আগের পর্বের লিংক: তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (১) - প্রথমবার প্রবাসে প্রবেশের অনুভূতি! এই লিংকে পূর্বের সিরিজগুলোর লিংকও দেওয়া আছে।
পূর্বের সারসংক্ষেপ: লম্বা ক্লান্তিকর জার্নি শেষে এক বাংলাদেশী পরিবার পা রাখল তাদের ভাড়া করা কানাডিয়ান এপার্টমেন্টে। দুপুর গড়িয়ে ফর্মালিটিস শেষ করতে করতে বিকেল। সন্ধ্যার মধ্যে ডিনার করে ক্লান্ত সবাই ঘুমিয়ে পরল। আমি মানে পরিবারের মেয়েটি সকালে উঠে দেশ ছেড়ে আসার কথা ভেবে মন খারাপ করল। মায়ের ওঠার আওয়াজে মনটাকে সামলে নিয়ে উঠে পরল বিছানা থেকে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কানাডার প্রথম সকাল! নতুন দেশে প্রথম সকাল! ভাবতেও একধরণের উত্তেজনা বোধ করছি। মানুষ কি অদ্ভুত প্রাণী! কিছুক্ষন আগেই দেশ ছেড়ে আসা, এখানকার নতুন জীবনের কথা ভেবে মনটা দু:খ, ভয়ে কুকড়ে গিয়েছিল। আবার মুহূর্তেই সেই একই ভাবনায় একপ্রকার রোমাঞ্চ অনুভব করছি!
কাঁচঘেরা বারান্দাটার সামনে গিয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলাম। গতকাল বাইরে প্রকৃতিকে পড়ন্ত বিকেলে দেখেছিলাম। এখন দেখছি ভোরের আলোয়। পুরো জায়গার রূপটাই পাল্টে গেছে। জায়গাটিকে গতদিনের মতো নির্জন মনে হচ্ছে না। অনেককেই দেখলাম জগিং স্যুট পরে দৌড়াচ্ছে কানে এয়ারফোন দিয়ে। ছোট একটা কিউট পরী স্কুল ব্যাগ পিঠে নিয়ে মার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। জীবনের ছোট ছোট চিরায়ত দৃশ্যে কতশত গল্প যে থাকে!
এপার্টমেন্টটা ঘুরে ঘুরে দেখা শুরু করলাম। এত সাধারণ ছোট বাড়িতে তেমন দেখার কিছু নেই। তবে নতুন বাড়ির প্রধান মজা এটাই। প্রথম কদিন সবকিছু নতুন মনে হয়।
এপার্টমেন্টটিতে দুটো ম্যাটরেস আছে। আর ঘরের দেয়ালের সাথে তাক এটাচড করা ক্লসেট বা আলমারি আছে। ব্যাস আর কিছু না। পুরো বাড়ি ফাঁকা। এমন ফাঁকা বাড়িতে আগে কখনো থাকিনি। ছোট ছোট বিষয়ে খুব অসুবিধে হচ্ছে। যেমন কোন ড্রেসিং টেবিল নেই বিধায় চুল আচড়াতে হলেও ওয়াশরুমের আয়না ব্যবহার করতে হচ্ছে। টেবিল নেই, তাই মাটিতে একটা চাদর বিছিয়ে সেটাই টেবিল এর মতো ব্যবহার করে কাজ চালাতে হচ্ছে। ডাইনিং টেবিল নেই, তোষকের ওপরে বসেই খাওয়া দাওয়া চলছে।
জরুরী ভিত্তিতে কিছু ফার্নিচার কিনতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা কানাডায় ব্যবহারযোগ্য কোন ফোন নেই আমাদের কাছে! এখানকার ল্যান্ডফোন ও সেলফোন কিনতে হবে। পুরো পৃথিবীতে এক প্রকার ডিজকানেক্টেডই বসে আমরা সেই দু কামরার বাড়িতে। কোন দোকানে কি পাওয়া যায় তাও তো জানিনা! বাবা ঘুম থেকে উঠলে মা এসব নিয়ে আলোচনা করবে। কোথা থেকে শুরু করা যায় তা ভাবতে হবে।
ততক্ষন আমি আর মা লাগেজগুলো খালি করতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। আমরা প্রচুর সালোয়ার কামিজ এনেছিলাম দেশ থেকে, যেহেতু কানাডায় পাবার সম্ভাবনা কম। আমি আর মা কেউই ওয়েস্টার্ন ড্রেসে সহজ হতে পারতাম না।
মা কে দেশে অনেকে জিজ্ঞেস করত, "ভাবী আপনাকে তো ওখানে জিন্স প্যান্ট পরতে হইব! শরম করব না?"
