কানাডায় অনেক দেশ থেকে প্রতিদিনই হাজারটা মানুষ আসে। কিন্তু আমাদের এশিয়া বিশেষত সাউথ এশিয়া থেকে একটা বড় অংশ যায়। কানাাডার রাস্তায় হাটলে ব্রাউন স্কিনের অনেককেই দেখবেন! মাঝে মাঝে মনে হবে বাংলাদেশেই আছেন। আমি যে জায়গায় থাকতাম সেখানেও বেশ কিছু ব্রাউন কমিনিউটি ছিল। আমাদের স্কুলে আমিই একমাত্র বাংলাদেশি ছিলাম। তবে বেশ কিছু ভারতীয়, পাকিস্তানি ছিল। তাদের সাথে মেশার অভিজ্ঞতা এবং তারা বাংলাদেশকে কিভাবে দেখে তা নিয়েই আজকের পর্ব।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
ভারতীয়: এরা অন্যান্য সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতে (পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা) প্রচন্ড অহংকারী, রুড, এবং bossy হিসেবে পরিচিত। আমার বাবার এক শ্রীলংকান বন্ধু তাকে বলেছিল, "তুমি কানাডায় নতুন এসেছ। একটা জিনিস জেনে রাখ ভারতীয়দের সহজে বিশ্বাস করবে না। ওরা অনেক চালাক। ওদের সাথে ডিল করলে সবকিছু হারিয়ে বসবে!" কি পরিমাণ বিরক্ত বুঝতেই পারছেন।
আমাদের স্কুলে একটা ইন্ডিয়ান মেয়ে বেশ ছোটখাট, কালোই বলা চলে, হাফ প্যান্ট, শার্ট পরত। পুরোপুরি ওয়ের্স্টানাইজড আর কি। ওরা নিজের দেশেই ভারতীয় কালচার তেমন আর ফলো করেনা, আর এখানে তো দূরের ব্যাপার। ওকে প্রথম দেখি জিমে। কাপড় চেন্জ করে ক্লাস শুরু হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছি। এমন সময়ে দেখি একটা মেয়ে ছেলেদেরকে বলছে, "হাগ মি, I am cold (আমার শীত করছে)" আমিতো তব্দা। কেমন নির্লজ্জ এই মেয়ে? আমি ভাবলাম ছেলেরা এবার ঝাপিয়ে পরবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম কেউ কোন ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে না। আসলে পৃথিবীর কোন দেশেই বোধহয় ছ্যাবলা টাইপের মেয়েদের ছেলেরা পছন্দ করেনা! ছেলেদের পটাতে একটু পাত্তা না দেওয়ার অভিনয় করতেই হয়।

যাই হোক, বেশ কিছুদিন চলে গেছে। সে ঘটনা আমি ভুলে গেছি। একদিন চেন্জিং রুম থেক বের হচ্ছি, এমন সময় আমাকে জিগ্যেস করল, "তুমি কোন দেশের?" আমি হেসে বললাম বাংলাদেশ। ওমা মেয়েটা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ চোখ বাকিয়ে বলেকি, "বাংলাদেশ কোথায় জানি?" ওর বলার ধরণ দেখে বুঝলাম খুব ভালোই জানে বাংলাদেশ কোথায়, ভাব নিচ্ছে। সেইদিন প্রথম বুঝলাম কেন এদেরকে অহংকারী, রুড বলা হয়। আমার এমন রাগ হল, বললাম, "On your head."। বলেই ওর মুখের দিকে না তাকিয়েই চলে আসলাম। আসলে আমি ইংলিশ তখন ভালো পারতাম না, মনে মনে বাংলা বলে তারপরে ইংলিশে ট্রান্সলেট করে বলতাম। আমাদের বাংলায় রাগলে বলে না তোর মাথা। ব্যাস সেখান থেকেই ঐ কথাটা বলা। হা হা।
এখানে একটা কথা, আমাদের দেশ বেশ নতুন, আর ছোট তাই অনেকে চেনে না। সেটা আমার রাগ ছিলনা। ওর এক্সপ্রেশন খুবই বাজে ছিল। কানাডিয়ানদেরও বাংলাদেশ বললে বুঝুক আর নাই বুঝুক বলবে, "Oh, wow Bangladesh? Cool!" না জেনেই বলবে, কিন্তু ভদ্রতা দেখাবে। আর ঐ ভারতীয় মেয়ে ডাট দেখায়। এর কথা বাদ দিই, লিখতেও মেজাজ গরম হচ্ছে।
