ক্লান্ত শরীরে এক বোমাং আধিবাসীর গেস্ট হাউসে ১০০ টাকার ঘুমটার দাম লাখ টাকায়ও অমূল্য লাগল। কিন্তু পরিকল্পনা মোতাবেক ভোর ৫টায় সেই অমূল্য ঘুম যখন ভাঙল তখনতো পূরো ট্যুরটাকে মুল্যহীন করার প্রাণান্ত চেষ্টায় ব্যস্ত প্রকৃ্তি। আগেরদিন সূর্যিমামা হাসিমুখে বিদায় নিলেও পরের দিন তার আর দেখা নাই। ভোরে সূর্যের আলোর বদলে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল বৃষ্টি। আর তাতেই সিরাজ় ভাইদের দলের ৮ জনের মধ্যে ৭ জনের কেওক্রাডাং দর্শনের অদম্য ইচ্ছা বানের জলে ভেসে গেল। সকাল ৬টায় আমাদের দলের পঞ্চপান্ডব আর সিরাজ ভাই সহ মোট ছয়জন নাস্তাসেরে বৃষ্টি থামার এক ফাঁকে ‘যা আছে কপালে’ বলে রওনা দিলাম পাহাড়ী পথ ধরে। কপালে কেওক্রাডাং পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য আছে কিনা জানা না থাকলেও মাথার উপর যে ঘন মেঘ আছে তার গর্জন শুনতে পেলাম। পাহাড়ী পথে ১ কিমি মত যাওয়ার পর সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি নামল। কলাপাতার আশ্রয়েও শরীরটা অর্ধভেজা হল। ভিজলাম যেহেতু দাড়িয়ে থাকার আর দরকার কি? কাকভেজা শরীরে পথচলা চলতে থাকল। বগালেক থেকে কেওক্রাডাং যাওয়ার পথটা তেমন বিপজ্জনক নয়। কয়েকটা খাড়া খাঁদ ডিঙানো ছাড়া বাকি পথটা মসৃন। পাহাড়ের ঝোঁপঝাড় ও ঢাল কেঁটে বানানো রাস্তা পাড়ি দেওয়া তেমন বিপজ্জনক না হলেও দরকার সাহস আর শারীরিক সক্ষমতা। বৃষ্টিতে পিচ্ছিল এই পথ চলতে তিনপেঁয়ে মনুষ্য হতে হল। সেই ১১ খিল থেকে নেওয়া বাঁশের লাঠিগুলো তখন সবার একটি করে বাড়তি পা। পাহাড়ী পথটা পাড়ি দিতে এই পা’র অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। অসংখ্যবার পিছলে যাওয়ার সময় এই লাঠি’ই ভরসা হল। কেওক্রাডাং যাত্রার পথে এই লাঠি এতটা অবিচ্ছেদ্য অংশ যে এটা সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায়, যত জন পর্যটক দৈনিক কেওক্রাডাং-এ উঠেন ঠিক ততটা লাঠিও কেওক্রাডাং-এর চূড়া স্পর্শ করে। পথেমধ্যে আরও দুই পশলা বৃষ্টির মুখে পরলাম। কিন্তু কিছুতেই আর ভ্রূক্ষেপ করলাম না। চলতে পথে কয়েকটি আধিবাসী পাড়া আর সারি সারি আদা’র বাগান চোখে পড়ল।
তবে সবচেয়ে মোহিত হলাম পাহাড়ের গা’র সাথে লেগে থাকা তুলার মত মেঘ দেখে। এতদিন মাথার উপর যে মেঘের উড়াল দেখতাম তা এখন পা স্পর্শকরে ভেসে গেল।
পথের পাশে কেঁটে রাখা এক গাছে বসে যখন একটু জিরিয়ে নেওয়ার ফুসরত পেলাম তখন জুতা খুলে দেখি তাতে চার থেকে পাঁচটি জোঁক। তারপর তো শুরু হল এক মহাকান্ড। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল শরীরের কাপড় চোপড় নিয়ে। ঘেটেঘুটে প্রায় সবার শরীরে জ়োঁক পাওয়া গেল এক হালি করে। আগে থেকে জোঁকের উৎপাতের কথা জানতাম বলে সাথে করে লবণ নিয়ে গিয়েছিলাম। তাতে ঝামেলাটার একটা সমাধান হল। বাড়তি সতর্কতায় সবার জুতায় লবণ মাখালাম।
