বেশ কয়েক বছর যাবৎ শিশুদের সাথে কাজ করছি। কাজ করতে গিয়ে মানে তাদেরকে কিছু শেখাতে গিয়ে সাধারণ পদ্ধতি বা আমরা যেভাবে শিখেছি সেসব পদ্ধতি ব্যাবহার করে আমি যত না সফল হয়ছি তার থেকে শতগুণ বেশি সফল হয়েছি আমার অব্যার্থ কিছু বিনোদনমূলক টেকনিকস ইউজ করে। এই শিক্ষন সোজা ভাষায় বা সোজা কথায় দিতে গেলে কখনই এত সহজসাধ্য ছিলো না এবং স্টুডেন্ট এবং আমি মানে টিচারের সময়টাও এত আনন্দে কাটার বদলে হয়ত বিরক্তি বা বোরিং কেটে যেত।
শিশুদের সাথে ডাইরেক্ট কোনো টিচিং এ যাবার বদলে আমি গল্প বলা, গান বা নিদেন পক্ষে কথা বলা এবং খেলাধুলাকেই বেশি কার্য্যকরি মনে করি। আর শুধু আমিই না আসলে সারা পৃথিবীতেই এখন শিশুর আধুনিক শিক্ষা মানেই বিনোদনমূলক পদ্ধতিতেই শিক্ষা দান বুঝানো হয়। তাই আগের পোস্টে যেমন বলেছি গল্প বলা বা গল্প শোনা শিশুর শিক্ষনে এক অপরিহার্য্য উপকরণ ঠিক তেমনি খেলা এবং খেলনাগুলিও শিশুর মেধা ও মনন বিকাশের অন্যন্য উপকরণ বা ভেরি এফেক্টিভ রিসোর্সেস।
একজন মা, বাবা কিংবা অভিভাবকগন যখনই শিশুর জন্য খেলনা কিনতে যাবেন মাথায় রাখবেন ৫ টি প্রশ্ন-
১। খেলনাটি কি শিশুর বয়স উপযোগী?
২। খেলনাটি দিয়ে কি কোন ইন্টার্যাকশন শুরু করা যাবে?
৩। খেলনাটিকে কি ক্রিয়েটিভিটি বা সৃজনশীলতা, আগ্রহ এবং কল্পনাশক্তি বাড়ানোর একটি টুল হিসাবে ব্যবহার করা যাবে?
৪। এটি কি কোন কিছু শেখানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে?
৫। এটি কি নিরাপদ?
শিশুর বয়স অনুসারে খেলনা বাছাই করা অতি দরকারী আর তাই-
০ থেকে ১ বছর :
উজ্জ্বল রঙ বেরঙের খেলনা, সুন্দর শব্দ বা মিউজিক্যাল খেলনা এসব এ বয়সের জন্য সবচাইতে উপযোগী। উজ্জ্বল রঙ বা মিউজিক বাচ্চার দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণ শক্তি বুঝতে সাহায্য করে। সে রঙ ও শব্দের প্রতি নানারকম সাড়া বা ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নানা কিছুই শিখতে থাকে।
১ থেকে ২ বছর :
রাবার ডাক বা ভাসমান খেলনা, রঙ্গিন মোটা বই মানে যেসব বইয়ের পাতা শক্ত বা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো থাকে সে কারণে সে সহজে ছিড়ে ফেলতে পারেনা, এসব বই দিলে শিশু খেলার ছলে ফুল, ফল পশু, পাখি চিনে। রাবার বা প্লাস্টিকের ব্লক দেওয়া যেতে পারে। না না রকম ইজি পাজেল এসব তার সৃজনশীলতা বাড়াবে।
৩ থেকে ৪ বছর :
রঙ পেন্সিল, আর্ট কপি, বড় আকারের গাড়ি বা রকিং ঘোড়া, বল এসব হাত ও পায়ের পেশী শক্তি বাড়ায়।
৪ থেকে ৫ বছর :
বিল্ডিং ব্লকস, ক্লে সেট, প্লে ডো, কাগজ দিয়ে খেলনা বা অরিগ্যামী এসব বুদ্ধিমত্তা বিকাশে সহায়তা করে।