এছাড়াও বাসে, রাস্তায় যখন সালোয়ার কামিজ পরে চলাফেরা করি মাঝেমাঝেই কিছু অতি আধুনক ভারতীয় মেয়ে ভুরু কুচকে তাকায়। ভাব এমন যে কোন গ্রাম থেকে উঠে এসেছে কে জানে! ওরা মানতেই পারে না যে বিয়ে, উৎসব ছাড়াও কেউ ট্রাডিশনাল ড্রেস পরতে পারে! সত্যি বলছি কানাডায় কানাডিয়ানরা কখনো রেসিস্ট আচরন করেনি, কিন্তু ভারতীয়রা কেমন জানি। এরা প্রচন্ড তুচ্ছতাচ্ছিল করে অন্যান্য সাউথ এশিয়ান দেশগুলোকে। আবার কানাডিয়ানদের সাথে ডার্লিং ডার্লিং সম্পর্ক। তবে এটা শুধু ওদের নতুন প্রজন্মের জন্যে সত্যি। বয়স্করা প্রচন্ড স্নেহ করেন। আমরা এক দেশ ছিলাম সেটা ভেবে নস্টালজিক হন। কিন্তু ইয়াংরা আমার মায়ের ভাষায়, "হাড়ে শয়তান!"
একবার এক বয়স্ক শিখ ভদ্রলোক বলেছিলেন তোমরা আলাদা বাসায় থাকো কেন? আমার বাসায় উঠে পড়! ঘর তো খালিই পরে থাকে। আমরাতো একই দেশের মানুষ! বিশ্বাস করুন ভদ্রলোক মাত্র তিনদিন পাচ মিনিটের বাসের রাস্তার পরিচয়ে এ প্রস্তাব দেন! আমি এবং আমার মা বাবা কি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম! মা বাবা বললেন, "চাচাজি, সেতো আমরা থাকতেই পারতাম, তবে এখান থেকে যাতায়াতটা সুবিধা। তবে আপনাদের বাসায় অবশ্যই যাব, এবং আপনারাও আসবেন।"
আর ভারতীয়দের নিজেদের মধ্যে খুব মিল! জান দিয়ে করবে নিজের দেশের মানুষের জন্যে। ওরা যেন সবাই একটা মানুষ! কিন্তু অন্য দেশ, দেশের মানুষকে সেভাবে সম্মান দেখাতে না পারায় ওদের নিয়ে অনেক খারাপ স্টেরিওটাইপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
পাকিস্তানি: মেয়েগুলো প্রচন্ড ধার্মিক, এবং ভদ্রগোছের হয়। জিন্স, প্যান্ট, কোট, কামিজ যাই পরুক না কেন মাথায় হেজাব থাকবেই। এখনো অনেক ট্রাডিশনাল। ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে কম হলেও মোটামুটি ট্রাডিশনালই আছে। কেউ কেউ অবশ্য লুকিয়ে নাইট ক্লাবে যায়, ড্রিংক করে। সে যাই হোক, ওদের কেউ কেউ বাংলাদেশকে পছন্দ করে এটা ভেবে যে আমদের মুসলিম ভাইদের ওপরে আমরা অনেক অবিচার করেছি। তবে বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যে আমরা বিশ্বাসঘাতক!! ভারতীয়দের সাথে হাত মিলিয়ে ওদের ক্ষতি করেছি এবং করে যাচ্ছি। নিজেদের মধ্যে একদমই ইউনিটি নেই। বিদেশে দেশের মানুষ দেখলে এমনিতেই মনটা নরম হয়। কিন্তু ওদের তা না! এখানেও দলাদলি, মারামারি, কাটাকাটি। শুধু আমি ঠিক, অন্য সবাই ভুল। ইউনিটি না থাকার কারনেই জাতিটা দিনে দিনে পিছিয়ে পরছে।
তো একবার এক পাকিস্তানি খুব পাতলা, ছোটখাট, ফর্সা, চশমা পড়া একটা মেয়ে আমাকে বলল তুমি কি রোজ এত সকালেই ক্লাসে আস? আমি বললাম হ্যা। ও বলল আমার বাড়ি দুরে, আসতে দেরি হয়, আর পিছে বসলে ঠিক দেখতে পারিনা! আমার জন্যে সিট রেখে দেবে? আমি তারপর থেকে ওর জন্যে সামনে সিট রেখে দিতাম। পাশে বসতে বসতে বন্ধুত্ব। একটা মজার গল্প বলি!
