হাসতে হাসতেই কথাটা বলল হাসিব। এতো সহজে বলে দেয়াটা কি আসলেই সম্ভব?তনু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হাসিবের দিকে। একটুও কষ্ট হচ্ছে না ছেলেটার।
- হাসিব ভাইয়া, আপনি সত্যি আমাকে বিয়ে করতে বলছেন?
- হ্যাঁ অবশ্যই। তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে।কুড়িতেই নাকি মেয়েরা বুড়ি হয়ে যায়, আর তোমার কুড়ির পিঠে ৩, তেইশ।
- আমি জানি আমার বয়স কত।
- তাছাড়া এমন ভাল ছেলে বারে বারে পাওয়া যায় না। আন্টি সেদিন আমাকে ডেকে ছেলের ছবি দেখাল। বাহ কি সুপুরুষ। তাছাড়া, সুপুরুষ কুপুরুষ কথা না। ছেলে ডাক্তার। হোক প্রাইভেট মেডিকেল, সেটা দেখার কথা না। ডাক্তার তো।
- আমি এটাও জানি।
- তাহলে? রাজি হয়ে যাও।আমার দাওয়াত রইল তোমার বিয়েতে। ভাল মন্দ খাব।
- আচ্ছা খাবেন।
- ও ও ও, আমি তোমাকে বলছিলাম না একদিন তোমার থেকে ২ টা জিনিস চেয়ে নিব। আজ সেই ২টা আমাকে দিবে?
- হ্যাঁ দিব। বলেন।
তনু তাকিয়ে আছে হাসিবের দিকে এখনও। হাসিবের থেকে দুইটা চাওয়া শুনবার জন্য।হাসিব তনুদের বাসায় ভাড়া থাকে। অনেক বছর ধরেই।ভাল ছাত্র মোটামুটি। ঢাবিতে ম্যাথে অনার্স করে মাস্টার্স করছে।আর তনু একটা প্রাইভেটে সি এস ই পড়ছে। তনু ম্যাথে খুবই কাঁচা। তাই মাঝে মাঝে সময় পেলেই তনুকে ম্যাথ করিয়ে দেয় হাসিব।ভাল ছেলে হিসেবে অনেক আদর স্নেহও পায় তনুর মা বাবার থেকে। অনেকটা পরিবারের অংশ হয়েই গিয়েছে হাসিব। তনুর কেন যেন হাসিবকে অনেক ভাল লাগে। ঠিক কেন লাগে তনু জানেনা। অনেকবার বুঝাবার চেষ্টা করেছে তনু, হাসিব বুঝে না। তনুর মাঝে মাঝেই মনে হয়, হাসিবও তনুকে ভালবাসে, কিছু একটা কাজ করে তনুর প্রতি হাসিবের, হাসিবের চোখের ভাষায়ও অনেক কিছু বলতে চায়। তবু মুখে কখনও বলেনি হাসিব। এইতো গত বছর, হাসিবের সাথে মা পাঠাল ঈদের শপিং করতে। শপিং করে ফিরছে, তনুর হাতে এক গাদা জামা কাপড়। রিকশায় পাশাপাশি দুজন। হাসিব এক কোণায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তনু একটু পর পর হাসিবের দিকে তাকাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। ছেলেদের এতো লজ্জা থাকে!!!
হঠাৎ পিছন থেকে অন্য এক রিক্সার ধাক্কা। পাশের এক গাড়িকে পাশ কাটাতে গিয়ে এই অবস্থা। ধাক্কায় তনু নিজের ভারসম্য রাখতে না পেরে রাস্তায় ছিটকে পড়ে গেল, আশেপাশে হাতের জামা কাপড়ের ব্যাগগুলো। হাসিব জলদি নেমে তনুকে উঠাল।হাতের কাছে অনেক খানি কেটে গেছে।রক্ত পড়ছে ওখান দিয়ে। হাসিব চট জলদি রিকশায় তনুকে তুলে ডিসপেনসারিতে নিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিল। ভালই ব্যথা পেয়েছে তনু। বাসায় আসবার সময় তনু দেখল, পাশে বসে হাসিব কাঁদছে, আর নাক টানছে।
- ভাইয়া, কাঁদেন কেন?