৫ থেকে ৬ বছর :
বিজ্ঞান সামগ্রী, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি, বারবি পুতুল, কম্পিউটার ও ভিডিও গেমস, স্পোর্টস ইক্যুইপমেন্ট।
ডঃ ইভ্লিন গাপুয, সেন্ট লুক মেডিক্যাল সেন্টারের একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, ৫ ধরণের খেলনা শিশুদের সৃজনশীলতা, আগ্রহ এবং কল্পনাশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। যেমন
১। Open-Ended Toys - ওপেন এন্ডেড কোয়েশ্চেন বা চিন্তা করার সুযোগ আছে এমন উত্তর চাই প্রশ্নের মত ওপেন এন্ডেড খেলনাও আছে আমি আগে জানতাম না। যাইহোক জেনে নিন, এই ধরণের খেলনাগুলোর মধ্যে আছে সাধারণ ব্লক টাইপ খেলনা যেমন, লেগো সেট, জোড়া লাগানো যায় বা সর্টিং করা যায় এমন খেলনা, পাজেল ইত্যাদি। এই খেলনাগুলো এমন যেগুলো দিয়ে শিশুরা অনেকক্ষণ ধরে নিজেদের মত করে অথবা অন্যকে সাথে নিয়ে খেলতে পারে, ভাবতে পারে, নিজের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। ২ বছর বয়সের পর থেকেই এই ধরণের খেলনাগুলো দিয়ে শিশুদের মধ্যে অভ্যাসটা তৈরি করে ফেলা জরুরি। বাড়িতে এবং স্কুলে দু জায়গাতেই শিশুর জন্য চাই এমন ধরনের খেলনাগুলি।
২। ক্র্যাফটিং করার জিনিসপত্রঃ ক্র্যাফটিং শিশুর বিকাশে কিভাবে ভূমিকা রাখে। আমি যখন ছোট ছিলাম সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম কখন মা ভাত ঘুম দেবে কিংবা কিচেনে যাবে অমনি চলতো আমার তার সিজার চুরি করে কাগজ কাটাকাটি কিংবা তার গ্লু নিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কোনো হাবিজাবি পান্ডিত্য করা। । অভিভাবকরা শিশুদের হাতে কাঁচি দিতে চান না। এরফলে তার মোটর স্কিল থেকে শুরু করে ক্রিয়েটিভিটির বারোটা বাজে তবে এখন পাওয়া যায় সেফটি সিজার। যা দিয়ে কাগজও কাটা যায় হাতও কাটেনা। শিশুর বয়স ৩ হওয়ার পর থেকেই ক্র্যাফটের নানারকম কাজে অংশ নিন তার সাথে। কেবল কাঁচি, রঙিন কাগজ, রঙ পেন্সিল আর আঠা দিয়েই কত মজার ক্র্যাফটের কাজ করা যায়।
৩। পাওয়া জিনিসঃ আমি একবার আমার বাসায় ইলেক্টিক কাজ চলছিলো তো কুঁড়িয়ে পেলাম একটি সরু কাঁচের টুকরো আর তার নীচে দাঁগ টানা কাগজ লাগিয়ে বানিয়ে ফেললাম থার্মোমিটার আর তাতে আমার কাপড়ের পুতুল বেবির জ্বর সারতে ততদিনই লেগেছিলো যতদিন না থার্মোমিটারটা ভাঙ্গে। আসলে শিশুদের কল্পনাশক্তি অসীম। তাই যেকোনো জিনিসকে তারা খেলার কাজে ব্যাবহার করতে পারে। সেটি চামচ, প্লেট, গাছের ডাল থেকে শুরু করে পানি, বালি, ইটের টুকরা, শুকনো পাতা যেকোনো কিছু হতে পারে।
