somewhere in... blog

তোমার আর আমার গল্প- সায়ান তানভি ও শায়মার গল্প

২১ শে জুন, ২০১৬ রাত ৮:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আদালতের কাঁঠগড়ায় ঠিক ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না আমি।আমার উলটোদিকে, আমারই মত মৌন মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো শাওন। আজ পাঁচ মাস পাঁচ দিন হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে অথচ এই কদিনের মাথাতেই ওকে ডিভোর্স দিতে এসেছি আমি।
-আপনি অভিযোগ করেছেন আপনার স্বামী আপনাকে শারীরিক নির্যাতন করেন, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন, আপনাকে ...ব্লা ব্লা ব্লা ।
মাথাটা টলে উঠলো আমার। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে কাঠগড়ার সামনের দিকটা ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । ম্যাজিস্ট্রেট আবারও আমাকে জিগাসা করলেন..... বলুন এসবই তো আপনার অভিযোগ, নয় কি?
আমি কোনোমতে উত্তর দিলাম - হ্যাঁ ।
আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করলো অঝোরে, ঝাপসা চোখে এক পলক দেখলাম শাওনের ভাবলেশহীন নির্বিকার মুখটি। সে ওর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ,মিথ্যা তো অবশ্যই, অপকটে মেনে নিলো।আমি জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পরলাম ।
এমনই ছিলো সাড়ে নয় বছরেরও একটু বেশি সময় আগে শাওনের সাথে আমার দেখা হবার শেষ মুহুর্তটুকু। আজ এতগুলো দিন পরে শাওন বসে আছে আমার সামনে। শাওন, আমার গভীর ভালোবাসা,খুব যতনে গোপন করে রাখা অসীম অনুভুতির সেই মায়াময় মুখটি, ঠিক সেদিনের মতই ভাবলেষহীন- নির্বিকার, যেন কিছুই হয় নি। মাঝে এতগুলো দিন কেটে যায় নি, বছরের পর বছর বয়ে বেড়ানো দুঃসহ বেদনার কোনো ছাঁপই নেই ওর চোখে মুখে। ঠিক আগের মতই আছে শাওন। খুব একটা বদলায় নি। সেই সাদামাটা সাদা নিলের কুচি চেক শার্ট, উস্কোখুস্কো চুল, একটা বলপয়েন্ট পেন উঁকি দিচ্ছে ওর বুক পকেটে ।অস্ফুটে বেড়িয়ে আসা একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস আমি চেপে ফেলি গোপনে। কি ক্ষমাহীন অন্যায় করা হয়েছে ওর সঙ্গে । আমার বুক ফেটে কান্না আসে। চোখ জলে টলমল করতে থাকে।আমি অন্যদিকে তাকিয়ে কান্না লুকোতে চেষ্টা করি। শাওন মুখ খোলে।
- কেমন আছো রুমকি? ওর স্বাভাবিক শান্ত কন্ঠ আজ এতগুলো দিন পরেও বুকের মধ্যে ঝড় তোলে আমার। আমি কান্না চেপে রাখতে পারি না আর। দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠি। শাওন চুপচাপ বসে থাকে। আমাকে কাঁদবার সুযোগ দেয় ও। ও তো আমার অন্তর্যামী বলতো নিজেকে,ও কি জানে না কি অপরিসীম কষ্ট বুকে চেঁপে আছি আমি! কি দুঃসহ বেদনার কাঁটা অহর্নিশ গেঁথে আছে আমার বুকের মধ্যে।
আমার চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা ওর হাত দুটোর উপর । সেই মায়াময় শিল্পীর হাত। যেই হাঁত একটা সময় একের পর এক এঁকে গেছে আমারই ছবি। কত কত চুম্বন একেছিলাম আমি ওর দুহাতে। ওর হাত দুটো আমার ভীষন প্রিয় ছিলো।এই হাত দিয়ে বেরিয়ে আসা বহু অনন্য ছবির সাক্ষী আমি,এই সেই শিল্পী শাওন, যার প্রেমে পড়েছিলাম আমি, সে এক উথাল পাথাল প্রেম।
মুখ তুলে ভেজা চোখেই ওর হাতে হাত রাখি আমি। ঠিক সেই প্রথম দিনের মতই সম্পূর্ণ মুঠোয় পুরে ফেলে ও আমার হাত দুটো। সেই দিনের মতই অভয় জাগায় মনে। আমি একা নই । কেউ আছে আমারই সাথে..আজও..


