১
আজ অনেক দিন পর লিখতে বসা। কলম শুধু এ হাত থেকে ও হাত। এ আঙ্গুল থেকে ও আঙ্গুলে যায়। খাতার ওপর একটা শব্দ বৈ কিছু লেখা হয়নি। শব্দটা লেখার পর বসে আছি কিভাবে শুরু করবো। ছোটকালের ইংরেজী রচনা পড়ার মত উল্টো করে শুরু করবো কিনা সেটাও ভাবলাম। অনেক ভাবনায় জট পাকিয়ে কিছুই আর লেখা হচ্ছে না। সকালের নাস্তা সেরে বসেছিলাম। স্ত্রী চা দিয়ে গেছে কখন টেরই পাইনি। কাপের গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম সেটা কোল্ড টি হয়ে গেছে।
একটু পর কলিং বেল এ শব্দ হলো। তিনবার শব্দ। বুঝে গেলাম বুয়া এসে গেছে। আমাদের বাসার গেটে সব সময় কিছু বাচ্চা খেলাধূলা করে। তাদের খেলার অংশ হিসেবে কলিং বেলে চাপা নিয়মিত রেওয়াজ। তাই বাধ্য হয়েই কলিং বেলের তিন শব্দ। বুয়া বাসায় ঢুকে গেছে। সাথে তার একমাত্র পুত্র এসেছে। বুয়ার নামটা বলা উচিত। পাখি। প্রথম আমাদের বাসায় কাজ নেয়ার সময় নাম জিজ্ঞেস করলে এ নামটাই বলেছিল সে। তার মানে এ নামটাই পাকাপোক্তভাবে তার জীবনে সেটে গেছে। প্রথম প্রথম হাসি পেলেও পরে বোধোদয় হয়। কারো নাম শুনে হাসা উচিত নয়। তার বাবা মা আদর করে হয়ত এ নামেই ডাকতো। আসল নামটা হারিয়ে যায় কালের অতলে। এটাই তার প্রিয় নামে পরিণত হয়।
লেখার প্রসংগে আসা যাক। আজ মা শব্দটা লিখে কেমন জানি উন্মনা হয়ে বসে আছি। সত্যি কথা বলতে কি মাকে নিয়ে কখনো কোন আদিখ্যেতা দেখাই নি। কখনো বলিনি ভালবাসি মা তোমায়। সেই ছোটকালে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা'ই আমার বাবা এবং মা দুটোই। আমার সকল আবদার দু'জনার হয়ে একজনই মেটাতো।
এইচএসসি লেভেল পর্যন্ত গ্রামে বাস। তাই মায়ের সঙ্গে জীবনের বিশাল একটা অংশ কেটে গেছে। আমার মা ঠিক গ্রামের একজন সরল সাধারণ মা। মার মুখে কোন দিন কোন প্রসাধনী দেখিনি। যখন রাগ হতো আকাশ বাতাস ভারী করে চিৎকার করতো। আবার অল্প দুখেই কাতর হয়ে কান্নাকাটি শুরু করতো। সকালের সোনারোদ্দুর দেখে ধান শুকাতো। ধানের খড় শুকাতো গোয়ালের গাভীটির জন্য। বৃষ্টি এলে ভিজে চুপসে ধান উঠাতো। কালবোশেখী ঝড় উঠলে ঘরের নড়বড়ে খুটি ধরে লা ইলাহা ইল্লা আন্তা পড়তো। আবার ঝড় থেমে গেলে আঙ্গিনা ঝাট দিতো। তাই ঝড় বৃষ্টি দেখলে আমার সুখের কোন স্মৃতি মনে পড়ে না। মনে পড়ে ঘরের ছাউনি ঝরা পানির কথা। খাট তোষক ভিজবে বলে পানি সামলানোর জন্য পাতিল এগোনোর কথা। বৃষ্টি এলে বৃষ্টির গান গেয়ে খিচুড়ি খাওয়ার কথা বললে আমার মায়ের একবেলা উপোস থেকে আর একবেলা খাওয়া মুখটা মনে পড়ে যায়। চুপিচুপি খাওয়ার অভিনয় করে আমাকে তিনবেলা খাওয়ানোর কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় হাস মুরগী গরু ছাগল বেচে আমার পড়াশুনার খরচ মিটানোর কথা।
