শুরু হয় ইউরেনিয়াম আকরিক সংগ্রহ ব্যাপক পরিমাণে। ইউরেনিয়াম আকরিক থেকে U-235 সংগ্রহ করা হয়, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সেপারেশান প্ল্যান্টের মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন হয় ৬০০ টন রুপা। বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণার ফলস্বরূপ ‘চেইন রি-অ্যাকশন’ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসে। ১৯৪৫ সালে মার্চ মাসে জার্মানি আত্মসমর্পণ করলে বিজ্ঞানীদের উদ্যমে ভাটা পড়ে। তারা অনেকেই এই প্রজেক্ট বন্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় অবগত করে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লেখেন। কিন্তু চিঠি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের হাতে পড়ার কয়েক ঘন্টা আগেই মারা যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
এরপর ট্রুম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং বিজ্ঞানীদের অনুরোধ উপেক্ষা করে শিগগিরই কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার এ সুযোগ তিনি ছাড়তে চাননি। কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন, “এইবার ব্যাটাদের শায়েস্তা করার মুগুর হাতে পেয়েছি”
১৯৪৫ সালের ১২ জুলাই, রাত ৪.৩০ মিনিট, লস অ্যালামস ল্যাবরেটরির কন্ট্রোল রুমে বিজ্ঞানীরা ভাবী উত্তেজনায় উন্মুখ। সব রঙের বাটনটির ওপর ওপেনহেইমারের তর্জনী। কাউন্ট ডাউন শুরু হলো, টেন-নাইন... ওয়ান-জিরো। হাজার হাজার সূর্য যেন একসাথে জ্বলে উঠলো। রাতের অন্ধকারের বুক চিরে তীব্র কমলা লাল আলোয় ছেয়ে গেল গোটা আকাশ। কিছুক্ষণ পরেই ভয়ঙ্কর শব্দে শকওয়েবের তীব্র ধাক্কায় নড়ে উঠলো মাটি, দুলে উঠলো ল্যাবরেটরি, তারপর নিঃসীম নীরবতা, নির্বাক বিজ্ঞানীরা, কয়েক মুহূর্তের পর চমক ভাঙলো বিজ্ঞানীদের। উল্লাসে ফেটে পড়লেন তারা। ওপেনহেইমারকে তরুণ কয়েকজন বিজ্ঞানী কাঁধে তুলে নাচতে লাগলেন। হ্যান্ডশেক আর কোলাকুলি করতে করতে ওপেনহেইমারকে তারা ব্যস্ত করে তুললেন। পারমাণবিক বোমার জনক তখন একইসাথে আনন্দিত এবং ভবিষ্যৎ ভাবনায় ব্যথিত।
ছবি - ট্রিনিটি এক্সপ্লোশান
এ প্রসঙ্গে পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি জবাব দেন, দুর্নিবার আবিষ্কারের নেশা যখন বিশ্বকে পেয়ে বসে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করার সময় তখন থাকে না। একজন বিজ্ঞানীর সাধ্য কী যে সে তা রুখে!
এই ট্রিনিটি টেস্টের দুইদিন পূর্বে ওপেনহেইমার তাঁর আশা ও ভয়কে প্রকাশ করেছিলেন ভাগবদ গীতার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে -
In battle, in the forest, at the precipice in the mountains,
On the dark great sea, in the midst of javelins and arrows,
In sleep, in confusion, in the depths of shame,
The good deeds a man has done before defend him.
বিজ্ঞানীদের এই আনন্দ-উল্লাস গভীর বিষাদে ঢাকা পড়ে, যখন মুখরিত দুই জনপদ নাগাসাকি এবং হিরোশিমা মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে অমোচনীয় কলঙ্কের কালিমা হয়ে পারমাণবিক বোমা লেপ্টে যায় ইতিহাসের পাতায়।
মারণাস্ত্র তৈরিতে পিছিয়ে ছিল না আরেক পরাশক্তি অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদিকে এডওয়ার্ড টেলর হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য পায় প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছ থেকে। অপরদিকে হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কারের বিরোধিতা করেন ওপেনহেইমার। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। একে একে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ এনে তাঁকে বিপর্যস্ত করা হতে থাকে এবং এতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারের প্রচ্ছন্ন পৃষ্টপোষকতা থাকে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয় ওপেনহেইমারকে। ঘোর কমিউনিস্ট বিরোধী সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থি এবং ওপেনহেইমারের প্রধান শত্রু লুই ট্রাউস ওপেনহেইমারের সব ধরনের সুবিধা কেড়ে নেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যায়। প্রিন্সটন ইনস্টিটিউট থেকে তাঁকে সরানোর চেষ্টা চালানো হয়; কিন্তু একদল বিজ্ঞানীর তুমুল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সিআইএ এবং এফবিআই চব্বিশ ঘন্টা ওপেনহেইমারের ওপর নজর রাখে। ফোনে আঁড়িপাতাযন্ত্র বসানো হয়। বিচারের নামে আদালতের কাঠগড়ায় তাঁকে পুনঃপুন দাঁড় করানো হয়- চরমভাবে অপমানিত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ‘কালো প্রাচীর’ নির্মাণ করা হয়। সব ধরনের গবেষণা থেকে তাঁকে দূরে রাখা হয়। সময়টি ছিল ওপেনহেইমারের জন্য মৃত্যুর চেয়ে বেশি বেদনাদায়ক। এই সময় তিনি শারীরিক এবং মানসিক উভয় প্রকারেই ভেঙে পড়েন। তাঁর পরিবারের উপর নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। স্ত্রী কিটি বেদনা ভুলে থাকতে সারাক্ষণ মদে ডুবে থাকতেন। পুত্র পিটার বঞ্চিত হয় সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ থেকে। কন্যা ক্যাথেরিন অপমানের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করে।
অবশেষে ১৯৬৬ সালের দিকে মার্কিন সরকার নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং ওপেনহেইমারকে যথাযোগ্যভাবে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন এফ কেনেডি এবং লিন্ডন বি জনসন। এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্টানে বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে বেষ্টিত অবস্থায় তাঁকে সর্বোচ্চ খেতাব ‘ফার্মিতে’ ভূষিত করা হয়।
ওপেনহেইমার এই সময় খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন। লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করতে হতো। দেশের প্রতি একান্ত অনুগত হয়েও ‘দেশদ্রোহী’ অপবাদ তাঁকে আজীবন পীড়িত করে। ১৯৬৭ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারী, ৬২ বছর বয়সে অসামান্য প্রতিভাধর নির্মম দুর্ভাগ্যের শিকার এই বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন। অন্ত্যষ্টিক্রিয়া শেষে তাঁর দেহভস্ম ভার্জিন আইল্যান্ডে সমুদ্রের ছড়িয়ে দেয়া হয়।
তথ্যসূত্রঃ
১) “প্রজেক্ট ম্যানহার্টন এবং ওপেনহেইমার” – আব্দুল্লাহ-আল-মামুন
২) “The inventor of Atomic bomb Robert Oppenheimer & his punishment”
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৪