কি কৌতুহল আর উত্তেজনা তাদের চোখেমুখে! তাদের ভাব দেখে মনে হতো বিদেশে গেলে জিন্স প্যান্ট পরতেই হয় এবং বিদেশে যাওয়ার চেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে জিন্স প্যান্ট পরা!
মা ভীষন লজ্জা পেত, বলত 'ছি! এ বয়সে ওমন পোশাক!"
নিজের ব্যাপারে রক্ষনশীল হলেও আমাকে মা জিজ্ঞেস করেছিল যে আমার জন্যে জিন্স শার্ট কিনবে কিনা? ওখানে গিয়ে ওদের মতো পোশাক পরতে চাই কিনা?
আমি জোরে মাথা নেড়ে না বলে দিয়েছিলাম। আমি বাবা মিস বিলাতি হতে চাইনা।
তখন আমাদের মফস্বলে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়া বড়দের কাছে ক্রাইম ছিল আর ছোটদের কাছে ছিল কৌতুক। পুরো শহরে হয়ত হাতেগোনা কয়েকটা মেয়ে একটু উদ্ভট সাজপোশাক পরত। সেগুলো কোনভাবেই অশালীন না তবে অন্যরকম। যেমন লং স্কার্ট অথবা জিন্স এর সাথে টপস। সেগুলো যে তাদের আমেরিকার চাচা, থ্যাইল্যান্ডের মামা, মালয়েশিয়ার ফুপা পাঠিয়েছে সেটা সবাইকে জানানোর জন্যেই তারা বিশেষত ওভাবে সাজত।
আমরা যারা সালোয়ার কামিজ পরতাম ভীষন হাসতাম মেয়েদেরকে ছেলেদের পোশাকে দেখে। তাদেরকে মিস বিলাতি নাম দিয়েছিলাম সবাই মজা করে। যারা বোরখা পরত তারা তো সহ্যই করতে পারত না। মিস বোরখারা মিস বিলাতিদের বোঝাত যে এমন পোশাক পরলে আল্লাহ গুনাহ দেয়। মিস বিলাতিরা তখন উল্টো বোঝাত যে এটা সৌদি থেকে তার মামা পাঠিয়েছে, সৌদির মতো পবিত্র দেশের জিন্স প্যান্ট পরলে গুনাহ হবেনা! আমরা সবাই তখন অনেক বোঝার ভান করে মাথা নাড়তাম!
এসব ভাবতে ভাবতে লাগেজগুলো খালি করে ফেললাম। তারপরে আমার ঘরে গেলাম। ওহ! ঘরের জানালার পর্দা সরানো হয়নি এখনো!
দড়ি টেনে জানালার ব্লাইন্ডস ওঠাতে শুরু করলাম। পর্দা ওঠার সাথে সাথে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ওহ আল্লাহ! এটা কি! আমার ঘর থেকে পাহাড় সরাসরি দেখা যায়! মানুষ তো বেড়াতে গেলে এমন ভিউয়ের জন্যে হোটেলে এক্সট্রা টাকা দেবে! হোয়াট আ ভিউ!