একবার আমি সাইন্স ল্যাব করার সময় নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে এক, দুই, তিন করে টেস্টটিউব গুনছি! সব কথা ইংলিশে বললেও নাম্বার বলার সময়ে সবার আসল জাত বেড়িয়ে আসে! নিজের ভাষায় বলতে থাকে। অন্য দেশের মানুষের মধ্যেও এ প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। ও আমাকে থামিয়ে বলল, আরে এটা তো আমাদের মতো, এক, দো, তিন। বাংলা আর উর্দুতো প্রায়ই একই! আমি খুব শান্ত, শীতল স্বরে, গম্ভীর মুখে বললাম, "No it's not the same. It can't be." ও পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল! সবসময় হাসতে থাকা আমার এ অগ্নিরুপ ও আগে দেখেনি! ও কনফিউজড যে এমন কি ভুল কথা বলেছে? টিচার এসে যাওয়ায় তখন এটা নিয়ে আর কথা হয়নি।
পরে লান্চ ব্রেকে সব বললাম। আমাদের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদ, মা বোনের সম্মানহানি। খুব ইমোশনাল হয়ে যাওয়ায় কাপা কাপা গলায়, অগোছালোভাবে বললাম। ও অবাক হলো না, অস্বীকার করল না, প্রতিবাদ করল না। ওর ভাবটা এমন ছিল যে পাকিস্তানের জন্যে এসব করা নরমাল ব্যাপার! এসব হতে পারে। আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে, সামনেও হবে। এসব লজ্জা ওদের জীবনের পার্ট এন্ড পার্সেল! কি অভাগা এক জাতি। ছি।
তবে আমার বন্ধুর মতো সরলভাবে সব পাকিস্তানি মেনে নেয় না। এদের অনেকেই বাংলাদেশীদের বিদ্রুপ করে, কি ভাই আমাদের মুসলিম ভাইদের ছেড়ে আলাদা হয়ে ইন্ডিয়ার গোলাম হয়ে কেমন আছ? আমার পরিবারের এক পরিচিত প্রবাসিই এরকম সিচুয়েশনে পরেছিলেন। তো তিনি তখন ওদেরকে বাংলাদেশের ইকোনোমি, মিলিটারি আরও কি কি নিয়ে কমপেয়ার করে দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশ কত বেটার! আর পাকিস্তানিরা তখন নিশ্চুপ। আসলে ওরাও মনে মনে জানে আমরা সবদিক থেকে ওদের চেয়ে অনেক এগিয়ে! এক ক্রিকেটটা ছিল, সেটাতেও আমাদের সোনার ছেলেরা এখন বেশি ভালো করে। কিন্তু এতসব সমস্যার পরেও ওদের অহংকারের শেষ নেই। ভাবতেই অবাক লাগে। এসব শুনে আমি বাংলাদেশ কোন কোন দিক থেকে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে তা নাম্বারসহ মুখস্থ করে রেখেছি অনলাইন থেকে। আসলেই ঝেরে দেব। কিন্তু কেউ এখনো পর্যন্ত আমাকে ঘাটায়নি! আমার মুখস্থ করা জিনিসগুলো বোধহয় বৃথাই যাবে!