৪। বোর্ড গেমঃ আমার ছোটবেলায় আমি লুডু খেলতে খেলতে স্বপ্নের মাঝেও লুডুর ছক দেখতে পেতাম। বাগাডুলি, ক্যারমবোর্ড বা দাবা। খেলে কি আজকালকার শিশুরা? নানাধরণের বোর্ড গেমগুলো শিশুর প্রবলেম সল্ভিং স্কিল বাড়ায়। তার চেয়ে বড় কথা এই গেমগুলো খেলতে হয় আরও অন্তত একজনের সাথে। অভিভাবকরা নিজেরা এই খেলায় অংশ নিতে পারেন শিশুর সাথে। আর স্কুলে অবশ্যই টিচারেরা। প্রবলেম সল্ভিং স্কিল বাড়ার পাশাপাশি এই গেমগুলোর মাধ্যমে শিশুরা নানাভাবে সোশ্যাল ইন্টারএকশনে যায়। এতে করে বন্ধুত্ব, কমুনিকেশন এবং নেগোসিয়েশন করার দক্ষতা বাড়ে শিশুদের।
৫। রোল-প্লে করার খেলনাঃ রোল প্লে আমার দারুন পছন্দের খেলা। প্রায় প্রতিদিনই আমি বাচ্চাদের সাথে এমন অভিনয় অভিনয় খেলা তবে অবশ্যই তার মাঝে লুকিয়ে থাকে শিক্ষা দীক্ষা সেসব করে থাকি। রান্নাঘরের সেট, ঘরের ফার্নিচার সেট, ডাক্তার রোল-প্লে সেট ইত্যাদি খেলনাগুলো শিশুদের রোল-প্লে করার সুযোগ তৈরি করে দেয়, নিজেদের মত একটি জগত তৈরি করতে এবং নিজের কল্পনাশক্তিকে বাড়াতে সাহায্য করে।
শিশুর মানষিক ও শাররিক বিকাশে খেলা এবং খেলনা গুরুত্বপূর্ণ বটে তবে অভিভাবকদের শিশুকে কোয়ালিটি সময় দিতে হবে। শুধু খেলনা দিয়ে আল্লার ওয়াস্তে ছেড়ে দিলেই চলবে না। একই কথা স্কুলের টিচারদের জন্যও প্রযোজ্য। শিশুদের জন্য সময় দেওয়া, এর চেয়ে ভালো কোন আর উপায় নেই। কিন্তু আজকাল শহর বা গ্রামের বাবা-মা দুজনেই ব্যাস্ত থাকেন, দুজনেই বাইরে কাজ করেন। ফলে শিশুর সাথে সময় কাটাতে পারেন অনেক কম। এ কারনেই দেখা যায় শিশুর শিক্ষন ব্যহত হয়। এ বছর আমাদের স্কুলে এডমিশন টেস্টের সময় অনেক বাচ্চাদেরকেই দেখেছি তারা আড়াই তিন বছরেও কথা বলতে পারছে না। বাবা মা স্বীকার করছেন অতিরিক্ত স্মার্ট ফোন গেম বা টিভি কার্টুনের প্রভাবে বাচ্চাদের এই স্পিচ ডিলে প্রবলেম। এই সব ডিজিটাল গেম শুধু সৃজনশীলতা বা কথা শেখাটাকেই প্রতিহত করে না এসব মনোযোগের অভাব থেকে শুরু করে আরও মারাত্মক সমস্যার জন্য অনেকাংশে দায়ী এই স্মার্টফোন। এবং অভিভাবকরা নিজেরাই দায়ী এটার জন্য। তারাই একটু সময় বাঁচানোর জন্য, শিশুকে একটু ব্যাস্ত রাখার জন্য, শিশুকে ঝামেলা ছাড়া খাওয়ানোর জন্য অথবা নিজের প্রিয় সিরিয়ালটা শান্তিতে দেখার জন্য নানা সময়ে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোন। আর যখন শিশুদের সমস্যাগুলো টের পায় ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়।
অভিভাবক ছাড়াও স্কুল, শিক্ষক, সমাজ ও দেশ ও রাষ্ট্রের কিছু ভূমিকা আছে শিশুর মানষিক, শাররিক বিকাশে খেলা ও খেলনার সুস্ঠ পরিচালনায়। আমরা সবাই কমবেশি জানি একটি শিশুর জীবনে খেলা কেনো এত প্রয়োজনীয় তবুও আরেকবার একটু মনে করিয়ে দেই-
