আমি আজকের পর্বটি বিশেষ মজা এবং উত্তেজনা নিয়ে লিখেছি। কেননা অনেকদিন পরে ফিরিয়ে আনছি আমার কানাডিয়ান স্কুলকে! কানাডা স্কুল সিরিজের পাঠকগণ, যারা মিস করছিলেন স্কুলটিকে, তারা প্রস্তুত হয়ে যান আবারো স্কুলের ঝলক পেতে!

পূর্বের সারসংক্ষেপ: পরিবারের সবাই মিলে কানাডিয়ান সুপারস্টোরে গেলাম। ভীষন সুন্দর ও বিশাল সুপারস্টোরটি মুগ্ধ করে দিলেও, চওড়া বিল মেটাতে গিয়ে সবারই মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল!
পূর্বের পর্বের লিংক: তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৪) - বাংলাদেশ ভার্সেস কানাডার দোকানপাট, এবং বেচাকেনার কালচার! (কুইজ সলভড)!
পূর্বের সিরিজের লিংক: কানাডার স্কুলে একদিন এবং কানাডার স্কুলে একেকটি দিন
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কানাডায় এসে বেশিদিন হয়নি, তবে এরমধ্যে পুরো পরিবার প্রচুর কাজ করেছে। নানা রকম ডকুমেন্টস, কার্ডের জন্যে এপ্লাই করেছে। রান্নাঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সুপারস্টোর থেকে কেনা হয়েছে। রিসেন্টলি আরেকটি জরুরি কাজ হয়েছে। তা হলো ইন্টারনেট কানেকশন নেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেট আসার পর থেকে সারাক্ষন দেশীয় গান, নাটক ইউটিউবে চালানো হচ্ছে। বেশ দেশী দেশী একটা ভাব এসেছে বাড়িতে। দেশীয় পেপার পড়ে দেশের কোথায় কি হচ্ছে জানা যাচ্ছে। লাস্ট কিছুদিন যেন নিঃশ্বাসই আটকে ছিল দেশ থেকে পুরোপুরি ডিটাচড হয়ে!
এখন আরেকটি জরুরি প্রজেক্টে পরিবার হাত দিয়েছে। সেটা হচ্ছে "মিশন স্কুল!" মা যেদিন প্রথম কানাডায় আসার ব্যাপারে জেনেছিল, সেদিন থেকে প্রতিটি দিনই বাবাকে বলেছে, "ওখানে গিয়ে ওকে জলদিই স্কুলে ভর্তি করাতে হবে।"
তখন মায়ের চোখমুখে ভীষন একটা চিন্তা দেখতে পেতাম। বেচারি মা! তার মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামে পড়া মেয়েটি ঢাকা দেখলেই ভয় পায়। সে কানাডার হাই স্কুলে কিভাবে একেকেটি দিন পার করবে, আদৌ চান্স পাবে কিনা সে চিন্তায় স্থির হতে পারছে না।
বাবা আগেই কারো কাছ থেকে বাড়ির কাছের হাই স্কুলটির নাম জেনে নিয়েছিল। এক সকালে, নেট থেকে স্কুলটির ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করলেন। স্কুলের রিসিপশনিস্ট ফোন ধরেছিলেন, তাকে বাবা বেশ কিছুক্ষন ধরে সবকিছু বললেন। সেই রিসিপশনিস্ট জানালেন যে তাদের স্কুলে অন্যান্য দেশ থেকে আসা স্টুডেন্টদের জন্যে বিশেষ কাউন্সিলর আছে। তার সাথে এপয়েন্টমেন্ট করলে সবচেয়ে ভালো হয়। বাবা সম্মতি জানালে তিনি এপয়েন্টমেন্ট সেট করে দিলেন।
আমাকে বাবা মা বলল যে কদিন পরে কাউন্সিলরের সাথে মিট করতে হবে। আমি যেন অংকের সূত্র, বিজ্ঞানের থিওরিগুলো রিভাইজ দেই। সমাজবিজ্ঞান, ফ্রেঞ্চ বা অন্যকোন সাবজেক্ট নিয়ে প্রশ্ন করলে বোঝানো যাবে যে আমাদের দেশে এসব শিখিনি। কিন্তু অংক এবং বিজ্ঞান সবদেশেই এক। আর ইংলিশটা বেশি বেশি প্র্যাকটিস করতে বললেন। একদমই কিছু না জানলে ওনারা স্কুলে নেবে না, আর নিলেও নিচের গ্রেডে দিয়ে দেবে! দেশ থেকে অংক, বিজ্ঞানের পাঠ্যবই এবং ইংলিশ শেখার প্রচুর বই এনেছিলাম। সেগুলো নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিলাম। প্রথম প্রথম পড়ায় মন বসছিল না। কানাডায় আসব আসব করে লাস্ট কমাসে সেভাবে পড়াই হয়নি। তবে কোনভাবে জোর করে মনটাকে বসালাম পড়ায়। যদিও টেনশনে মনটা বারবার ছুটে যাচ্ছিল।
পড়ছিলামই, এমন সময়ে মা আমাকে বলল, আজ বিকেলে স্কুলে যেতে হবে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, এপয়েন্টমেন্ট তো কয়েকদিন পরে! মা বলল, "আজ গিয়ে শুধু দেখে আসব, যাতে সেদিন ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে লেট না হয়। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আর মনে মনে খুশি হলাম। নতুন স্কুলটি দর্শন হয়ে যাবে আজই!