শ্রীলংকান: এদের কেন যেন অনেকদিক থেকেই আমাদের মতো মনে হয়। কারণটা ব্যাখ্যা করছি! একবার একটা প্রচন্ড মেধাবী শ্রীলংকান মেয়ে আমাদের স্কুলে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আসল এক সেমিস্টারের জন্যে। আমার কাউন্সিলরতো মহাখুশি আমার জন্যে। এতদিন প্রতি নতুন বছরে কোন বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এসেছে কিনা বলে বলে ওনার মাথার পোকা বের করে ফেলেছি। উনি ভাবলেন বাংলাদেশী না হোক কাছাকাছিতো। তো পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদের বন্ধুত্ব সহজেই হয়ে গেল। অনেক সিমিলারিটিস ছিল আমাদের মধ্যে।
একবার আমরা E.S.L ক্লাসের সামনে রাখা বিশাল ম্যাপে বাংলাদেশ আর শ্রীলংকা দেখছি। ও আমাকে দেখাল এটা শ্রীলংকা। আর আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল আরে এটাতো বাংলাদেশের চেয়েও ছোট। কোন কিছু মিন করে বলিনি, হাসতেই হাসতেই। ও মা! দেখি মেয়ের চোখ ছলছল করছে। তারপরে মিষ্টি হেসেই বলল, "ছোট হলেও আমাদের দেশ অনেক সুন্দর, অনেক বিচ আছে।" বুঝলাম ইমোশনে আঘাত হেনেছি। তাই দ্রুত সাবজেক্ট চেন্জ করলাম।
আমরা বাংলাদেশীরাও এরকমই। আমরা অতি আবেগপ্রবণ, আমাদের দেশকে ছোট করেও কেউ কিছু বললে মাথা গরম হয়ে যায়। সামনের মানুষটাকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি আমাদের দেশ কতো সুন্দর, কতো মহান। এছাড়া ওরা ভারতীয়, পাকিস্তানিদের মতো বাংলাদেশকে কখনো ছোট করে দেখেনা। যথেষ্ট মার্জিত ব্যবহার, বন্ধুভাবাপন্ন।
বিশেষ কিছু কথা: আমি যা লিখেছি শুধুমাত্র নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি। এই পৃথিবীতে অনেক ভালো ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং অনেক খারাপ শ্রীলংকান আছে। কিন্তু আমার কিংবা আমার আশেপাশের মানুষের অভিজ্ঞতা তেমনটাই যেমনটা আমি লিখেছি।
আর আমি প্রবাসি, এবং হবু প্রবাসী বাংলাদেশীদের একটা বিনীত অনুরোধ করব। দয়া করে বিদেশে যেয়ে উর্দু, হিন্দিতে ওদের সাথে কমুনিকেট করবেন না। ওরা তো আপনার ভাষা শিখতে আসছে না, তবে আপনি কেন ছ্যাবলা হবেন? আর বিদেশে গিয়ে ভারতীয়, পাকিস্তানিদের সাথে মিশে বাংলাদেশী ফ্ল্যাভার পাবেন এই আশা করবেন না। ওরা ভালো হোক খারাপ হোক আমাদের মতো না। অনেক আলাদা।
এমন অনেক প্রবাসি আছে যাদের ক্লোজ ভারতীয়, পাকিস্তানি বন্ধু আছেন, এবং তারা আমার এ লেখা পড়ে ক্ষুদ্ধ হতেই পারেন। তাদেরকে বলছি এটা আমার প্রবাস জীবনের, আমার অভিজ্ঞতার গল্প। আপনাদের সাথে না মেলাটা নিশ্চই আমার দোষ না। আর সবাই এক না তাতো আমি বলেছিই!
এ পর্ব কেমন লাগল এবং পরের পর্বে কি লিখব তা নিয়ে বলুন প্লিজ। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:৩২