- আমি মানুষের রক্ত দেখতে পারি না।
- হিহি, এখন তো রক্ত নেই। এই যে দেখেন, ব্যান্ডেজ করা, সাদা সাদা।
- তাও, ছিল তো।
হাসিব কেঁদে যাচ্ছে। এইটুকুতে কেউ কাঁদে? ভাল না বাসলে এইটুকু রক্ত বের হলে কাঁদে কেউ? তনুর বিশ্বাস, হাসিবও তনুকে ভালবাসে তাই কেঁদেছে। কয়েক মাস আগে, তনুর জ্বর। প্রচণ্ড জ্বর।খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। প্রতিদিন তনুকে দেখতে এসে হাসিব মাথার কাছে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কাঁদে।এটাও কান্নার কোন ঘটনা না। ছেলেটা নিজেকে খুব চালাক ভেবে জ্বরের কয়েকদিন তনুকে সানগ্লাস পরে দেখতে আসে। যাতে কেউ কান্না না বুঝতে পারে, ভেজা চোখ না দেখতে পারে। হয়ত ছেলেটা জানে না, চোখের জল সানগ্লাসে আটকে থাকে না, গাল বেয়ে পড়বেই। তনু ঠিকই দেখে হাসিব ভাইয়া কাঁদছে।প্রতিদিন কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর কমেছে কিনা। প্রতিবার কপালে হাসিবের ছোঁয়ায় তনুর বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠে। মনে হয় আরও কিছুক্ষণ দিয়ে রাখুক হাতটা।মনে মনে চাইত, আরও কিছুদিন জ্বরটা থাকুক। হাসিব ভাইয়া কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখবে,সানগ্লাস পরে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদবে।তবে জ্বর ৮ দিনের দিন ভাল হয়ে যায়।সেদিনও সানগ্লাস পরে হাসিব আসে তনুকে দেখতে।তনুর মাথায় হাত দিয়ে বলে, বাহ জ্বর ভাল হয়ে গেছে।
সানগ্লাস খুলে হাতে নিয়ে, হাসতে হাসতে তনুর সামনে বসে। তনু একটু ভাল করে হাসিবকে দেখে। এই কয়েক দিনে অনেক শুকিয়ে গেছে, দেখে মনে হচ্ছে এতদিন অসুস্থ তনু ছিল না, হাসিব ছিল।তনু হাসিবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাইয়া এমন শুকিয়ে গেছেন কেন?
- আর বইল না। কি যে যন্ত্রণা। কয়েকদিন ধরে খুব অরুচি, খেতে গেলেই বমি পায়। তাই কয়েকদিন ভালমত খেতে পারি নায়। মনে হয় কৃমির সমস্যা। আজ সকালে কৃমির ট্যাবলেট খেলাম। ঠিক হয়ে যাবে।
তনু চুপ করে কথা শুনে, কি হাসতে হাসতে কথাগুলো বলল। কিন্তু তনু জানে, তনু এই কয়েকদিন খায়নি বলে, টেনশনে বা ইচ্ছা করেই হাসিবও খায়নি।এতো কান্নাকাটি আর না খাওয়াতেই শরীরের এই অবস্থা। হাসিব ভাইয়া ভাল না বাসলে এমন করবে কেন?হাসিব ভাইয়ার এমন অনেক কিছুই বলে দেয় সে তনুকে ভালবাসে। তবে মুখ ফুটে কেন বলতে পারবে না? তনুও তো কম বোঝাবার চেষ্টা করেনি হাসিবকে। হাসিবকে একদিন জিজ্ঞেস করল তনু, ভাইয়া আপনি তো কারও সাথে প্রেম করেন না। করবেন বলেও মনে হয় না। একেবারে বিয়েই করবেন মনে হয়। তা আপনি কেমন মেয়ে চান বউ হিসেবে?
কিছুক্ষণ মাথা চুলকে হাসিব অনেক ভেবে চিন্তে বলল, এই ধর, তোমার মত?
- তাই?
- হ্যাঁ।
- তাহলে আমিই আপনার বউ হয়ে যাই। এতো খোঁজাখুঁজি লাগবে না। হিহি।
কথাটা বলে তনু হাসে, আর হাসিব বোকার মত তাকিয়ে থাকে। আর কিভাবে বুঝাবে তনু? সেদিন হাসিবকে অনেক করে বলল, বুঝাল, তনু একটা ছেলেকে ভালবাসে। দেখতে কেমন, হাসিব বলতেই তনু সব বর্ণনা হাসিবের দিল। তাও ছেলেটা বুঝে না। হাসিব বলে, কই ছবি দেখাও।
তনু তখন রাগ করে বলে, কেউ না,আপনার সাথে দুষ্টামি করলাম।
হাসিব এটা শুনেও হাসে। মাথায় এতো বুদ্ধি কম, কি করে যে এতো জটিল জটিল ম্যাথ পারে।
বাসায় বেশ কয়েক বছর ধরে বিয়ের প্রস্তাব আসে। তবে ইদানীং খুব বেশি। এর ভিতর এক ছেলেকে বাবা মা অনেক পছন্দও করে ফেলেছে। ডাক্তার ছেলে। এই ছেলের ব্যাপারে খুব বুঝাচ্ছে মা তনুকে।কি করবে বুঝতে পারছে না,তাই হাসিবের কাছে জিজ্ঞেস করা কি করবে। হাসিব হাসি হাসি মুখে বলল, বিয়ে করে ফেলতে।
একবারও মনে হল না কিছু? ভাল বাসলে এতো সহজে কি করে বলল? তনু এখনও ভাবছে হয়ত হাসিব ভালবাসার কথা বলবে। হাসিব ভাইয়া একদিন খুব সিরিয়াস ভাবে তনুকে বলল, তনু তোমার সাথে আমার অনেক জরুরি কিছু কথা আছে।
- বলেন ভাইয়া।
হঠাৎ ই মুখের সিরিয়াস ভাব চলে গেল, কাচুমাচু হয়ে বলল, না থাক বলব না।
- বলেন না, ভাইয়া প্লিজ।
- না আজ না। তবে তোমার কাছে আমি একদিন ২ টা জিনিস চাব। আমাকে দিতে হবে। ফিরিয়ে দিবে না কথা দাও।
- হিহি। আচ্ছা কথা দিলাম। যা চাবেন দিব। তবে এখনও চাইতে পারেন।
- না সময় হলে।
আজ সময় হয়েছে হয়ত। হাসিবের মুখের দিকে এখনও তাকিয়ে আছে তনু ২ টা চাওয়া শুনবার জন্য।
- কি হল ভাইয়া বলেন?