১. খেলাধুলা শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করেঃ খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু একে অন্যের সাথে পরিচিতি গড়ে তোলে। নানা রকম খেলায় নানা রকম শিশুদের সন্মিলনে শিশুর নিজস্ব পারসোনালিটি বা ব্যাক্তিত্ব বিকশিত হয়। খেলতে গিয়ে শিশু খেলার নিয়ম কানুন ফলো করা শেখে। ডিসিপ্লিন শিখে।
২. সুস্থ শরীর গঠনেঃ খেলাধুলা শিশুর শরীরকে সুগঠিত করে। হাড্ডি ও মাসেল সুদৃঢ় হয়। প্রতিনিয়ত খেলাধুলা করলে শিশুদের উদ্দিপনা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফাইন মটর ও গ্রস মোটর স্কিল ডেভলপমেন্টে তাই ইনডোর আউটডোর দু ধরনের খেলারই দরকার আছে।
৩. বিনোদনের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম খেলাধুলাঃ শিশুর জন্য সকল বিনোদনের সেরা বিনোদন খেলাধুলা। ম্যুভি বা কার্টুন দেখা, গল্প বলা বা শোনা সবকিছুর চাইতে একটি শিশু খেলা দিয়েই সবচাইতে বেশি বিনোদিত হয়।
৪. ভাল আচরণ গঠনেঃ খেলতে গিয়ে কিভাবে প্রতিপক্ষের সাথে আচরণ করতে হয় বা খেলায় কিভাবে নিয়মকানুন মেইনটেইন করতে হয় কিংবা কিভাবে স্পোর্টিং মনোভাব বজায় রাখতে হয়। হার ও জিতকে সহজে কিভাবে মেনে নেওয়া যায় তাও খেলাধুলার মাধ্যমেই একটি শিশু শিখে থাকে।
মোট কথা শিশুর শিক্ষনে খেলাধুলার বিশেষ ভূমিকা আছে। কাজেই অভিভাবকদের সাথে সাথে একজন শিক্ষকেরও গুরু দায়িত্ব শিশুর এই দিকটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া। অভিভাবকগনের সাথে সাথে একজন ভালো টিচারের কাজ হবে-
বাচ্চাকে গল্প বলা এবং ছড়া ও গান শোনানো, ছোট ছোট প্রবেল সল্ভিং গেইম দেওয়া- ম্যাচিং, সর্টিং, গুছিয়ে রাখা, সাধারণ কথা বুঝতে শেখানো,বেশ কয়েকটা শব্দ দিয়ে কথা বলতে উৎসাহিত করাা,বাচ্চাদের কথা মন দিয়ে শোনা, বাচ্চার সাথে কথা বলা, যদি বাচ্চা তোতলায়, ধীরে ধীরে কথা বলতে উপদেশ দেওয়া, গল্প পড়া বা বলা এবং তাদের গল্প শোনা।
খেলনা দিয়ে খেলার সময় বাবা মা অভিভাবক এবং টিচারকে খেয়াল রাখতে হবে-
খেলনাতে আর কোনো লিঙ্গ বৈষম্য নয়ঃ পুতুল নিয়ে শুধু মেয়েরাই খেলবে আর ছেলেরা গাড়ি নিয়ে? এই মনোভাব বাদ দিতে হবে।