পূর্বের সারসংক্ষেপ: স্কুল থেকে এসে এপার্টমেন্ট ম্যানেজার এবং তার আনা মিস্ত্রীকে দেখে আমরা অবাক হয়ে গেলাম।
কানাডায় এপার্টমেন্ট ম্যানেজার বাড়ির কাজে ভাড়াটিয়ার অনুপস্থিতিতে আসতে পারেন। কয়েকবার নক করেন, যদি ভেতরে ভাড়াটে না থাকে ঢুকে পড়েন।
পূর্বের পর্বগুলোর লিংক:
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (১) - প্রথমবার প্রবাসে প্রবেশের অনুভূতি!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (২) - জীবনের গল্প শুরু হলো এইতো!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৩) - সুখে থাকতে কিলায় ভূতে! (কুইজ বিজেতা ঘোষিত)!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৪) - বাংলাদেশ ভার্সেস কানাডার দোকানপাট, এবং বেচাকেনার কালচার! (কুইজ সলভড)!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৫) - কেমন ছিল কানাডিয়ান স্কুলে ভর্তি হবার প্রস্তুতি পর্ব?!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৬) - কানাডিয়ান স্কুলে ভর্তির ইন্টারভিউ অভিজ্ঞতা!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৭) - কানাডার স্কুল ভ্রমণ এবং দেশীয় মফস্বলের স্কুলের টুকরো স্মৃতি!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৮) - কানাডার প্রথম খারাপ অভিজ্ঞতা!
পূর্বের সিরিজের লিংক: কানাডার স্কুলে একদিন এবং কানাডার স্কুলে একেকটি দিন
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কানাডায় এসে প্রথম প্রথম একটা তীব্র ঘ্রাণ নাকে এসে লাগত। ঘ্রাণটি ভালোও না খারাপও না; সুগন্ধ, দূর্গন্ধ ক্যাটাগরিতে ফেলার মতো না। ব্যাস অপরিচিত একটা স্মেল। আমাদের বারান্দার একটু সামনেই অনেক গাছ গাছালি ছিল। মা বলত সেসব থেকেই বোধহয় আসে। আমি এটাকে "বিদেশ" ঘ্রাণ বলি। বারান্দায় দাড়ালে তো তীব্রভাবে বোধ করিই, তাছাড়া বাইরে কিছুক্ষন হাঁটলেও এর উপস্থিতি টের পাই। আমি বাংলাদেশ ও কানাডায় মাটির কাছে বসে অনেক সময় কাটিয়েছি। দু দেশের ঘাস ও মাটির গন্ধটা আলাদা। এটার বৈজ্ঞানিক, ভৌগোলিক কারণ অবশ্যই আছে। তবে আমি অতো কিছু ভাবিনা, শুধু জানি, "দেশ" ও "বিদেশ" ঘ্রাণ। একটি ফেলে আসা পরিচিত, আপন, আদুরে ঘ্রাণ, আরেকটি নাকের কাছে আসা অচেনা, তীব্র, কৃত্রিম একটি ঘ্রাণ।
তখন কানাডায় মাসের কিছু কম সময় হয়েছে। আমি প্রথম সপ্তাহে "বিদেশ" ঘ্রাণ যতটা তীব্রভাবে অনুভব করতাম, এখন আর করিনা। সয়ে এসেছে। দিনগুলো কেটে যাচ্ছে কোনভাবে। কোনদিন বাবা মার সাথে ইমিগ্র্যান্টদের সাহায্য অথবা ডকুমেন্টস রিলেটেড অফিস, ব্যাংক, মার্কেটে যেয়ে। আর যদি বাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হয় তবে ইউটিউবে নাটক, সিনেমা দেখে। স্কুল শুরু হতে বেশ কিছুদিন বাকি। সেই যে এডমিশনের জন্যে গেলাম, এরপরে আর যাওয়া হয়নি। যখনই মনে হচ্ছে সেই উদ্ভট ড্রেস ও চুলের ছেলেমেয়েদের সাথে ক্লাস করতে হবে, ভয় পেয়ে যাচ্ছি। দিনগুলোতে এক ধরণের অবসাদ, বিষণ্ণতার ছোঁয়া লেগে আছে। দেশীয় মায়ামাখা পরিবেশ, আপনজন ও "দেশ" ঘ্রাণকে খুব মনে পড়ে। কানাডাতেও এমনকিছু মজা হচ্ছেনা। শুধু কাজ আর কাজ!
