পূর্বের পর্বের লিংক: তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (২) - জীবনের গল্প শুরু হলো এইতো! অন্যান্য পর্ব এবং সিরিজের লিংকও পেয়ে যাবেন এখান থেকে।
পূর্বের সারসংক্ষেপ: কানাডায় যেয়ে এপার্টমেন্টে উঠলাম সবাই। সেখানে প্রথম সকাল কেটে গেল লাগেজ খালি করতে গিয়ে। পড়ন্ত দুপুরে ফোন কিনতে গিয়ে কিছু মজার অভিজ্ঞতা হলো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধার আলোয় দেশের নানা কথা মনে ঘুরতে থাকল।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
দুদিনের কঠিন জার্নি শেষ করে কানাডায় এসে একটু রেস্ট নেব ভেবেছিলাম। কে জানত আরো বড় জার্নির মধ্যে পরতে যাচ্ছি? এখানে আসার পর থেকে ছোটাছুটিতেই দিন কেটে যাচ্ছে। এখন যেমন যাচ্ছি এক প্রবাসীর দেওয়া ঠিকানায়।
ফোন কেনার পরে বাবা পরিচিত এক প্রবাসীকে ফোন করে যিনি অন্য প্রভিন্সে থাকতেন। পুরোপুরি লস্ট আমাদেরকে তিনি আইডিয়া দিলেন যে এখানে নানা অফিস আছে ইমিগ্র্যান্টদের সাহায্য করে। তেমন কোথাও গেলে ওরা আমাদের সব বুঝিয়ে দেবে কোথায় কিভাবে কি কি করতে হবে। তিনি ইন্টারনেট ঘেটে আমাদের শহরে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দিয়ে দিলেন।
সেখানে গিয়ে রিসিপশনে বাবা সব বললেন যে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, কানাডার জীবন নিয়ে এসিসট্যান্স দরকার। তখন উনি আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বললেন। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরে একজন কানাডিয়ান সোনালী চুলের লম্বা নারী খুব হাসতে হাসতে আমাদের দিকে হেঁটে এলেন। এসেই হ্যান্ডশেক করলেন সবার সাথে।
আমরা কতদিন কানাডায় তা জানতে চাইলেন, যখন বলা হলো যে দুদিন, উনি বললেন, "ওয়াও! ব্র্যান্ড নিউ! ওয়েলকাম টু কানাডা!"
ওনার অফিসে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে বসতে বললেন। অফিসটি ছোট কিন্তু ভীষন পরিষ্কার এবং গোছালো। উনি আমাদের সবার বেশ কিছু তথ্য জানতে চাইলেন। যেমন নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার ইত্যাদি। সবকিছু কম্পিউটারে টাইপ করতে লাগলেন। এখানে এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, যেখানেই যাই নিজেদের হাজারটা তথ্য দিতে হয়। আর সেসব তথ্য তাদের কম্পিউটারে সেভ করে রাখে। এমনকি ফোন কিনতে যাবার সময়েও এমনকিছু হয়েছিল। আমাদের খটমটে বাংলাদেশী নামের বানান অক্ষর বাই অক্ষর বলতে হয়। উচ্চারণে পার্থক্য থাকায় একেকটি অক্ষর অনেকবার বলতে হয়। বিরক্তিকর ব্যাপার।
সব ফর্মালিটি শেষ হবার পরে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের কি ব্যাপারে সাহায্য দরকার।
বাবা বলল, "ম্যাম, একচুয়ালি উই ডোন্ট নো হোয়েআর টু স্টার্ট ফ্রম!"
অভিজ্ঞ উনি সাথে সাথেই যেন সব বুঝে গেলেন! মাথা ঝাঁকিয়ে "ওকে ওকে" বলে একটা কাগজ নিয়ে এক দুই করে পয়েন্ট আকারে লিখতে লিখতে আমাদেরকে অনেককিছু বোঝাতে লাগলেন।
যার সারমর্ম করলে দাড়ায় আমাদেরকে নানা ধরণের কার্ডস অর্জন করতে হবে। কানাডায় এসে এসব কার্ড জোগাড় করা নিঃশ্বাস নেবার চেয়েও বেশি জরুরি!