জেন্ডার ভারসাম্য রক্ষা করা অতি জরুরি। একটা সময় মেয়েরা প্লেন চালাতো না, ড্রাইভ করতোনা বলতে গেলে কিন্তু এখন তো ভুরি ভুরি মহিলা গাড়ি, বাইক, সাইকেল চালক চারিদিকে তবে এখনও কেনো মেয়েদেরকে গাড়ির বদলে পুতুল আর ছেলেদেকে পুতুলের বদলে গাড়িতে উৎসাহিত করা! ছোট থেকেই এই সব মনোভাব যেন বেড়ে না ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ধ্বংসাত্মক খেলা এবং খেলনা এভ্যোয়েড করতে হবেঃ লেজার গান, পিস্তল বা বন্দুক, ছুরি জাতীয় খেলনা শিশুর মনে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করে। এসব নিয়ে খেলতে গেলে শিশু আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় দেয় কাজেই এইসব না দেওয়াই একজন অভিভাবকের উচিৎ হবে।
শিশুর জন্য স্বয়ংক্রিয় খেলনা পরিহার করাই ভালোঃ কারণ এ ধরনের খেলনা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কাজ করে বলে এতে বাচ্চার কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটে না। শিশুর মস্তিস্ক নিস্ক্রিয় থাকে। এর চাইতে যেখানে নিজে কিছু করার সুযোগ থাকে যেমন লেগো, ইঞ্জিনীয়ারিং টুল কিড, বিভিন্ন রকমের পাজল, বার্বি ডল হাউজ, কিচেন সেট, ডলস হাউস হতে পারে ভালো বিকল্প। বডি ম্যুভমেন্ট হয় এমন খেলনাও দরকার। ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস তৈরি করে।
শুধু ঘরের ভেতরে খেলাই নয়, শিশুর জন্য আউটডোর গেমসেরও অতি প্রয়োজনীতা আছেঃ
ইনডোর গেমসের সাথে সাথে শিশুর জন্য আউটডোর গেমসেরও প্রয়োজন আছে। তাই তাদেরকে পার্কে বা খোলা মাঠে নিতে হবে বা নিজের বাড়িতে বাগানে বা ছাদে খেলার ব্যাবস্থা করা যেতে পারে। আজকাল প্লাস্টিক স্লাইড পাওয়া যায়, ছোট রাবার স্যুইমিং পুল যা পাম্প দিয়ে ফোলানো যায় এবং পরে বাতাস বের করে ফেলা যায়। বাগান বা ছাদের একটা কোন বালি ভর্তি কনটেইনার বা ইট দিয়ে গেঁথে দেওয়া যায় যেখানে শিশুরা বিভিন্ন বালতি, চামচ এবং কাপ দিয়ে খেলতে পারে। রাবার, প্লাসটিক বা কাঁঠের ঘোড়া এসবো রাখা যেতে পারে। টেন্ট বা প্লে হাউসও বাগানে বসানো যায়। বালতি , পানি বা বা রাবার পাইপ দিয়েও খেলতে দেওয়া যেতে পারে। এতে শিশুর আনন্দ পাবার সাথে সাথে বিভিন্ন শাররিক উন্নয়ন ঘটে। হাত ও পায়ের পেশী শক্তি সুগঠিত হয় ও নানা অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে শিশু নানা কিছুই শিখতে থাকে। শিশুদের সাথে লুকোচুরি খেলা বা রেসিং এসবও দরকারী। আমরা অভিভাবকেরা বা টিচারেরা তখন নিজেরাই শিশুর খেলনা।
কিছু কার্য্যকরী ক্লাসরুম ইনডোর গেমস-
আমার ক্লাসের ভিডিও থেকে