মাথার ওপরে সচ্ছ নীল আকাশ এবং চারিদিকে পাহাড়ের বেড়াজালে আবদ্ধ ভীষনই সুন্দর, স্নিগ্ধ একটি বিকেলকে সাথী করে যাত্রা শুরু করলাম।
বাবাকে বললাম বাবা আমরা ট্যাক্সি নেব না?
বাবা বলল, "মা, সেদিন পথে এপার্টমেন্ট ম্যানেজারের সাথে দেখা হইছিল, কথায় কথায় জানে নিছি যে স্কুলটা বাড়ির খুব কাছে, সে রাস্তা বোঝায় দিছে।"
আমি বললাম, "ওহ আচ্ছা আচ্ছা!"
আমি আর মা ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি বাবাকে ফলো করতে করতে। রাস্তাঘাট বেশ ব্যস্ত ছিল, কাজ শেষে ঘরে ফিরছে মানুষ। আমাদের আশপাশ দিয়ে মানুষজন কানে হেডফোন দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি। স্কুলের দেখা মেলেনা।
মা বাবাকে বলল, "ঠিকমতো এগোচ্ছি তো? কাউকে জিজ্ঞেস করে শিওর হয়ে নাও না।"
বাবা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, এক হোয়াইট মধ্যবয়স্ক পুরুষ এদিকেই আসছে। বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কাছেকোলে হাইস্কুল আছে কি?
সেই ভ্দ্রলোকটি এমনভাবে আমাদের দিকে হাসলেন, যেন আমরা তার কতদিনের পরিচিত! তারপরে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে ভরভর করে কিসব যেন বললেন। আমি ওনার একসেন্ট তেমন একটা বুঝলাম না। মনে মনে ভাবছি এত সুদর্শন লোক, এত মিষ্টি হাসি, এর মুখ দিয়ে এমন কটমটে একসেন্ট বের হয় কি করে?
উনি যাবার পরে বাবার কাছ থেকে জানলাম যে, তিনিও বলেছেন স্কুলটি খুবই কাছে। আমরা ঠিক পথেই আছি। আরো সামনে যেতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে কাহিল অবস্থা। দেশে কখনো পাহাড়ি এলাকায় থাকা হয়নি। এখানে তাই খুব কষ্ট হচ্ছে। যতো সামনে এগোচ্ছি নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষন পর পর "আর কতদূর?" বলে বলে বাবা মার মাথা খারাপ করে দিলাম।
মনে মনে ভাবছি এত দূরের পথকে এরা সবাই কাছে কাছে কেন করছে? বিদেশী দেখে শয়তানি করছে নিশ্চই! বাংলাদেশে যেমন অনেকসময় লোকাল মানুষজন মজা করে ভুল রাস্তা বলে তেমন করে! প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছিলাম।
যদিও পরে বুঝেছিলাম যে এটা কানাডিয়ানদের শয়তানি না দৈনন্দিন অভ্যস্ততা! কানাডিয়ানরা যে পথ দশ মিনিটে পার করবে আমাদের সেই পথ পার করতে ডাবল সময় লাগবে। এর দুটি কারণ। একতো কানাডিয়ানরা বেশি লম্বা চওড়া হওয়ায় বড় বড় কদম ফেলতে পারে। আবার এখানে বেশিরভাগ মানুষ সকালে বা বিকেলে হাঁটতে বের হয়, জিম করে অথবা কোন ধরণের স্পোর্টসে যুক্ত থাকে। তাই শারিরীক স্ট্যামিনা প্রচুর। দ্বিতীয়ত তাদের হাঁটার অভ্যাস থাকে। যাদের গাড়ি নেই তারা বাস স্টপ পর্যন্ত হেঁটেই যাবে। রিকশার বালাই যেহেতু নেই, তাই ১৫/২০ মিনিটের পথ হেঁটে পার করাই এদের কাছে স্বাভাবিক। দেশে থাকতে দুই গলি পরের পাড়ার দোকানে যেতেও, "এই রিকশা যাবেন?" বলার স্বভাব ছিল আমাদের। আমাদের তো কাহিল লাগবেই হাঁটতে।
শেষমেষ অনেকক্ষন হাঁটার পরে বিধ্বস্ত হয়ে স্কুলে পৌঁছালাম। স্কুলটি দেখেই মন খারাপ হয়ে গেল। দেশের স্কুল তো কয়েকতালা বিশিষ্ট ছিল কিন্তু এটা একতালা বিল্ডিং! বাইরে থেকে খুব আলিশান কিছু মনে হলো না। তবে স্কুলের আশেপাশে প্রচুর জায়গা। মাঝখান দিয়ে পিচঢালা রাস্তা এবং তার দুপাশ জুড়ে হালকা সবুজ ঘাস মৃদু বাতাসে উড়ছে।
স্কুলটির সামনে হালকা স্রোতের মতো করে কানাডিয়ান পতাকা উড়ছিল। দেখেই মনটা ধক করে উঠল! এই স্কুলটা যদি আমার হয়েও যায়, দেশটা বিদেশই থাকবে! এখানে লাল সবুজের পতাকায় স্যালুট করে প্রতিটি দিন শুরু হবেনা। কিভাবে এই স্কুলটিকে আপন ভাবব আমি? কেমন যেন অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে! একদিকে রক্তলাল সূর্যটা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে, চারিদিকে অন্ধকার নামিয়ে, অন্যদিকে বিদেশী লাল ম্যাপল লিফের পতাকাটিও আমার মনে অন্ধকার নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে!
