আমিয়াখুম থেকে একটু দূরে গিয়ে এর দিকে আবার ফিরে তাকালাম। অসম্ভব সুন্দর মনে হল। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানালাম শুধু এটিকে সৃষ্টির জন্যই নয়, আমাদেরকে এখানে আসার সুযোগ করে দেয়ার জন্যও। ফিরে যেতে মন না চাইলেও আমাদের যে এখন ফিরতেই হবে। হাতে সময় নেই মোটেই। ফিরে চললাম পাড়ার দিকে। তবে এবার অন্য রাস্তায় ফিরছি। এ রাস্তাটা আমার পরিচিত। আগে একবার আমিয়াখুম আসার সময় এ পথেই এসেছিলাম। সবাইকে একটু দ্রুত পা চালাতে বললাম। আমরা শিডিউল টাইমের চেয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পিছিয়ে আছি। সাথে শুকনো খাবার ও বেশি নেই। সামান্য কিছু চকলেট আর অল্প কিছু খেজুর। এ পথে ঢুকেই মনে হল আমরা চলে এসেছি প্রাগৈতিহাসিক কোন সময়ে। এই বুঝি সামনে হাজির হবে টি-রেক্স এর মতো কোন ডাইনোসোর আথবা পেঁচিয়ে ধরবে এনাকোনডার মতো বিশাল কোন সাপ। বিশাল বিশাল এককেকটা গাছ অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা ছিচ্ছে পুরো জঙ্গলটাকে।
বেশ খাড়া একটা পাহাড় পার হয়ে আমরা সমতলে হাঁটলাম বেশ কিছুক্ষণ। এদিকে ক্ষুধায় সবার অবস্থা খারাপ। বাকি খেজুর আর চকলেট সবাই ভাগাভাগি করে খেলাম। ঘণ্টাখানেক হাটার পর পিছন থেকে আওয়াজ এলো, তাহসিন বিস্কুট আছে? না। খেজুর? না। চকলেট? না। যেই রুবিনা আপু পাহাড়ে গেলে চকলেট প্রায় খায়ই না, সে কিনা আমার কাছে চকলেট চাইছে! এতদিনে বুঝি পারাতে পারাতে শুকনা খাবার বিলিয়ে দেবার মর্মটা বুঝতে পারল সবাই। কিন্তু এখন তো কিছুই করার নেই। আমাদের ফিরতে হবে পারাতে। ক্লান্ত আমরা ধীরে ধীরে ফিরে চলেছি সাজাই পারাতে। এক জায়গাতে কলা গাছে কাঁচা কলা দেখে কামাল ভাই আমার কাছে চাকু চাইলেন। জিজ্ঞাসা করলাম কি করবেন? কলা খাব। কলা তো কাঁচা ! কাঁচাই খাব। শেষ পর্যন্ত হাতের নাগালে কলাগুলোকে পাওয়া গেলনা দেখে মাসুম, কচি, বাচ্চা কলাগুলো কামাল ভাইয়ের মতো কাঁচা কলা খাদকের হাত থেকে এ যাত্রায় প্রানে বেঁচে গেল। আরেকটা বেপার আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। রুপম ও জীবন এর পায়ের অবস্থা ভাল না থাকায় তাদের আমরা পারায় রেখে এসেছি। তারা আমাদের চিন্তায় উল্টাপাল্টা কিছু না করলেই হয়। ক্ষুধায় কাতর, কষ্টে পাথর আমরা গুটি গুটি পায়ে হাঁটছি। জি পি এস বলছে সাজাই পারা আর বেশি দূরে নয়। একটু পরেই চোখে পড়ল একটি পারা। আরে ওটাই তো সাজাই পারা! আমরা যখন পারাতে পোঁছালাম তখন ঘড়িতে সময় পাঁচটা। রুপম ও জীবন আমাদের দেখেই চুলায় পানি চড়িয়ে দিয়েছে নুডুলস এর জন্য। আমরা চলে গেলাম ঝিরিতে গোসল করতে। এরই মাঝে সবাইকে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে বলেছি। আমরা ঠিক ছয়টায় আবার রওনা হব রেমাক্রির উদ্দেশে। সবাই ভীষণ ক্লান্ত কিন্তু আজ এখানে থেকে যাওয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই। আজ কিছুটা এগিয়ে না থাকলে কাল রাতের ঢাকার বাস আমরা কোন ভাবেই ধরতে পারব না।
খাওয়া শেষ করে কারবারি, অংফউ খিয়াং এর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তাঁদের সহজ, সরল, আন্তরিক, অমায়িক ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ। সাজাই পারার সবাই ব্যবহার দিয়ে আমাদের মন কেড়ে নিয়েছে। পলাশ দা কে সাথে নিয়ে শুরু হল আমাদের রাতের অভিযান। পালের গদার মতো আমরা এক লাইন করে হেঁটে চলেছি। শরীরে ক্লান্তি থাকলেও রাতে ট্র্যাক করতে খারাপ লাগছে না। আমি, হেলাল, সিফাত, নকিব মিলে গান গাইতে শুরু করলাম। সুর নাই, তাল নাই, আমরা সবাই তানসেন! ব্যাকগ্রাউড মিউজিক হল ঝিরির কুকুল ধ্বনি আর ঝিঁঝিঁ পোকার সেই বিখ্যাত বাঁশী। আর স্রোতা? সে তো জঙ্গলের হাজারো পাখি, কীটপতঙ্গ আর আকাশের লক্ষ কোটি তারা। রাস্তা প্রায় সমতল। তাই পথ চলতে তেমন কোন কষ্টই হচ্ছে না। এরই মাঝে দুটো পারা পার হয়ে এসেছি। কিছুদূর এগুনোর পর আমরা খুব সরু একটা ঝিরিতে এসে পড়লাম। কিছুদূর এগিয়ে মনে হল এটা মানুষ হাঁটার ট্রেইল না। পলাশকে বললাম ব্যাপারটা। কিন্তু পলাশ দা বলল এটাই রাস্তা। কি আর করা? হাঁটা দিলাম সামনে। মিনিট দশেক চলার পর ট্রেইলটা শেষ হয়ে গেল। হাতের বামে উপরে একটা জুম ঘর দেখা গেলেও এটা কোন ভাবেই মানুষ চলাচলের নিয়মিত রাস্তা নয়। বুঝলাম এই রাত দশটায় আমরা আবার হারিয়ে ফেলেছি কোন এক পাহাড়ের কোলে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৪৫