যেমন সিন কার্ড বা সোশাল ইন্সুরেন্স নাম্বার কার্ড যেটা না থাকলে কানাডায় কাজের জন্যে এপ্লাই করা যায়না। সেই কার্ডটি ছাড়া কানাডায় থাকা সম্ভবই না একপ্রকার।
হেলথ ইন্সুরেন্স কার্ড যেটা থাকলে বেশিরভাগ সাধারণ হেলথ সার্ভিস ফ্রি পাওয়া যায়।
সেটা ছাড়াও আরো নানা ধরণের বেনিফিট কার্ডের কথা বললেন যেগুলো নানাভাবে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করে।
জিজ্ঞেস করলেন আমরা এখন কিভাবে ট্রাভেল করছি? বাবা জানালেন ট্যাক্সি। উনি পরামর্শ দিলেন যে এখানকার বাস এবং ট্রেইন সার্ভিসও বেশ ভালো, আর ভাড়া অনেক কম হবে।
বাস কার্ডের ব্যাপারে জানালেন। বাস কার্ড কিনলে পুরো মাসে যতবার ইচ্ছে টিকেট ছাড়া সেই কার্ড দেখিয়ে বাসে ট্রাভেল করা যায়। অথবা বাসে উঠে ড্রাইভারের কাছ সিংগেল টিকিট ও কেনা যেতে পারে। উনি বললেন, বাস কার্ড বেশি সাশ্রয়ী হবে, যেহেতু আমাদেরকে এখন নানা জায়গায় যেতে হবে।
একটা ব্যাংক একাউন্ট করতে হবে সেটা মনে করিয়ে দিলেন।
কোন কাজটি কোথা থেকে করাতে হবে সেটার ঠিকানাও লিখে দিলেন।
সব কাজের লিস্ট শুনে বাবা আর মা চিন্তিত মুখে ওনার দিকে তাকাল। উনি মুচকি হেসে বললেন, "আই নো ইটস এ লট, বাট ইউ উইল ডু গ্রেট! লেট মি নো ইফ ইউ নিড এনি হেল্প।"
কানাডিয়ানদের ব্যবহার অসম্ভব নরম ও আন্তরিক। এমনভাবে সাহায্য করে এবং সমব্যাথী হয় যেন ওদের কত আপন আমরা! আমরা ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে এলাম।
ট্যাক্সিতে বসে বাবা মা আলোচনা করছেন কোন কাজটি কিভাবে করা যায়।
আমি বাইরে তাকিয়ে ভাবছি, এখানকার রাস্তাগুলো কি প্রতিদিন তেল দিয়ে মালিশ করে? কোথাও কোন গর্ত নেই, এত মসৃণ কিভাবে! গাড়িতে যে বসে আছি বুঝতেই পারছিনা! কোন ঝাঁকি নেই, ট্রাফিকও তেমন না। সরলভাবে চলে যাচ্ছে। বোরিং!
দেশে তো রিকশাতেও কত মজা হত। তখন নতুন নতুন ওড়না পরা শুরু করেছি, বড় হয়ে গিয়েছি এমন ভাব। দুই বা তিন বান্ধবী মিলে একসাথে বসতাম রিকশায়। বাড়ি থেকে বারবার বলে দেওয়া হতো যেন ওড়না হাতের মধ্যে থাকে, চাকার মধ্যে আটকে না যায়। বাড়ির কাছে কোলে ঘুরতে যেতাম। সবাই যার যার বাড়ি থেকে কোনভাবে দশ বিশ টাকা জমা করে আনত, তাতে আচাড়, চিপস, কোল্ডড্রিংকস এসব খেতাম। আমাদের তো দাপটই আলাদা। পুরো শহরের মালিকিন যেন! ক্লাসের নানা মজার ঘটনায় হাহা হিহি শেষই হতোনা। বন্ধুরা পাশে থাকলে ছোট্ট একটা মজার বিষয়ও মারাত্মক হাসির কারণ হয়ে যায়। ছেলেরা একটু আকটু অন্যভাবে তাকানো শুরু করেছে। আমি তো বরাবরই এসব বিষয় বুঝতে পারতাম না। কোন ছেলে হা করে তাকিয়ে থাকলে আমার বান্ধবীরা লজ্জায় হাসি বন্ধ করে চুপ হয়ে যেত।
আমি কিছুই বুঝতাম না, বলতাম, "এই কি হলো? হাসি বন্ধ করলি কেন?" ওরা আমাকে বিষয়টি বললে, আমি ওদের চেয়ে দ্বিগুণ লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে যেতাম!
এসব ভাবতে ভাবতে খিলখিল করে হেসে উঠলাম! মা আমার দিকে প্রশ্নসূচক চোখে তাকাল। আমি মাথা নেড়ে বললাম কিছুনা! ধুর কল্পনার জগৎ এতো ক্ষনস্থায়ী হয় কেন! দেশের মিষ্টি কল্পনা থেকে বারবার বাস্তবের বিদেশী জমিনে আছড়ে পড়ছি!
ভীষন খিদে লেগেছে। কিছু খেয়ে লিস্টের অন্যকোন কাজে হাত দেওয়া হবে।
ছিমছাম ছোটখাট একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পরলাম সবাই। মৃদু মিউজিক বেজে চলেছে। লোকজন খেতে খেতে নিচু স্বরে কথা বলছে।
আমরা একটি টেবিলে বসে পরলাম। মেন্যুর অনেককিছু মন মতো হলোনা। কিছু কিছু চিনলামই না ঠিকমতো। শেষে ঠিক করা হলো ফিশ ফ্রাই আর মিল্কশেক খাওয়া হবে। অর্ডার দিয়ে ওয়েট করতে করতে আশেপাশে ভালোভাবে তাকালাম। বড় বড় মগে কেমন যেন একটা ফেনা ফেনা ড্রিংক! দেখে বুঝে গেলাম এলকোহল। ইশ! সবাই এত স্বাভাবিকভাবে মদ খাচ্ছে যেন এটা কোল্ডড্রিংক! অস্বস্তি বোধ করলাম। আসলে চোখে ধাঁধা লেগে যায় এতো রং বেরং এর মানুষ আর তাদের উদ্ভট সব কাজ কারবার দেখে!