ছোট বড় পাহাড়গুলো আপন গরিমায় মাথা উঁচু করে পাশাপাশি দাড়িয়ে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রং বেরং এর নানা বাড়ি, দূর থেকে খেলনার মতো লাগছিল! সূর্যের চিকচিকে আলোর স্পর্শে পাহাড়গুলো সুবজাভ কমলা রং এর চাদর পরে আছে! সত্যিই অপরূপ! আমার চোখে রং এর বিভ্রম লেগে যাচ্ছে! আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একমনে দেখে যাচ্ছি।
অন্যদিকে বাবা এত বেশি ক্লান্ত ছিল যে উঠতে উঠতে দুপুর করে ফেলল। আমি আমার ঘরে ছিলাম, তখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি বাইরে। এমন লিভিং ভিউ কার্ড আমার ঘরের সামনেই! বিশ্বাসই হতে চায়না। মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গল, আমি গেলাম।
মা বলল, "আয় বস, এখন আমরা সবাই মিলে প্ল্যান করব কিভাবে সব গোছানো যায়।"
আমি একটু অবাক হলাম। দেশে পরিবারের যেকোন ডিসিশনে কথায় কথায় বড়দের গুরুগম্ভীর গোলটেবিল বৈঠক বসত। আর সেখানে আমাদের ছোটদের থাকাটা অপরাধ ছিল। একবার আমার কাজিন মার্বেলের খোঁজে না বুঝে হুট করে বড়দের মিটিং এ ঢুকে পরেছিল। সেদিন দাদার কাছ থেকে এমন ধমক খেয়েছিল যে তার মার্বেল নিয়ে খেলার শখ চিরজীবনের জন্যে মিটে গিয়েছিল!
কিন্তু এখন মা নিজে থেকে আমাকে ডাকছে!? হুমম হয়ত এখন আর কেউ বড় ছোট নেই। সবার জীবনই তো কেবল শুরু হলো!
বেশ কিছুক্ষন আলোচনা করে ঠিক করা হলো আগে ফোন কিনতে হবে। সেটা ছাড়া কারো সাথেই কোন যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। কোন আইডিয়া পাওয়া যাচ্ছে না।
সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। এখানে পথেঘাটে ট্যাক্সি বসে থাকেনা। ফোন করে ডাকতে হয়। এপার্টমেন্টের অফিসে গিয়ে রিকোয়েস্ট করে সেই ফোন থেকে ট্যাক্সি ডাকা হলো। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বাবা ১৫ মিনিট ধরে অনেক কষ্টে বোঝাতে সক্ষম হলো যে আমরা এমন দোকানে যেতে চাই যেখানে ফোন কেনা যাবে। সেই ড্রাইভার আমাদেরকে পৌঁছে দিল এক শপে।
ছোটখাট ছিমছাম একটা শপ। নানা ডিজাইনের টেবিলে রকমারী ফোন, ট্যাবলেট ডিসপ্লেতে রাখা। একটা হালকা মিউজিক বেজে যাচ্ছে। আমরা সোজা রিসিপশনে চলে গেলাম। সেখানে একটা গোলগাল চেহারা ও বাদামী চুলের কানাডিয়ান মেয়ে দাড়িয়ে ছিল। আমাদের দেখে মিষ্টি করে হাসল। আমরাও হাসলাম। এরপরে ইংলিশে কিসব কথা বলা শুরু করল!
অদ্ভুত বিরক্তিকর ব্যাপার। এ দেশে সবাই সবসময় ইংলিশ বলে কেন? কখনো কখনো একটু বাংলা বলতে পারেনা? আর ইংলিশ বলবে ভালো কথা, একটু আস্তে বল। ওরা যখন কথা বলে আমি শুধু "ফরফর কটমট ফরফর কটমট" শুনতে পাই। দু একটা শব্দ ভুলে ধরে ফেলতে পারলে কি ভীষন আনন্দ হয়!
আমি শব্দ বোঝার খেলায় মনে মনে মেতে আছি। হুট করে পাশ থেকে একটা ক্যাপ পরা মধ্যবয়সী পুরুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে জোরে কি যেন একটা কমেন্ট করল। আমি ভীষন ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা কি ভুল কিছু করেছি? আমি আর মা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি।
বাবা আমাদেরকে বললেন, ভয় পেয়োনা, তিনি বলেছেন, "লাভলি লেডিস! আরেন্ট দে লাভলি? হাও প্রিটি! ওয়ান্ডারফুল আউটফিট!"