বিকেল ছিল বিধায় স্কুল বন্ধ ছিল। জানালার ব্লাইন্ডসগুলো সব নামানো, দরজা লকড। তাই ভেতরটা একদমই দেখতে পারিনি। অবশ্য পরের দিন তো দেখবই, আজ ব্যাস রাস্তাটা চিনে নিতে এসেছি। চারপাশটা একঝলক দেখেই ফিরে আসলাম আমরা।
এপয়েন্টমেন্টের আগের রাতে মা বলল, "আয় ঠিক করি কোন ড্রেসটা পড়বি কালকে?" আমাকে একেকটা দেখাচ্ছে আর মনে মনে বিড়বিড় করছে। এটা না ওটা না করতে করতে একটা হাতে নিয়ে বলছে, "এই হাইনেক শর্ট কামিজটা নে, ওয়েস্টার্নের মতোই দেখতে, তোকে এলিয়েন ভাববে না ওরা।"
তখন আমার মনে আরেক ভয় উদয় হলো। হায় হায়! আমি তো সবার চেয়ে আলাদা পোশাক পরব, আমাকে সবাই কিভাবে নেবে? আমাদের এক আত্মীয় আমেরিকায় গিয়েছিল আমারই বয়সে, সে মাথায় হুড এবং জিন্স প্যান্ট পরত। প্রথম প্রথম ওর সাথে কেউ মিশত না, তাই খুব কান্নাকাটি করত। আর আমি তো একদমই পা থেকে মাথা ট্রাডিশনাল সালোয়ার কামিজ পরি, আমার অবস্থা কি হবে? সবচেয়ে বড় কথা যদি বিদেশী মুভির মতো শর্ট স্কার্ট টাইপের ইউনিফর্ম থাকে স্কুলে? ছি ছি আমি ওসব পরতে পারব না। কি ভীষন অস্থির একটা অস্বস্তিতে সে রাত পার করেছি আমি জানি। বিছানায় শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে এপাশ ওপাশ করেছি, ঘুমাতে পারিনি একদমই।
পরেরদিন সকালে.....
মা মা ওঠো, আমার স্কুলে যেতে হবে।
মা ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল, "কয়টা বাজে?
মা চারটা বেজে গেছে, চলোওও ওঠো!
মা বিরক্ত হয়ে বলল, "এত ভোরে কোন স্কুল খুলবে? সাড়ে আটটায় এপয়েন্টমেন্ট। যা ঘুমা!"
আমি বিরক্ত হয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে পায়চারি করতে থাকলাম। কখন যাব? আমি আর টেনশন নিতে পারছিনা। দেশে সবকিছু জানা থাকার পরেও পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভয়ে কাঁপতাম। আর এখন আমি পড়া তো দূর ভাষাও জানিনা!
ওরা হাসবে আমার ওপরে। মা আমাকে দেশে থাকতেই বলেছিল, দেশে খারাপ কিছু করলে পরিবারের বদনাম, এখানে খারাপ কিছু করলে দেশের বদনাম। আমি যেন এক্সট্রা লক্ষ্মী হয়ে থাকি! ভয় পাচ্ছিলাম এটা ভেবে যে আমি আজ পড়া না পারলে ওরা ভাববে বাংলাদেশের মানুষ পড়াশোনা তেমন জানে না।
এতসব চিন্তায় আমার হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গেলেও, ঘড়ির কাঁটা ভীষন স্লো হয়ে গেল। তবুও সময় ঠিকই চলে এলো। নাস্তা করে সবাই রওয়ানা হলাম। বাবা আর মা পুরো রাস্তায় আমাকে অনেক উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে।
মা নিজেই ভীষন নার্ভাস, কিন্তু আমাকে বলছে, "নার্ভাস হবি না একদম। সব ঠিক হবে। আল্লাহর নাম নে।"
তাদের কথা চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। যে বাইরে নীরব, সে ভেতরে ভীষন সরব থাকে। সেই নিয়ম মেনে আমিও নিজের মনে প্রচুর কথা বলে যাচ্ছি।
(a + b)^3 = a^3 + 3a^2b + 3ab^2 + b^3
(a - b)^3 = a^3 - 3a^2b + 3ab^2 - b^3
I am from Banladesh.
I have immigrated to Canada recently.
Nice to meet you.
এমন অনেককিছু মুখস্থের মতো বিড়বিড় করতে করতে কদম বাড়াচ্ছি স্কুলটির দিকে.....