আমি আমার কানাডিয়ান প্রবাস জীবন নিয়ে দুটো সিরিজ লিখেছিলাম। কানাডার স্কুলে একদিন এবং কানাডার স্কুলে একেকটি দিন
এই দুটো সিরিজে আমার কানাডিয়ান হাই স্কুল জীবন নিয়ে নানা গল্প তুলে ধরেছি। ভেবে রেখেছিলাম এরপরের সিরিজটি হবে আমার ভার্সিটি লাইফ নিয়ে। কিন্তু আমার নিজের কিশোরী জীবন নিয়ে লিখতেই বেশি ভালো লাগে। লিখতে লিখতে মনে হয় আমি এমন ছিলাম? এই বোকা মেয়েটা আমিই ছিলাম? হাহা। শুধু নিজের ভালো লাগাই নয়, আরেকটি বিশেষ কারণও আছে নতুন এই সিরিজটির পেছনে। প্রবাস জীবনের শুরুর দিকের প্রচুর গল্প কথা এখনো লেখা হয়নি। তাই এখনি সেই সময়টাকে ছেড়ে আসতে পারছিনা।
এবারের সিরিজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা শুধু আমার কানাডিয়ান হাই স্কুল লাইফ নয় আশেপাশের সব কিছু নিয়েই লেখা হবে। পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী, রাস্তাঘাট, যানবাহন, মার্কেট; সর্বোপরি দৈনন্দিন প্রবাস জীবনযাত্রা নিয়ে লিখব। আর অবশ্যই হাই স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোও একটি বড় অংশ জুড়ে থাকবে।
তুষার দেশ কানাডায় জীবন মানেই অনেকের কাছে অন্তহীন শ্বেতশুভ্র তুষারের মাঝে মুক্তভাবে হাত পা ছুড়ে বিলিন হওয়া! স্বপ্নের এক স্বর্গ দুনিয়া। কিন্তু সেই উন্নত বিশ্বের আকর্ষনীয় জীবনের আড়ালে কত ঘাত প্রতিঘাত থাকে সেটা অনেকেই জানেন না। পায়ের মাটি শক্ত করে নিশ্চিন্তে ডানা মেলার পেছনে অনেক স্ট্রাগলের গল্প থাকে। সেসব গল্প, হাসি কান্না যতটা পারি তুলে ধরব ব্লগ পাতায়।
অনেক বকবক করেছি, আর দেরী না করে চলে যাচ্ছি নতুন সিরিজের প্রথম পর্বে।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
প্রশস্ত, মসৃণ রাস্তার ওপরে চলমান ট্যাক্সিটি এসে থামল একটি বহুতল এপার্টমেন্টের সামনে। ট্যাক্সি থেকে বের হওয়া মাত্র শিরশিরে শীতের অনুভূতি পুরো শরীরে বয়ে গেল। তখন নাকি ওখানে সামার চলছে, কিন্তু বাতাস দেশের শীতের মতোই কনকনে ঠান্ডা! তীব্র সূর্য মাথার ওপরে কিন্তু এত শীত! কানাডিয়ান জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল এই আবহাওয়ার বৈপরীত্য। সেতো কেবল শুরু। বাংলাদেশের মফস্বলে বেড়ে ওঠা একটি মেয়ে যখন পৃথিবীর অন্য প্রান্ত কানাডায় পা রাখে, দুটি বিপরীতধর্মী সংস্কৃতিতে হিমশিম খেতে খেতে বৈপরীত্য শব্দটিই তার নিত্য সাথী হয়ে যায়!
এপার্টমেন্টের সামনে দাড়িয়ে বাবা মায়ের সাথে ওয়েট করছিলাম। বাবা এপার্টমেন্ট ম্যানেজারকে ফোন করেছেন, তিনি আসছেন। আমি চারিদিকে ক্লান্ত চোখে তাকাচ্ছি। ছিমছাম একটা পাড়া। বেশ নির্জন। রাস্তাঘাট এত বেশি পরিষ্কার যেন কারো বাসার ড্রয়িংরুম!
শরীরের সকল শিরা উপশিরায় কেমন যেন একটা অবসাদ ছড়িয়ে আছে। দাড়িয়ে থাকতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে। এই প্লেন থেকে ও প্লেন, এই ট্যাক্সি থেকে সে ট্যাক্সিতে করে কেটে গেল গত দুদিন! পুরোটা সময় শুধু অপেক্ষা ছিল কখন গন্তব্যে পৌঁছাব। যাত্রার শুরুর দিকে একটা নতুন দেশ নতুন দেশ উত্তেজনা ছিল। ওখানকার বাড়ি কেমন কেমন হবে, বিদেশীরা কেমন হয়, আশেপাশে কোন বাংলাদেশী পাব কিনা এসব ভাবনা মনকে ঘিরে ছিল। কেমন যেন একটা ভয়, আশংকা, উত্তেজনা, বেদনা। ধীরে ধীরে সকল অনুভূতি চলে গিয়ে ব্যাস অপেক্ষা নামক অনুভূতিটিই রয়ে গেল। আর কত? কখন শেষ হবে এই দীর্ঘ যাত্রাপথ? দেশে কখনো পাঁচ ঘন্টার বেশি যাত্রা করিনি আর এবারে পুরো দুদিন!