যদিও একটা বিষয় আমি খুব উপভোগ করছি। আমার বাবাকে জীবনে প্রথমবার বাসন মাজতে দেখলাম এখানে এসে! বাংলাদেশে কাজের লোক ছিল মা কে সাহায্য করার জন্যে। এজন্যে বাবা কখনো রান্নাঘরে পা রাখেনি। রান্নাঘরে কোথায় কি আছে কিছুই জানত না। একটু পানি আনতে গেলেও মা অথবা কাজের লোক জলদিই এনে দিত। যেন বাবা রান্নাঘরের কোন কাজ করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!
কিন্তু কানাডায় আসার পরে "বাবা ঘরের কাজ করতে পারবেনা" এই অলিখিত নিয়মটা হুট করেই উধাও হয়ে গেল! বাবা মাঝেমাঝেই বাসন মেজে দেয়। রান্নায় মা কে সাহায্য করে। মা কে আবার আইডিয়া দেয়, মাংসের সাথে এই সবজিটাও দিয়ে দাও, বা ডালে এই মশলাটাও ভালো লাগবে। মা গরম চোখে তাকায়, "তুমি বেশি জানো? এমন কম্বিনেশনে রান্না হয়?" বাবা অসহায় হয়ে বলে, "ট্রাই করতে দোষ কি?" মায়ের রাগান্বিত চেহারা দেখেও বাবা হতাশ না হয়ে আইডিয়া দিতেই থাকে। তবে সেসব উদ্ভট রেসিপি মায়ের কল্যাণে কখনো খেতে হয়নি।
দেশে রান্নাঘরটা ছিল ঘরের এক কোণায়। ডাইনিং ও ড্রয়িং রুম থেকে অনেক দূরে। কানাডায় ডাইনিং এবং কিচেন একই সাথে। ড্রয়িং রুম ও কিচেনের মধ্যেও আলাদা কোন দরজা নেই। ওপেন কিচেন কনসেপ্ট আরকি। মা খুবই রাগ করে। কি নিয়ম! মেহমানের সামনেই ঘাম, মশলায় মাখামাখি হয়ে রান্না করতে হবে! যত্তসব! আমি মায়ের কথা শুনে হেসে দেই।
মা যতোই রাগ করুক এই ওপেন কিচেন কনসেপ্ট সবার মনটাকে ওপেন করে দিয়েছে।
দেশে থাকতে হুমায়ুন আহমেদের একটা লেখায় পড়েছিলাম, পরিবারের বাবা মনে মনে বলছেন, সংসারে দুটো গ্রুপ হয়ে গেছে। মা ও মেয়েদের একটি গ্রুপ এবং আরেকটি গ্রুপ বাবার।
পড়ে মনে হয়েছিল, সত্যিই তো! বাবার বলা অফিসের গল্পগুলোও খুব বোরিং লাগে, কিন্তু মায়ের সাথে সারাক্ষন গুজুর গুজুর চলতেই থাকে। বাবা সকাল থেকে রাত কাজে বাইরে থাকার কারণে সন্তানদের কাছে যেন অপরিচিত হয়ে যান। যেকোন টিভি অনুষ্ঠান মা, মেয়ে একসাথে দেখে, বাবা খবর ও খেলা দেখেন একা একা। বাবাকে সেভাবে পাওয়াই যায় না তাই মাই হয় সন্তানের বেস্ট ফ্রেন্ড। বেচারা বাংলাদেশী বাবারা, সংসারের জন্যে খেটে সংসার থেকেই যেন আলাদা হয়ে পড়েন!