অবশেষে খাবার এলো সামনে। মানুষ বলে খিদের পেটে যেকোন কিছুই অমৃত মনে হয়। পুরোপুরি ভুল প্রমানিত হলো তত্ত্বটি। মশলা, লবণ ছাড়া এ কেমন ফিস ফ্রাই? যা এক্সট্রা লবণ ছিল তা একটু একটু করে ঢেলে খাবার চেষ্টা করলাম। ঢালতে ঢালতে লবণ শেষ, কিন্তু স্বাদের বালাই নেই! কেউই দু তিন বারের বেশি নিতে পারল না। বিদঘুটে টেস্ট। মিল্ক শেকটা অসাধারণ ছিল। তাতেই কোনভাবে লাঞ্চ সারা হলো। কিন্তু মন বা পেট কিছুই ভরল না তাতে।
এরপরে সেই মহিলার ঠিকানা অনুযায়ী আরেক অফিসে যাওয়া হলো। সবজায়গায় বাবা কথা বলে, এবং আমি আর মা চুপচাপ শুনি। ওরা দু একটা প্রশ্ন করলে আমরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংলিশে জবাব দেই। ওরা তখন বলে, "পারডন মি! ক্যান ইউ প্লিজ রিপিট?" মানে ক্ষমা করুন, বুঝতে পারিনি, আবারো বলুন! বেশ কয়েকবার এক কথা বললে বোঝে। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। আর লজ্জারও। শিশুদের মতো বাকহীন মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি ভয়ে ভয়ে থাকি কখন কে কিছু জিজ্ঞেস করে ফেলে।
এই কাজ সেই কাজে দিনই কেটে গেল। বাড়িতে আসার পথে মাসিক বাস কার্ড কেনা হলো তিনজনের। সেই সকালে বেড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে নামতে বাড়ি ফিরলাম।
বাইরের জামা কাপড় চেঞ্জ না করেই বিছানায় পরে গেলাম। পুরো শরীর ক্লান্তিতে অবশ হয়ে গিয়েছে। এখানে আসার পর থেকে সর্বদা মারাত্মক একটা ক্লান্তি ছড়িয়ে থাকে শরীর মন জুড়ে। হয়ত এতসব পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে মনে কোন এফেক্ট পরছে। জেট লেগ এর কারণে ঘুম খাওয়া সবকিছুর রুটিনও উল্টেপাল্টে গিয়েছে। হুট করে অবেলায় প্রচন্ড খিদে লাগে, অসময়ে ঘুম আসে। সবমিলে শরীর মনের যা বাজে অবস্থা বলার না!
আমি প্রায় ঘুম ঘুম তখন মা এসে জোর করে ওঠালো। আমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললাম, মাআআ ক্লান্ত!
মা বললেন, "খেলেই ঠিক হয়ে যাবে, সারাদিন তো কিছু খাসনি।"
মা জোর করেই যাচ্ছে, আমি শুনছি না। শেষমেষ বললাম, তোমরা আমাকে এখানে আনলে কেন? আমার ভালো লাগেনা।
মা তখন বলল, "তোমরা বলিস না, তোর বাবা এনেছে আমাদেরকে এখানে। তোর বাবার তো সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। দেশে কি এমন খারাপ ছিলাম?"
দেশ পাল্টেও মায়ের এই স্বভাবটা গেল না, সবসময় ঝগড়ায় আমাকে ব্যবহার করবে। কথা আমার সাথে বলছে, কিন্তু শোনানোর টার্গেট বাবা! জোরে জোরে বলছে পাশের রুমের দিকে তাকিয়ে!
বাবা তখন এসে বলল, "আবার শুরু করো না তো, প্রথম প্রথম একটু স্ট্র্যাগল করতে হয়। সব গোছাতে পারলে আর কোন সমস্যা থাকবেনা।"
মা তখন বাবার পেছনে পেছনে গেল আরো কিসব বলতে বলত। আর আমি কোনমতে বিছানা থেকে শরীরটাকে উঠিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। খাবার পরে সত্যিই একটু ভালো লাগল।
ঘরে যেয়ে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিলাম, ব্যাপার কি? আজকে অফিসের মানুষজনের প্রায় ৬০ - ৭০ ভাগ কথাই আমি বুঝতে পেয়েছি! একদিন আগেও তো এপার্টমেন্ট ম্যানেজার, ফোনের দোকানের কারো কথার একটা শব্দও সেভাবে বুঝতে পারিনি। আমি কি একদিনেই ইংলিশ শিখে ফেলেছি? ভেবেই ভীষন আনন্দ হলো। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরলাম।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পাঠকের জন্যে কুইজ: আমি হুট করে একদিনে ইংলিশে বিদুষী হয়ে গিয়েছিলাম কি করে?

আমি ১৯ নাম্বার মন্তব্যে উত্তর লিখে দিয়েছি। কৌতুহলী পাঠক চেক করে নেবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২২