আমি আর মা অস্বস্তি বোধ করছি। এভাবে কেউ অজানা মানুষকে প্রশংসা করে নাকি! কি আজব দেশরে বাবা! আমরা কোনভাবে নিজেকে সামলে ওনাকে থ্যাংকস বললাম। উনি হেসে চলে গেলেন।
বাবা অনেকক্ষন ধরে কথা বললেন সেই রিসিপশনিস্টের সাথে। নানা ধরণের মান্থলি, ইয়ারলি কিসব প্ল্যান ছিল। সবকিছু নিয়ে আলোচনা করে একটা ফোন কেনা হলো।
বাসায় ফেরার সময় ট্যাক্সিতে হেলান দিয়ে প্রায় আধশোয়া হয়ে আছি। গাড়ি ঘোড়া, ও ট্রাফিকের রং বেরং এর আলো ভেদ করে সন্ধ্যার আঁধার পুরো মন জুড়ে ছড়িয়ে পরল। একটা দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলাম। এদের কোন কথাই ঠিকঠাক বুঝতে পারছিনা, স্কুলে ভর্তি হবার পরে টিচার, ক্লাসমেটদের কথা কিভাবে বুঝব! অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা! একটা মানুষ আমার সামনে কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু আমি সেটা বুঝতে পারছিনা! কি ভীষন অসহায় যে লাগে! শিশুরা হয়ত এজন্যেই হুটহাট কেঁদে ওঠে। অন্যের কথা বুঝতে না পারা, এবং নিজে কথা বলতে না পারার অসহায়ত্বে!
আহারে! দেশের সরিষার তেল দিয়ে মুড়ি মাখা নিশ্চিন্ত সন্ধ্যাটা যদি ফেরত পেতাম! এমন সময়ে সবাই মিলে কত মজা করে নাস্তা খেতে খেতে আড্ডা দিতাম, টিভি দেখতাম। বেশ কিছুদিন টিভিও দেখা হয়না। টিভি! হুট করে মনে হলো আমাদের প্রিয় গানের রিয়েলিটি শোটি দেখা হচ্ছেনা!
তখন এত চ্যানেলে এত বেশি রিয়েলিটি শো ছিলনা। এমন শো গুলো নিয়ে জনমনে একটা উত্তেজনা তখনো কাজ করত। নিজের জেলার মানুষের জন্যে রীতিমত চাঁদা তুলে ভোটদান কর্মসূচি হতো! আমরাও খুব আনন্দ নিয়ে ফলো করতাম সেসব শো।
আমি মা কে সাথে সাথে বললাম, মা নীলয় বাদ পরে যায়নি তো? মারও হুট করে মনে হলো!
মা বাবাকে বলল, "আমরা তো জানলামই না টপ থ্রি তে কে গেল!"
বাবা আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকল। বলল, "এখন তোমাদের মাথায় এসব আসছে?"
আমি আর মা বাবার এক্সপ্রেশনে চুপ মেরে গেলাম। বাবা মনে মনে নিশ্চই ভাবছিল এই দুটো পাগলীকে নিয়ে আমি কি করব! হাহা। অবশ্য বাবারও দোষ নেই। আমিও এখন অবাক হয়ে যাই ভেবে। এতসব সাংঘাতিক ঝামেলার মধ্যে একটা শোয়ের কথা কিভাবে মনে হলো কে জানে!
আমি আবারো হেলান দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেশের কথা ভাবতে লাগলাম। সারাদিনের একরাশ ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা শেষে ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসিটা আসছে দেশের কথা ভেবেই! জীবনের গল্প নতুনভাবে শুরু হয়েছে তা বুঝতে পারছি, কিন্তু অদ্ভুতভাবে পেছনের স্মৃতিগুলোই উষ্ণ, কোমল চাদরের মতো জড়িয়ে রেখে শক্তি দিয়ে যাচ্ছে পথচলার!