- হ্যাঁ বলব। আমাকে দিতে হবে কিন্তু, তুমি কথা দিয়েছিলে আমাকে।
- হ্যাঁ, দিব তো ভাইয়া।
- একটা হল, তুমি বিয়েটায় রাজি হয়ে যাও। তোমার আব্বু আম্মু অনেক খুশি হবে তাহলে। তারা আমাকে এই এতো বছরে অনেক ভালবাসা দিয়েছেন। তাদের মুখে অতটুকু খুশি দেখতে পারলে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান লাগবে।তুমি কথা দিছ রাখবে।
তনুর গাল বেয়ে অকারণেই পানি পড়ছে। হাসিব ভাইয়া, তাহলে তনুকে কখনও ভালবাসেনি। কত সহজেই বিয়ে করে ফেলতে বলছে। গাল দিয়ে পানি ঝরাতে ঝরাতেই তনু বলল, আর পরেরটা?
- আমি তো তোমাকে এই মাসে মাত্র ৩ দিন পড়িয়েছি।তুমি তো শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। আর দেখা হবে না। পড়ানও হবে না। আন্টিকে বলে যদি এই মাসের পুরো টাকাটা দিতে ভাল হত। হাতটা একেবারে খালি।
তনুর মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। একেবারেই স্তব্ধ। গালের পানি গুলো মুছে বার বার নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, এই কান্নার কোন মানে নেই। ভুল একটা বিশ্বাসে এতদিন তনু ছিল।গালটা মুছতে মুছতেই তনু হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার দুইটা চাওয়াই পূরণ হবে। আমি ঐ ছেলেকেই বিয়ে করছি। আর এই মাসের পুরো টাকাই আপনি পাবেন। আসি ভাইয়া।
তনু চলে গেল। হাসিব হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এখন আর এই হাসির অভিনয়ের কোন দরকার নেই। বুকের ভিতরের কষ্টগুলোকে আর কতক্ষণ চাপা রেখে থাকা যায়? ভালবাসি বলা হয়নি, তবে সত্যি অনেক বেশিই ভালবাসে ও তনুকে। তবে এই ভালবাসা হয়ত কখনও পূর্ণতা পাবার না।তনুর অনেক ভাল ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে। অনেক টাকা, হাসিবের মত ৩ দিন পড়িয়ে পুরো মাসের টাকার জন্য, আকুতি মিনতি করতে হয় না। ডাক্তার মানুষ, হাসিবের মত জ্বর এলে তনুর মাথার কাছে চুপচাপ সানগ্লাস পরে কাঁদবে না সে, চিকিৎসা করবে। চুপচাপ মাথায় হাত দিয়ে শুধু জ্বর মাপবে না, ভাল করে দিবে। কৃমির অজুহাত দিয়ে না খেয়ে থাকবে না, তনুকে মুখে তুলে খাইয়ে দিবে। খুব কান্না পাচ্ছে হাসিবের। পকেট থেকে সানগ্লাসটা বের করল। সানগ্লাস পরে কাঁদছে হাসিব। তনু বুঝতে পারছে না। সানগ্লাস চোখের জল আটকাতে পারে না। তবুও পরে আছে হাসিব।সব কিছুর পিছনে যুক্তিগত কারণ থাকে না।কিছু মনের সান্ত্বনা। সানগ্লাস চোখে দিয়ে চোখের জল আড়াল করার সান্ত্বনা। তনুকে হাসি মুখে অন্য জনের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে, তনুকে সুখী দেখার মাধ্যমে নিজের ভালবাসা পাওয়াও তেমনি সান্ত্বনা। সানগ্লাস বেয়ে গাল জুড়ে পানি পড়ছে। কিছু অশ্রু, কিছু ভালবাসা হারাবার বেদনা, কিছু না পাওয়ার ভয়ে তাড়িয়ে দেবার সান্ত্বনা।