এইচএসসি লেভেল শেষে শহরের দিকে ধাবিত হলাম। মা পড়ে রইলো সেই মাটির বাড়ি ঘর আগলে। পড়াশুনা শেষ করে এখন একটা চাকুরী করি। সেই চাকুরীতে কোন রকম খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। স্ত্রীর চাকুরীটা না থাকলে হয়ত পথে থাকতে হতো। মাস শেষে কোন উদ্ধৃত তো থাকেই না। উল্টো টানাটানি হয়ে যায়। সামান্য বাড়তি খরচে সংসারে আরও টানাটানি বৃদ্ধি পায়।
মায়ের জন্য সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়ে খালাস। মাস পার। প্রজন্ম পুরানো বলে সে আমাদের সংসারে এসে খাপ খাওয়াতেও পারেনি। তাছাড়া আমরা যেখানে সময় দিতে পারিনা। সেখানে সে থেকেই বা কি করবে। অল্পতেই হাফ ধরে যায়।
বাবা আমাকে গ্রামে রেখে আয়। আমি এখানে নি:শ্বাস নিতে পারছি না।
অবশেষে তাই হলো। মাটির মানুষ মাটির বুকেই মানানসই। গ্রামে মাটির অভাব হয় না। খোলা হাওয়ার অভাব হয় না। মনের কথা খুলে বলার লোকের অভাব হয় না তার।
২
পাখির ছেলের নাম রাব্বী। চার বছরের মত বয়স। এতক্ষণ শোফার একটা কুশন দিয়ে মেঝেতে শুয়ে ছিল। যতক্ষণ ওর মা এখানে থাকে সে শরীর মন্দ থাকলে বা ঘুম আসলে এভাবে শুয়ে থাকে। বাকীটা সময় টিভিতে কার্টুন দেখে।
প্রায়ই তার মার মুখ থেকে শুনি দাঁতের ব্যথায় সে বেজায় কাতর। আজ এসে বললো-
তার একটা দাঁত পোকায় খেয়ে ফেলছে।
মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বললো একটা দাঁত নষ্ট হয়ে গেছে। উঠায় ফেলতে হবে।
-আমি বললাম ডাক্তার যখন উঠাতে বলছে উঠায় ফেলতা। বাচ্চা মানুষ। দুইদিন পর এমনিতেই দাঁত গজাতো।
না ভাইয়া। আমি শুনেছি দাঁত উঠালে ব্রেন্টে আঘাত পাইবে।
কি আর করা। মায়ের সংশয়যুক্ত বানীর কাছে আমার যুক্তি মার খেয়ে যায়। আমি আর কথা বাড়াই না।
৩
পরের দিন সন্ধ্যার দিকে পাখি এসেছে। আমার স্ত্রী সান্ধ্যকালীন নাস্তা হিসেবে এক বল মুড়ি মাখা নিয়ে আসলো। রাব্বীর জন্য আলাদা বাটিতে দেয়া হয়েছে। সেই মুড়ি খেতে গিয়ে রাব্বী দাঁতে ব্যথা পেয়ে চিল্লায় উঠলো। পাখি দৌঁড়ায় এসে রাব্বীকে কোলে তোলে নিলো। আমার স্ত্রীকে বললো-
আফা আমার কাজ তো শেষ হলো না। একটু কষ্ট করে করে নিবেন। আমি রাব্বীকে নিয়ে এখনি মেডিকেলে যাচ্ছি। আল্লায় জানে আজকে গেলে ডাক্তার আবার দাঁতটা উঠায় ফেলে কিনা! আমার রাব্বীর না জানি ব্রেন্টে লাগে কিনা! এই বলে সে বাসা থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল।
এদিকে আমার গল্পটা এখনো তেমনভাবে শুরুই করতে পারিনি। আজকে কিছুদূর লিখেছিলাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর এগোলো না। মায়ের জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে খাতা কলম গুটিয়ে রেখে দিলাম।
ছবি: নিজস্ব এ্যালবাম।