কিচেন সেটঃ ছোটবেলায় আমরা মাটির হাড়িপাতিল থেকে শুরু করে এলুমিনিয়ামের ছোট্ট ছোট্ট হাড়ি কড়াই নিয়ে খেলেছি। আমাদের সঙ্গী সাথীরা ছিলো। একে অন্যের আইডিয়া এক্সচেঞ্জিং ব্যাপারটা ছিলো। কিন্তু আমাদের স্কুলে এসব নিয়ে খেলার কথা ভাবতেই পারতাম না। অথচ ক্লাসরুমে এই কিচেনসেট ব্যাবহার করে শিশুদের শেখানো যায় নানা রকম খাদ্যের নাম, ফলের নাম, শাকসব্জীর নাম, একই সাথে তৈজসপত্র বা ইউটেনসিলস চেনানো সম্ভব। আমি মাঝে মাঝে ভেলকো ভেজিটেবল কাটিং সেটটা নিয়ে ভাবি আমার ছোটবেলায় যদি আমি পেতাম এমন কিছু যেমন সব্জিটা কাটলেই কচ কচ শব্দ হয় ও কেটেও ফেলা যায় আমার কত মজাই না লাগতো তানা এসব খেলনার অভাবে সত্যিকারের বটি নিয়েই মা ঘুমালে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে কি রক্তারক্তি কান্ডটাই না হয়েছিলো। যাইহোক টিচারেরা শেখাতে পারে কিভাবে কাটতে হয় সেসব ফলমূল বা সব্জী সাথে সেফটি জিনিসটার ব্যাপারেও শিক্ষা দিতে পারেন যেমন সত্যিকারের ছুরি কাঁচি বা আগুন ছোটদের জন্য কতখানি বিপদজনক। রোলপ্লে, প্রশ্নোত্তর পর্ব, প্রেজেনটেশন, গ্রুপ ওয়ার্ক এসবের মাধ্যমে এই কিচেন সেট টাইপ খেলনাগুলো ব্যাবহার করে শিশুর শিক্ষনকে আনন্দদায়ক করা যায়।
ডক্টরসেটঃ এই ডক্টর সেট খেলনা দিয়ে রোল প্লে বা ডিসকাশন বা এক্সপলেনেশন দিয়ে শিশুকে ফার্স্ট এইড বা ডক্টর কিভাবে নাক কান গলা চেক করে বা মেডিসিন বা ইনজেকশন দেওয়া হয়। অসুস্থ্য হলে ডক্টর বা বাবা মাকে সহযোগীতা করা বা জানা কোন অসুখে কি ইউজ করা হয়। যেমন জ্বর হলে থার্মোমিটার, আইসব্যাগ ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন কোন অসুখ ছোঁয়াচে বা কোন কোন অসুখ কিভাবে স্প্রেড করে এবং কিভাবে সেসব প্রতিরোদ করা যায় আমাদের করনীয় কি এসব শেখানো সম্ভব।
ফ্রুটস বা ভেজিটেবল সেটঃ ফল ও শাকসব্জীর নামের সাথে সাথে তার রং ও আকৃতি শেখানো যায়। কোন ফল ও সব্জীর কি উপকারীতা, খেলে কি কি রোগ প্রতিরোধ হয়, সালাদ বা স্যান্ডুইচ কিভাবে বানানো যায়। ব্রেকফাস্ট টাইম বা ব্রেকফাস্টে কি কি খাবার আমরা খাই বা লাঞ্চ বা ডিনারের পরে কি কি ফল খাওয়া যায় সেসবও শেখানো যায়। এখানেও রোল প্লে বা ডিসকাশন বা এক্সপলেনেশন এমনকি গ্রুপ ওয়ার্ক বা আউটিং ও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ম্যাগনেটিক বলস, প্লে ডো, ব্লকস বা টুলসেটঃ এসব শিশুর সৃজনশীলতা বাড়ায়। শিশুর সাথে প্রাথমিক বর্ণনা বা কিভাবে আমরা এসব ব্যবহার করতে পারি দেখানোর পর এককভাবে বা দলীয়ভাবে খেলায় অংশ নেওয়ানো যায়। শিশু তার সৃজনশীলতা দিয়ে যা তৈরী করবে তা ক্লাসরুমের কোনো এক কর্নারে ডিসপ্লে করলে শিশুর উৎসাহ বাড়ে।