কাদা ভর্তি এবং পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা হাঁটার পর এক আধিবাসী পাঁড়ার দেখা মিলল। কেওক্রাডাং-এর আগে এটিই শেষ জনপদ। দার্জিলিং পাঁড়া। পাঁড়ায় প্রবেশ করার পথে এক দোকানের সামনে ঝুলে থাকা ‘Wel Come’ অভর্থনা জানাল. এই পাঁড়ার একটা বিশেষত্ব হল অন্য সব পাঁড়ার চেয়ে এই পাঁড়াটি অনেক বেশি সুন্দর এবং পরিষ্কার। দুইটি দোকান, একটি গির্জা যেখানে বাচ্চাদের প্রাইমারি শিক্ষার সুযোগ রয়েছে এবং কয়েকটি বসত ঘর মিলিয়ে পাঁড়াটি ছবির মত পরিপাটি। এক দোকানে চা-নাশতা সেরে আবার শুরু পদভ্রমন। উঁচু একটা পাহাড় পেরিয়ে দেখা মিলল কেওক্রাডাং শৃঙ্গের। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘুরানো পথে পৌছে গেলাম একদম শৃঙ্গের গোড়ায়। যেখানে পৌছালাম সেখান হতে কেওক্রাডাং-এর সর্বোচ্চ চূড়া পর্যন্ত প্রায় ১০০ ফুট দীর্ঘ একটি সিমেন্টের সিড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সেই সিড়ি দেখে আর সুস্থির থাকা সম্ভব হলনা। সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে হাঁটার ক্লান্তি ভুলে এক নিশ্বাসে উঠে গেলাম চূড়ায়। তারপর বিমুগ্ধ চোখে দেখলাম সবুজ পাহাড় আর সাদা মেঘের অন্য এক জগৎ।
অল্প দুরত্বের পাহাড় গুলো বাদে দৃষ্টিসীমানায় সাদা তুলার মত স্তরে স্তরে ভাঁজ হয়ে থাকা মেঘ আর মেঘ।
মেজর মোশাররফ হোসেনের নেতৃতে ১৯৯৩ সালে আবিষ্কৃত ৩১৭২ ফিট উঁচু এই পর্বতশৃঙ্গে্র তালুতে নির্মান করা হয়েছে একটি ছাউনি। ছাউনির সাথে লাগোয়া একটি শন পাতার ঘর।
কেওক্রাডাং এর মালিক “লারা ভাই’ এই প্রাকৃ্তিক রেস্টুরেন্টের মালিক। সদালাপী ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে জানা গেল কেওক্রাডাং পর্বত সহ পার্শ্ববতী আরো কিছু জায়গা তিনি উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছেন। শীগ্রই নির্মিত হতে যাওয়া একটি কটেজ এর পেপার প্ল্যানও দেখালেন। তার কাছে খোঁজ পেলাম কেওক্রাডাং থেকে ১ ঘন্টা হাঁটা পথ দুরত্বের এক ঝর্নার। ‘জাতিপাড়া’ ঝর্না (আসলে ঝর্নাটার নাম ‘জাতিপাড়া’ কিংবা ‘জাতিপাড়া’র কাছাকাছি কিছু, আধিবাসীদের অস্পষ্ট উচ্চারণের কারণে দূর্বোধ্য এই ঝর্নার আসল নাম যে কি তা আল্লাহ মালুম)। ঘড়িতে তখন বেলা ১০টা। এদিকে তখন সুর্যেরও দেখা মিলতে শুরু করেছে। হাতে অঢেল সময় থাকায় রওনা দিলাম সেই জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে ভদ্রলোকের ছাউনি-রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারের জন্য আতিথ্য গ্রহন করলাম।
সাড়ে তিন ঘন্টায় ১২-১৫ কিমি পথ বেয়ে যে উচ্চতায় উঠেছিলাম তা এখন প্রায় খাড়া নেমে গেছে। তিন থেকে চার কিমি পথ বেয়ে সেই ৩০০০ ফিট উচ্চতা সমতলে গিয়ে মিশেছে। প্রায় ৫০ ডিগ্রি কৌণিক পথে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে শরীরের টাল সমলাতে ভালই বেগ পেলাম। হাজারখানেক ফিট নেমেই দেখা মিলল আধিবাসী ‘পাসিং পাড়া’র।
