একদিন হঠাৎ খুব সম্ভবত হুমায়ুন আহমেদের প্রথম ঈদের নাটক। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান ।দুইজন কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ আর হুমায়ূণ ফরীদি এই নাটকের প্রাণ ।ফরীদি অভিনয়ে আউটস্টান্ডিং বোধ করি তার সমমানের কোন অভিনেতা সেসময়ে বাংলানাটকে ছিলনা পরবর্তীতে ও আসেনি।আর হুমায়ূন আহমেদ তখন উদীয়মান নক্ষত্র। তার আগমনে অন্যরা ম্লান হতে শুরু করেছে ।
স্বচ্ছল ডাক্তার ফরিদ (কাজী খুরশিদুজ্জামান উৎপল) স্ত্রী সোমা (ডলি জহুর), ছোট বোন মিলা (অরুনা বিশ্বাস), ছেলে কাজল (অভি) এবং বদমেজাজী বাবা (আরিফুল হক) ফরিদের মধ্যবয়স্ক, অবিবাহিত এবং কিঞ্চিত পাগলাটে স্বভাবের মামাকে (আলী যাকের) সঙ্গে নিয়ে বাস করেন। বাবাকে প্রচন্ড ভয় পান ফরিদ, সংসারের চাবিকাঠি এখনও বাবার হাতেই এবং বাবা প্রায়ই নানারকম অদ্ভুত নিয়মকানুন জারি করেন। এসব নিয়ে সোমা প্রচন্ড বিরক্ত।ফরিদের বাবা তার নাতির স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন।
ফলশ্রুতিতে লজিং মাস্টারের আভির্ভাব ওই পরিবারে। নর কঙ্কাল হাতে নিয়ে মাথার চুল তেলে লেপ্টানো। লজিং মাস্টার কাজলকে প্রচীন ভারতীয় কায়দায় গুরু শিষ্য পদ্ধতিতে পাঠ দান করবেন।এই চরিত্রে ফরিদী বাংলা নাটকের নতুন মাইল ফলক।
ফরিদের বাবা তার পাগলাটে শ্যালককে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। তার দৃঢ় বিশ্বাস শ্যালকের মাথা খারাপ এবং তার পাগলামীর মাত্রা দিনেকে দিন বাড়ছে।এক পর্যায়ে তাকে তালাবন্ধ করে রাখার হয়।
কাজলকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য মাস্টার একদিন তাকে মিরপুর চিড়িয়াখানায় ছেড়ে দিয়ে আসে যাতে সে নিজেই পথঘাট চিনে ফিরে আসতে পারে।
এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ফরিদের বাবা মাস্টারকেও মামার সাথে একই ঘরে তালাবন্ধ করে রাখেন। দুই ঘন্টা থানা-পুলিশ, হাসপাতাল সব খোঁজাখুজির পর কাজল নিজেই বাড়ি ফিরে আসে।
এর ফাঁকে ঘটতে থাকে অসংখ্য মজার ঘটনা।
এই নাটককে হুমায়ুন আহমেদের মাস্টারপিস বলা যায়। ঈদের নাটকের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে হাসানো আর এই কাজে নাটকটা ছিল দারুন সফল। এটা হুমায়ুন আহমেদের নাটকের কমন ফরমেটের উপরই করা হয়েছে। তার তৈরী করা কিছু চরিত্র আছে, যেগুলি আরও বহুবার বিভিন্ন জায়গাতে ব্যবহার করেছেন। সবশ্রেনীর দর্শক প্রাণ খুলে হেসেছে নাটক দেখে।
বিটিভির নাটকে নানা সীমাবদ্ধতার কারনে প্রযোজকের ভূমিকা খুব বেশি থাকে না। মুস্তাফিজুর রহমান একটা দুর্দান্ত স্ক্রিপ্ট পেয়েছেন এবং চরিত্রগুলিতে একদম সঠিক অভিনেতাদের কাস্ট করতে পেরেছিলেন।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে এক নম্বরে আসবে হুমায়ুন ফরিদী। এক কথায় বলা যায় - আউটস্ট্যান্ডিং। যাই হোক, আশির দশকে তার প্রচুর দুর্দান্ত পারফর্মেন্সকে মাথায় রেখেও বলতে হবে, একদিন হঠাৎ নাটকটা তার সবচেয়ে ভাল কাজগুলির অন্যতম।
হুমায়ুন ফরিদীর পর আসবে আলী যাকের এবং আরিফুল হকের কথা। আরিফুল হক আর আলী যাকেরের শালা দুলা ভাই রসায়ন দারুন ভাবে উপভোগ্য। বাংলা নাটকের মামা চরিত্রে আলী জাকেরই বোধ করি সেরা ।