অপেক্ষা যখন প্রায় শেষ হবার পথে, মারাত্মক ক্লান্তিতে নতুন দেশে পদার্পণের উত্তেজনা অনুভব করতে পারছিলামই না। শুধু মনে হচ্ছে এপার্টমেন্টে গিয়ে একটু শরীরটাকে বিছানার সাথে এলিয়ে দিতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোনকিছু ভাবার শক্তি শরীরে বা মনে নেই।
বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকার পরে একজন লম্বা, নীল চোখের, ভীষন হাশিখুশি চেহারার কানাডিয়ান পুরুষ এলেন এবং একে একে আমাদের সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে ওয়েলকাম টু কানাডা বললেন। উনি যখন কথা বলা শুরু করলেন মনে হল চোখের সামনে লাইভ বিবিসি চলছে! তীব্র কানাডিয়ান একসেন্ট বিশিষ্ট বেশিরভাগ কথাই বুঝতে পারছি না। কথা বলছেন নাকি গোলাবারুদ ছুড়ছেন আমাদের দিকে তা নিয়ে কনফিউজড হয়ে গেলাম।
আমাদেরকে নিয়ে গেলেন ওনার অফিসে। সেখানে কিসব কাগজপত্র দিলেন। এত ফর্ম শুধু বাড়ি ভাড়ার! বাড়ি কিনতে গেলে এরা না জানি কত ফর্মালিটিস করে! বাবা ধৈর্য্য ধরে সব ফিল করল। আমি চুপচাপ বসে আছি। গত দুদিনে চুপচাপ বসে বসে ওয়েট করায় এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছি! ফর্মগুলো পূরণ হলে আমাদের ভাড়া করা এপার্টমেন্টে নিয়ে গেলেন।
ছোটখাট একটা সাদামাটা বাসা। এর থেকে দেশে যে বাড়িতে থাকতাম তা অনেক বেশি প্রশস্ত, খোলামেলা ও সুন্দর ছিল। সেসব নিয়ে মন খারাপ হয়নি কেন যেন। শুধু মনে হচ্ছিল কখন এই লোক যাবেন এবং একটু রেস্ট নিতে পারব। শরীর সত্যিই আর টানছে না। এপার্টমেন্ট ম্যানেজার আমাদেরকে প্রতিটি রুম দেখিয়ে দিলেন। হিটার, এসি কোথায়, কিভাবে অপারেট করতে হয় তা বললেন। রোবটের মতো অনেক নিয়ম কানুন ফরফর করে বলে গেলেন। অভিজ্ঞ উনি হাজারবার এসব বলেছেন বোঝা যাচ্ছে। বাবা ওনার সাথে কথা বলছিলেন, আমি বারান্দায় গিয়ে দাড়িয়ে রইলাম।
বেশ ছোট তবে ছিমছাম বারান্দা। সামনে আরো সব এপার্টমেন্ট দেখতে পেলাম। প্রতিটি এপার্টমেন্ট আমাদেরটারই ক্লোন। ঘিঞ্জি না এলাকাটা। সারি সারি বাড়িগুলোর আঁকে বাঁকে বিশাল মাঠ, প্রশস্ত রাস্তা। মাঠে অবস্থিত লম্বা লম্বা গাছগুলো আকাশকে যেন ছুঁয়েই ফেলছিল প্রায়। কিন্তু প্রবল বাতাসের তোড়ে লক্ষ্যভেদ করে একদিকে ঝুলে পরছে বারবার। রক্তিম সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবমিলে মনোমুগ্ধকর সুন্দর পরিবেশ। কিন্তু ক্লান্তি সকল মুগ্ধতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। কান ফেলিয়ে শুনলাম বিবিসিটা গিয়েছে না এখনো লেকচার দিচ্ছে?
এক সময়ে এপার্টমেন্ট ম্যানেজার চলে গেলেন বাবাকে এপার্টমেন্টের বেশ কয়েকটা চাবি দিয়ে। যাবার পরে আমরা দরজা বন্ধ করে একটা লম্বা নি:শ্বাস নিলাম। লাস্ট কদিনে শুধু এই মুহূর্তেরই অপেক্ষা করেছি কখন যেয়ে একটু নিজের ঘরে দাড়াতে বসতে পারব! পরদেশে হোক, ভাড়া করা হোক, ভীষন নতুন অচেনা হোক কিন্তু এখন সেটাই আমাদের দুনিয়া। এক টুকরো শান্তির আবাস। ভীষন আপন ঘর!