সেখানে অল্প খাওয়া-দাওয়া হল। নামতে হবে আরও প্রায় দুই হাজার ফিট মত। এত খাড়া পথ বেয়ে উঠার কষ্ট দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়ে অ্যালেক্স আর সাইফুল আর নিচে নামার সাহস করল না। দুইজনকে সেখানে রেখে আমরা বাকি চারজন দ্রুত নামতে লাগলাম।
ঘন্টা খানেক হাঁটার পরই উপর হতে অবিরাম পানি পতনেরর শব্দ কানে এল। ছোট্ট একটা ঝোপ পেরিয়ে পৌছে গেলাম সেই শব্দের উৎসমুখে।
প্রায় ত্রিশ হতে চল্লিশ ফুট উপর হতে নেমে আসা পানির স্রোত তিন স্তরে তীব্রভাবে আছড়ে পডছে বিরাট বিরাট পাথরের উপর। সেখানেই ছোট্ট একটা ডোবার মত জলাধার।
সেই জলাধারের পাডে বসে আবার জোঁকের সন্ধান চলল। দেখাও পাওয়া গেল কয়েকটার। সেগুলোকে দেহচ্যুত করে এবার ফিরতি পথের যাত্রা। ফিরতি পথেই মজাটা বুঝলাম। এক ঘন্টায় তরতর করে নেমে যাওয়া প্রায় তিনহাজার ফিট উঠার সময় থামতে হল প্রায় বার দশেক। সময়ও লাগল প্রায় ঘন্টা আড়াই। অবশেষে শরীরের তীব্র আপত্তিকে উহ্য করে যখন আবার কেওক্রাডাং এর চুড়ায় উঠলাম তখন বেল প্রায় আড়াইটা। পাসিং পাড়ায় থেমে যাওয়া দুই দলছুটও সেখানে বসে আছে। লারা ভাই মিনিট বিশেক পরে দেশি মুরগীর আর ঘন ডাল দিয়ে ভাতের যে আয়োজনটা করলেন তা অভুতাস্বাদিত লাগল। সেই খাওয়া সেরে ভদ্রলোকের সাথে আরো কিছুক্ষন আড্ডা হল। সবাই মিলে তার সাথে ছবি তুললাম।
ইতোমধ্যে আবহাওয়া ভাল হয়ে আসায় কেওক্রাডাং-এর চূডায় পর্যটকের আগমনও বেড়ে গেল। সকাল দশটায় যখন আমরা ছয়জন ছাড়া আর কারো টিকিটিরও দেখা পাওয়া যায়নি সেখানে এখন প্রায় জনা পঁচিশেক লোক। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বগালেকের দিকে ফিরতি পথ ধরলাম। নেমে যাওয়া পথে আরামসে হেঁটে চললাম।
বগালেকে পৌছার মিনিট ত্রিশেক আগে ‘চিংড়ি’ ঝর্নায় একটু কালক্ষেপন হল।
অস্তমিত সূর্যের বিক্ষেপিত আলো, পাহাড়ি আঁধার আর চাঁদের রুপালী আলোয় পথ চলে পৌছে গেলাম বগালেকের মূল চত্বরটাতে। দপ করে বসে পডলাম সবাই সবুজ জমিনে। কিছু কলা আর বিস্কুটের শ্রাদ্ধ করে ফিরে গেলাম গেস্টহাউসে। গোসল আর রাতের খাওয়া সেরে বগালেকে রয়ে যাওয়া ৭ অর্ধ-অভিযাত্রীর সাথে পথের গল্প হল। আমাদের কাছে সে গল্প শুনে দুই-একজনের মুখে আফসোসও শুনতে পেলাম। রাত একটু গভীর হয়ে এলে ঘুম নেমে এল ১৩ জোড়া চোখে।
পরেরদিন সকালে আর্মি ক্যাম্পের নিবন্ধন খাতা হতে নামগুলো কাঁটালাম।
পদ গাড়ি, চান্দের গাড়ি, নৌকা আর দুইটি বাসের চাকায় ভর করে ১১ খিল, রুমা বাজার, কইক্ষ্যাংঝিরি, হাফেজ ঘোনা আর বান্দরবান পেরোনো সারাদিন জুড়ে শুধুই ঘরে ফেরার গল্প………………………………
যাই পেরিয়ে এই যে সবুজ বন
যাই পেরিয়ে ব্যস্ত নদী, অশ্রু আয়োজন,
যাই পেরিয়ে সকাল-দুপুর-রাত
যাই পেরিয়ে নিজের ছায়া, বাড়িয়ে দেয়া হাত।।।
** প্রিয় 'সঞ্জীব চৌধুরী'র জন্মমাসে শ্রদ্ধায় স্মরণে...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১১:৪৮