আমাদের পরিবারও ভিন্ন কিছু ছিলনা। দেশে থাকতে বাবা মা দুটো দল হয়ে কাজ করত। মানে মা সংসারের সামলাবে ঘরের অভ্যন্তরীণ সব, আর বাবা সামলাবে বাইরের সব কিছু। কিন্তু বিদেশে আসার পরে তারা এক দল হয়ে গেল। বাবা নতুন দেশের কোন জায়গা চেনে না, চাকরি নেই। মাও ভিনদেশে অস্বস্তি বোধ করে। দুজনে মিলে দুজনকে হেল্প করতে শুরু করে দিল সবকিছুতে! বাবার যেকোন কাজে মাও সাথে সাথে বাইরে যাচ্ছে, বাবাও সারাক্ষন রান্নাঘরে ঘুরঘুর করছে। বহুদিন পরে মেয়ে, স্ত্রীর সাথে সময়ে পেয়ে বাবার চোখেমুখে একটা পরিতৃপ্তি দেখতে পাই। আর মা? সেই একই, মেজাজ দেখায় সবকিছুতে, কিন্তু মনে মনে নিশ্চই এই পরিবর্তনে সেও খুশি।
আমি যারপরনাই মজা নিচ্ছি পুরো ব্যাপারটাতে। বাবা মা যেন আমি হবার আগের টাইমটাতে চলে গিয়েছে। একদম নতুন করে সংসার শুরু করার টাইমে! দুজনেরই কপালে চিন্তার ভাজ যে এই নতুন দেশে দাড়াতে পারবে কিনা। আবার একই সাথে একধরণের রোমাঞ্চ দেখতে পাই তাদের চোখেমুখে।
ওপরের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অনুভব করলাম বাস থেমে গেছে। মানে পৌঁছে গেছি! বাস থেকে নেমে কিছু দূর হেঁটে একটা বিশাল বিল্ডিং এর সামনে এলাম। কাঁচের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে রিসিপশনে গেলাম, সেখান থেকে যার সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল তার কাছে।
চশমা পরিহিতা, কোকড়ানো চুলের এক বয়স্কা কানাডিয়ান মহিলা হেসে নিজের রুমে ঢোকার পারমিশন দিলেন। বাবা তাকে জানালেন যে ইমিগ্র্যান্ট সার্ভিস সেন্টার এখানে রেকমেন্ড করেছে। তিনি সাথে সাথেই যেন ব্যাপারটা বুঝে গেলেন! বাবা মা এবং আমাকে আমাদের পড়াশোনা, পেশার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। বলা হলো সব।
তিনি বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললেন, "বাহ! তোমরা তো হাইলি এডুকেটেড!"
তিনি জানালেন, "আমাদের প্রতিষ্ঠানে কোর্স আছে যেটা সরকার ফ্রি করে দিয়েছে জবলেস কানাডিয়ান এবং ইমিগ্র্যান্টদের সাহায্যে। সি, ডিফারেন্ট কান্ট্রিস হ্যাভ ডিফারেন্ট ওয়েজ অফ রাইটিং রেজুমেস এন্ড এটসেটরা। আমাদের এখানে কানাডিয়ান সিস্টেমে রেজুমে লেখা, ইন্টারভিউ্যুতে কথাবার্তা, ম্যানারস, জব মার্কেট সম্পর্কে শেখানো হয়। নানা দেশের মানুষের পাশাপাশি কানাডিয়ানরাও এই কোর্সটিতে ভর্তি হয়।" থেমে আরো যোগ করলেন, "এটা একটা ক্র্যাশ কোর্স, মানে প্রতিদিন লম্বা সময় ক্লাস চলবে, কয়েক মাসে শেষ হয়ে যাবে, এবং অনেক বিষয় কভার করবে ইনস্ট্রাকটরেরা।"
ফ্রিতে এমন সাহায্যে বাবা খুবই খুশি হয়ে গেল। বাবা সাথে সাথে ভর্তি হতে চাইল।
সেই মহিলা বললেন, "তুমি আর তোমার ওয়াইফ ভর্তি হয়ে যাও। তোমাদের মেয়ে যখন স্কুল শুরু করবে এসব স্কুল থেকেই শিখে যাবে।" বলে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। আমিও হাসিতে রসগোল্লা, কালোজাম মিশিয়ে ফেরত দিলাম।
মা বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে। মা চাচ্ছে বাবা যেন বলে যে মা কোর্স করবে না। বাবা কিছুই বলছে না! মা নিজেও গুছিয়ে বলতে পারেনা ইংলিশ, কি বলবে না বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে আছে।
বাড়িতে আসতে আসতে আমি তো হেসেই বাঁচিনা। সেই মহিলা ভেবেছেন মায়ের মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষও নিশ্চই জব করবে। এজন্যে আর জিজ্ঞেসও করেনি! নিজেই সবকিছু বলে গেলেন, ভর্তি করে দিলেন। মায়ের চেহারা যা হয়েছে! দেখার মতো! হিহি।
বাসায় এসেই মা বাবাকে বলল, "তুমি বললে না কেন যে আমি ভর্তি হবো না? আমি তো বাড়িতেই থাকি, এসব শিখে আমার কি হবে!?"