বাবা বাইরে গেল কিসব জিনিসপত্র কিনতে। মা হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে আছে। আমি শুয়ে পরলাম। মিষ্টি একটা ঘুম ভাঙ্গল মায়ের ডাকে। আমার ওঠার শক্তি, ইচ্ছে কোনটাই ছিলনা। হঠাৎ কানে আসল ভাত আলুভর্তা ডিমভাজি হয়েছে! শুনে আমি তড়াক করে উঠে গেলাম। প্লেনের খাবার যে কি বিদঘুটে হয় তা বলে বোঝানো যাবেনা। দুদিন যাবৎ সেসব খাবার খেয়ে মৃতপ্রায় ছিলাম। এখন আসল খাবার খেতে পারব! আমরা কি ভীষন স্বাদ করে যে খেয়েছিলাম সেদিন! অমৃত যে একেই বলে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শেফের সিগনেচার ডিশটিও মায়ের হাতের সামান্য ডিম ভাজি ভাতের সামনে কিছুই না!
খাবার শেষে ফাইনালি ঘুমাতে গেলাম। সন্ধ্যা হতে চলল তখনই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম ভাঙ্গার পরে অবাক চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। পাখির কিচিরমিচির কানে আসছে, আবছা ভোরের আলোয় আশেপাশে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বুঝলাম অপরিচিত জায়গায় আছি। হঠাৎ করে বুকে ধক করে হাতুড়ির বাড়ি খেলাম। হায় আল্লাহ! আমি আর আমার দেশে নেই! সত্যি সত্যি আমার পা আর আমার দেশের মাটিতে নেই!? আমি এই বিশাল ঘটনাটি প্রসেস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গতদিন মনে হচ্ছিল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এসেছি। শরীরের অবসাদ মনকে কিছু ভাবতেই দেয়নি। এখন যখন ঠিকঠাক ভাবে ভাবতে পারছি কি ভীষন কষ্ট লাগছে!
দুদিন আগেও এ সময়ে নিজ দেশে আত্মীয় স্বজনদের সাথে ছিলাম। দাদা দাদীর সাথে গল্প করেছি, চাচা ফুপির কাছে এটা ওটা বায়না ধরেছি, কাজিনদের সাথে খুনসুটি করেছি। আর এখন বসে আছি সম্পূর্ণ অচেনা দেশে যেখানকার মানুষের ভাষা পর্যন্ত বুঝিনা! আমি কখনো বিদেশে আসার স্বপ্ন দেখিনি, হুট করেই আমাকে একদিন জানানো হয় যে আমরা যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল কি দরকার অন্যকোথাও যাবার? ভালোই তো আছি। তাই আমি মানসিক ভাবে এই পরিবর্তনের জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
কিন্তু আমার মনে হয় যারা বহু মাস বছর সাধনা করে, প্রচুর স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে বিদেশে আসেন তারাও উপলব্ধি করতে সময় নেন। যতক্ষন এয়ারপোর্টে আছেন, ততক্ষনও বুঝবেন না যে আপনার জীবন পরিবর্তিত হয়ে গেছে। একবার বিদেশের মাটিতে পা দেবার পরে হুট করে হারানো এবং পাওয়ার অনুভূতিটা জেঁকে বসে। মনে হয় দিস ইজ রিয়াল!
বহু ভাললাগার মানুষ, স্থান, বস্তু পেছনে ছুটে গেছে। অতি পরিচিত মানুষগুলোকে দেখা, ছোঁয়া যে এখন খুব দূর্লভ কিছু সেটা অনুভব করলাম। সব কষ্ট লুকিয়ে নতুন দেশে মানিয়ে নিতে হবে, নতুন করে সব গড়তে হবে। একদম সদ্যজাত শিশুর মতো জীবনটাকে শুরু থেকে শুরু করতে হবে। কথা বলা শিখতে হবে নতুন এক ভাষায়, এখানকার মানুষদের আবেগ অনুভূতি, ভালো লাগা খারাপ লাগা, আইন, নিয়ম বিধি বুঝতে হবে।
এসব কিছু ভাবতে ভাবতে বিছানায় বসে বসে দেশে নিজের পুরো জীবনের স্মৃতিচারণ করে ফেললাম মুহূর্তে। অনুভব করলাম চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মা ওঠার আগ পর্যন্ত স্মৃতিচারণ, এবং উপলব্ধির ঝড় বইতে লাগল মনে। যখন বুঝলাম মা উঠে গেছে আমি চোখ গাল মুছে উঠে বসলাম। আর সময় নেই এসবের, ঘর বাড়ি গোছাতে মাকে সাহায্য করতে হবে। এই অনুভূতি নিয়ে বেশিক্ষন বসে থাকার যাবেনা। জীবন দ্রুতগামী বিশেষত যদি তা হয় বৈদেশে, এক অনুভূতি থেকে অন্য অনূভূতিতে দ্রুতই অগ্রসর হতে হয়।
পরের পর্বে অন্য কোন অনুভূতি আবেগ নিয়ে ফিরে আসব।
ভালো থাকুন সবাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৮ রাত ১১:২১