৬৫টি আসন পেতে হয়। আবার সরকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী পদে একজন সুন্নি, স্পিকার পদে একজন শিয়া এবং প্রেসিডেন্ট পদে একজন খ্রিষ্টান নির্বাচিত হবেন। সুতরাং লেবাননে একক কোন দলের পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া এক প্রকার অসম্ভব। তাই লেবাননে সব সময় জোটের লড়াই দেখা যায়। এমনও হয় সরকারে দুই বিরোধী হল একসাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করছে! যেমনটি দেখা গিয়েছে গতবার ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ, সৌদি আরব সমর্থিত সাদ হারিরি (সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাফিক আল হারিরির ছেলে) আর খ্রিষ্টান সাবেক সেনাপ্রধান আউনের দল একসাথে সরকার গঠন করেছিল। যদিও সিরিয়া ইস্যুতে হারিরি এবং নাসরুল্লাহ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছিল, এমনকি সিরিয়ায় আসাদের পক্ষে হিজবুল্লাহর হস্তক্ষেপের অভিযোগ করে হারিরি সৌদি আরবে গিয়ে সেদেশের রাষ্ট্রীয় টিভিতে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিল। যদিও ধারনা করা হয় লেবাননকে অশান্ত করতেই সৌদি আরব হারিরিকে চাপ দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল।
এবারের নির্বাচনে দুইটি প্রধান জোট ছিল হারিরির ফিউচার মুভমেন্ট যারা এবার মাত্র ২১ টি আসন পেয়েছে যা গতবারের থেকে ১৩ টি আসন কম এবং হিজবুল্লাহ-আমাল সিয়াদের ২৭ টি আসনের সব গুলোতে জয় পেয়েছে এবং হিজবুল্লাহ-খ্রিষ্টান সেনাপ্রধানের জোট ১২৮ টি আসনের মধ্যে ৬৭টি আসন পেয়েছে সুতরাং তারা চাইলে হারিরির দলকে ছাড়াই সরকার গঠন করতে পারে। তবে নির্বাচনের সময় দুই দলের দন্দ দেখা গেলেও নির্বাচনের পরে হারিরি হিজবুল্লাহ জোটের সরকারে অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহও সকল বিভেদভুলে একতার ডাক দিয়েছেন। সুতরাং ধারনা করা হচ্ছে গত সরকারের মতই এবার যৌথ সরকার গঠন করবে লেবানন। তবে এবারের সরকারে দুর্বলপক্ষ হবে হারিরির দল যা ইরানের কাছে সৌদি আরবের জন্য বড় ধরনের পরাজয়।
একটি বিষয় হল হিজবুল্লাহ বলতেই আমরা যেমন ইরান সমর্থিত কট্টরপন্থী শিয়া মুসলিম মিলিশিয়া বুঝি কিন্তু লেবাননের জনগনের কাছে হিজবুল্লাহ হল লেবাননের রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা প্রদানকারী সংস্থা যারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দক্ষিণ লেবাননকে ইসরাইলের কাছ থেকে মুক্ত করেছিল। মজার বিষয় হল হিজবুল্লাহ জোটের বড় অংশই হল খ্রিষ্টান এবং সেকুলার। এমনকি হিজবুল্লাহর সেনাবাহিনীর মধ্যেও খ্রিষ্টান সৈন্যদের জন্য একটি পৃথক শাখা রয়েছে। ধারনা করা হয় লেবানন সরকারি সেনাবাহিনীর থেকেও হিজবুল্লাহ শক্তিশালী।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১২:২৬