স্যান্ড বক্স বা স্যান্ড ট্রেঃ স্যান্ড বক্সে ছোট প্লাসটিক কোদাল, বালতি, মাগ এসব দিয়ে রাখলে এবং সেসব দিয়ে স্যান্ড ক্যাসেল বানানো বা যে কোনো আকৃতি বানানো শেখালে শিশু যেমনই আনন্দ পায় তেমনি শিশুর কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটে এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। আমার আউটডোর খেলার ক্লাসে আমি তাই স্যান্ড বক্স খেলা শিশুদের সাথে নিজেই উপভোগ করি। এছাড়াও স্যান্ড ট্রেতে আমি আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি করে লেখা শিখিয়ে যে উপকারীতা পেয়েছি তা আমি আর কোথাও পাইনি।
টাচ কার্ড, ফ্লাশ কার্ড বা ছবিঃ শিশুর বর্ণ পরিচয়ের সাথে সাথে ছবির ব্যাবহার সকলের জানা তবে বই ছাড়াও ফ্লাশ কার্ডের ছবি ও বর্ন ব্যাবহার করে শিশুর শিক্ষনকে মজাদার ও তরান্বিত করা যায়। আর টাচ কার্ডে পয়েন্টার দিয়ে রাইট ওয়ে অব রাইটিং ফলো করালে শিশুর জন্য লেখা শেখাটা অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়।
স্টোরি ব্যাংকঃ যদিও আমার আজকের টপিক খেলা তবুও এখানে আমি পুরোনো টপিক স্টোরি নিয়ে আসলাম কারণ স্টোরি টেলিং এর সাথে স্টোরি ব্যাংক বা রিসোর্সেস ইউজ করার ক্ষেত্রে এই কিচেন সেট থেকে এনিমেল সেট বা ডলস বা গাড়ি ঘোড়া খেলনা সবই জড়িয়ে আছে। কাজেই বাসা বা ক্লাসরুমে বা লাইব্রেরীতে রাখতে হবে একটি স্টোরি ব্যাংক। এখানে থাকবে গল্প বলার সাথে সাথে তা নানা রকম রিসোরসেস বা উপকরণ ব্যাবহার করে আরও বেশি মনোহর করা যায় তার ব্যাবস্থা। হতে পারে একটি খালি বক্স বা টিনের বাক্স বা ছোটখাটো কাবার্ড। যেখানে থাকতে পারে পাপেট পুতুল, ছবি, ফ্লাশ কার্ড, ইউটেনসিলস,এনিমেলস, পেপারস, কোয়েশ্চেন কিউব, কোয়েশ্চেন স্ট্রিপস ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
এখানে প্রি স্কুলে ব্যবহারযোগ্য কিছু খেলনার ইউ টিউব লিঙ্ক দেওয়া হলো-
রঙ আর গণনা শেখাতে উপোযোগী খেলনা
প্লে ডো - কল্পনাশক্তি বিকাশে এবং ফাইন মোটর স্কিল বাড়াতে এর চাইতে আর কি ভালো উপায় হতে পারে?
Toy Kitchen Playset for Kids
ডক্টর সেট
ফ্রুটস ভেজিটেবলস
ফিসিং গেম
স্যান্ড বক্স
টুলবক্স
বোলিং
ম্যাগনেটিক বল
একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনার সাথে সাথে কিছু গুরু দায়িত্ব পিতা মাতা, সমাজ, সংসার দেশ ও দশের উপর বর্তায়। তার মাঝে সবচাইতে বড় দায়িত্বটাই সুশিক্ষা আর তাই এই সুশিক্ষা হোক আনন্দময় ও সফল এই কামনা করে আজকের লেখা শেষ করছি।
এই লেখা আমি রোকসানা আপু, মনিরা আপু আর করুনাধারা আপুর জন্য উৎসর্গ করলাম। আমার এর আগের পোস্টে তাদের মন্তব্য এই লেখার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে!
লেখাটি আমি নিজের টিচিং এক্সপেরিয়েন্স ও এই ওয়ার্কশপ হতে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোকে লিখেছি