ডলি জহুরের কাজ ছিল খুব সীমিত। উৎপল, অরুনা বিশ্বাস ঠিকঠাক। অন্যান্য সহঅভিনেতারা ভালই। অভি প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমানের ছেলে। নাটকে একটা ফুটফুটে বাচ্চা প্রয়োজন ছিল, সেই প্রয়োজন সে মিটিয়েছে। এর বেশি তাকে নিয়ে বলার তেমন কিছু নাই।
মাহমুদা খাতুন রহিমার মার চরিত্রে যে কিনা বাড়ির কাজের বুয়া দারুন হাস্য রসের অবতরাণা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এ নাটকে বুয়ার খেদমতে গৃহকর্তী ব্যস্ত।কাজের লোকটিও বুয়ার ফমরমায়েস শুনতে শুনতে ক্লান্ত। অনেকেই বুয়া চরিত্রকেই প্রধান ভেবে বসতে পারেন। তার হুকুম দারী মালিকের চেয়ে কম নয়। মরা কঙ্কাল দেখে তার অজ্ঞান হওয়া দেখে দর্শকরা হাসতে হাসতে আমারে মাইরালার মতন অবস্থা।
হুমায়ূন আহমেদ কাজের বুয়া আর মালিকের রসায়নটা হিউমারাসলি তুলে ধরলেও সেখানে নিদারুণ বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে।
ফরীদি,আলী জাকের ঘরে তালা বন্দি ফরীদির টয়লেট চেপেছে মামার কাছে টয়লেট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে আর হাটছে।ফরীদির হাটা ভঙ্গি আর চেহারা।
আলী জাকের পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়েছে পত্রিকায় এক স্বাস্থকর্মী মহীলার আগমন তাকে পাত্রী মনে মামার খুশি আর ধরে না ।খুশি হওয়ায় মিলিয়ে যায় যখন মামাকে টিকা দিয়ে দেন। ফরীদিকেও তা নিতে হয়। টিকা নেয়ার সময় ফরীদির এক্সপ্রেশন।
ফরীদির শিক্ষাদান পদ্ধতি।নরকঙ্কাল রাতের বেলা দেখে নিজেই ভড়কে যান। সেটি চাদাবৃত করে ভয়ে হিমশীতল হয়ে ঘুমান। কাজের বুয়া রহীমার মা চাদর খুলে কঙ্কাল দেখে ফিট খান।জ্ঞান ফিরে আবারও কঙ্কাল দেখে আরেক দফা ফিট খান।
এই দেখে দর্শকরাও ফিট খাওয়ার অবস্থা ।
গভীর রাতে মামারখাট ভেঙে নিচে পরে যাওয়া।সর্বশেষ যে ছেলেকে ট্রাকে চাপা পড়ারর ভয়ে বাড়িতে পুরানো ভারতীয় রীতিতে শিক্ষা দান তাকে চিড়িখানায় একা ছেড়ে দিয়ে মাস্টর মশাই ঘরে বসেআছেন।বাসার সবাই চরম বিচলিত। থানা পুলিশ অনেক খুজাখুজি করেও সবাই যখন ব্যর্থ ।কাজলএকাই বাসায় এসে হাজির।নাটকের শেষ মিলি আর লজিং মাস্টারের মিলনের মধ্য দিয়ে। যে মিলি মাস্টারকে বাক্যবানে বিদ্ধ করেছে সেই মিলি লজিংমাস্টারের প্রেমে ফিদা।মাস্টর মশাই রাতের তারা দেখায় আর কবিতা আবৃত্তি করে।
এই এক খানি নাটক দেখলেই অনধাবন করা সম্ভব বাঙলা নাটক কতটাউচু মানের ছিল ।আর হুমায়ূনআহমেদ ও হুমায়ূন ফরীদি দুজনের সমন্বয়ে নাটকটা কতটা উপভোগ্য ও প্রাণবন্ত হয়েছে। হালের বস্তপচা নাটকের চেয়েএ নাটকটি বারবার দেখা ঢের ভাল এট লিস্ট প্রাণ খুলে হাসা যায়। বিস্ময় নিয়ে ফরীদির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।হুয়াট এ গ্রেট এক্টর হি ওয়াজ।
হুমায়ূন আহমেদ অমর কথা শিল্পী ।আগামী ১৯ শে জুলাই তার মৃত্যু বার্ষীকি ।তাকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি।আজ ফরীদিও নেই হুমায়ূন আহমেদও নেই। রয়ে গেছে তাদের অমর সৃষ্টি।তাদের বিদেহী আত্নার প্রতি শুভকামনা থাকলো।তারা আমাদের অসামান্য আনন্দদায়ক মুহূর্ত উপহার দিয়ে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।