বাবা বলল, "আহা বোঝার চেষ্টা করো, এখানে দুজনকেই জব করতে হতে পারে। বাড়ি ভাড়া আর মাসিক খরচ কত দেখছই তো। ফ্রিতেই এমন একটা শেখার সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন? আর কিছু না হোক সবার সাথে উঠতে বসতে পারবে সহজে। এত জড়তা থাকলে তো হবেনা এদেশে।"
মা বলল, "আমি এতদিন ঘরের মধ্যে বন্দি, এখন হুট করে বললে তো হবেনা। দেশেও তো চাকরি করতাম না, পড়াশোনা শেষ করে কত বছর হয়ে গেল। এখন এই বয়সে এসে, ভিনদেশে, সম্ভব এটা?"
বাবা বলল, "লক্ষ্মী তুমি একটা দিন যাও, ভালো না লাগলে ওরা তো আর ধরে রাখবেনা। আর ফ্রিইতো! ওদের সরকার কতো হেল্পফুল ভাবো একবার!"
মা রেগে বলল, "রাখো তোমার ফ্রি, ফ্রিতে পেলে তুমি আলকাতরা খেয়ে ফেলবে। আমি যাব না, ওদের ভাষাই তো বুঝিনা, যেয়ে কি করব? বোকা হয়ে বসে থাকব? তুমি এসব নাটক দেখতে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ?"
এসব শুনতে শুনতে বোরড হয়ে আমি আমার ঘরে চলে গেলাম। তাদের আলোচনা চলতেই থাকল। শেষমেশ মা হ্যাঁ বলল। একদিন যাবে শুধু বাবাকে সাপোর্ট দিতে, এই শর্তে। সব ঠিকঠাক।
আমি তো খুবই এক্সাইটেড। বাবা আর মা আবারো পড়বে! তাও আবার একসাথে! অনেকে ক্লাসমেটের সাথে প্রেম করে বিয়ে করে, আর আমার বাবা মা বিয়ের এতদিন পরে ক্লাসমেট হতে যাচ্ছে! হাহাহা!
ডিনার করতে করতে মা হুট করে বলল, "একটা বড় সমস্যা আছে! এটা তো আমি ভাবিইনি! না আমি যাচ্ছিনা কোনভাবেই। তুমিই যাও ট্রেনিং নিতে।"
বাবা আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম, আবার কি হলো????
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কুইজ: মা কোন সমস্যাটির কারণে বিশেষভাবে যেতে চাইছেন না?
কুইজটি সহজ, পাঠক পারবেন আশা করছি।
আগেভাগে এটাও বলে দিচ্ছি শেষ পর্যন্ত তাকে বুঝিয়ে পাঠানো হয়! একজন গৃহবধুর জন্যে নিজ দেশেও হুট করে বাইরের দুনিয়ায় জব বা পড়াশোনা করাটা ভীষনই চ্যালেঞ্জিং। আমার মা বিদেশে সেই চ্যালেঞ্জ ফেস করেছেন। এজন্যে তাকে নিয়ে গর্ব করি। মায়ের মতো অন্যসব প্রবাসী নারীদের প্রতিও সম্মান থাকল। আমার স্কুল দিনগুলোর কথা তো আগের সিরিজে জেনেছেন কিছু কিছু, পরের পর্বে আমার মায়ের কানাডিয়ান ক্লাসের দিনগুলোর ব্যাপারে জানবেন। তার প্রথম দিন কেমন গেল এবং প্রথম দিনটির পরে আরো দিন ছিল কিনা সেসব নিয়ে লিখব। টিল দেন বাই!

কুইজের উত্তর ৩০ নাম্বার মন্তব্যে দেওয়া হয়েছে, কৌতুহলী পাঠক চেক করে নেবেন।

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৮ ভোর ৬:৪১