**********************************************


রুমকির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় একটা আর্ট একজিবিশনে, আমার প্রথম একজিবিশন ছিল সেটা, রুমকি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার আঁকা জল রঙের কাজগুলো দেখছিল আর আমি সবার অগোচরে খুব মনোযোগ দিয়ে ওর মুখ দেখছিলাম। মায়াময় অনিন্দ্য এক ঝলমলে মুখ,সাথে মিশে আছে প্রচ্ছন্ন বিষাদ। এই মুখ অসাধারণ,দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য আর মোহময়। আমি অনেকটা সময় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম রুমকির সৌন্দর্যের আভিজাত্যে। ও যখন গ্যালারী থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো আমার সম্বিৎ ফিরলো হঠাৎই ,আমি দৌড়ে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম। কোন ভূমিকা ছাড়াই তড়িঘড়ি বললাম,আপনার একটা স্কেচ করতে চাই আমি, সত্যি বলতে আপনি আমার দেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয়া রমণী, আপনার সৌন্দর্য যেকোনো জীবিত অথবা মৃত রমণীকে হার মানাবে। আপনার ছবি আমাকে আঁকতেই হবে। রুমকি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিল, এরপর চোখ মুখে বেশ বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, ননসেন্স। স্রেফ এইটুকুই, আর কিছুই না। গট গট করে হেঁটে চলে গেলো। একটু নাটকীয় মনে হলেও সেদিন এমনই ঘটেছিল।
রুমকির এমন শীতল আর অপমানজনক ব্যবহার একটু নিরাশ করলেও হৃতোদ্যম করতে পারে নি আমাকে। ওই দিনের পর থেকে আমি ওকেই খুজতাম পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। কিন্তু ওকে খুঁজে পাই নি, কোথাও না, কলা ফ্যাকাল্টি, চারুকলা, টি এস সি, কার্জন হল, পলাশীর মোড় অথবা শাহবাগের ক্ষয়িষ্ণু বাম দলগুলোর বাকসর্বস্ব জনশূন্য মিটিংগুলোর ভীড়ে, কোথাও না!
অবশেষে রুমকিকে পেলাম একদিন আচমকাই অপ্রত্যাশিত ভাবে, মহিলা সমিতিতে নাটক দেখতে গিয়ে। মেয়েটা আমাকে দেখে হাসছিলো, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এতো অবিশ্বাস্য মুগ্ধকর হাসি আমি এর আগে কোন অষ্টাদশীর মুখে দেখি নাই। শুধু মুগ্ধতা নয়, সে হাসিতে মিশে ছিল রহস্যময়তা -প্রেম, প্রশ্রয়ের আভাসও। আমি খানিকটা অবাক হয়েছিলাম আর ওকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দের কথা তো বলাই বাহুল্য।
আমি থ হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম! রুমকি বলল, শাওন আমি তোমাকে খুব ভালো ভাবেই জানি- চিনি, তুমি যে এখানে আসবে আজ তাও জানতাম। তুমি গত এক মাস আমাকে খুঁজে পেতে কি কি করেছ তাও আমি জানি। আমি তোমাকে প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম, তোমার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম, একদিন তো তোমার সঙ্গে ধাক্কাও লাগিয়েছিলাম। বলেই হেসে ফেললো। আমি যেদিন থেকে টের পেলাম তুমি পিছু লেগেছ, আমার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এলো, আমি পরদিন থেকে মুখ ঢেকে বোরখা পরে ক্যাম্পাসে আসতাম।
রুমকির এসব কথা শুনে আমার তখন পুরোপুরি বোকা বনে যাওয়ার অবস্থা, ফ্যালফ্যাল করে ওর কথা শুনছিলাম আর ওর অনিন্দ্য সুন্দর হাসিমাখা মুখটা দেখছিলাম ।ও আমাকে কিছুটা পাশে নিয়ে গেলো, একটু নির্জন জায়গাটা। আমরা দুজন পাশাপাশি বসলাম। রুমকি গত একমাসের গল্প বলতে শুরু করলো। আমি জানলাম ওর পুরো নাম হুমায়রা রুমকি ,নামটা শুনেই আমার বাকরুদ্ধ হওয়ার অবস্থা, কি অদ্ভুত মুগ্ধতা নামটায় জড়িয়ে আছে ।একটা রাজকীয় আভিজাত্য,কাব্যিক ছন্দ,শ্রুতিমধুর সুর আর সুরার মাতালতা অথবা বেলির ঘ্রান যেন হুমায়রা রুমকির প্রতিটা পরতে পরতে মিশে আছে ।
রুমকি গল্পের ঝাপি খুলে বসলো, সেদিন একজিবিশনে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্তটা আমার চোখে এখনো স্পষ্ট ভাসে ,যদিও সেটা আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর ছিল ।আমি মনে মনে বেশ রেগে ছিলাম, তুমি আমাকে পুরোটা সময় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলে ,আমি ঠিকই টের পেয়েছিলাম, তুমি শুধু মুখ না পুরো শরীরই গিলছিলে চোখ দিয়ে, শিল্পীগুলো চরিত্রহীনই হয় সেদিন খুব ভালো ভাবেই মনে হচ্ছিল, তুমি এটা অস্বীকার করতে পার না,আমি যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমাকে কিছু কথা শোনাবো কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলি নাই, শত হলেও শিল্পী মানুষ তুমি কিন্তু বের হওয়ার মুখে তুমি যখন আমার পথ আগলে দাঁড়ালে আর আমার স্কেচ করতে চাইলে আমি মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম ,যদিও সেটা আমার আচরণে প্রকাশ করি নি। আমি তোমাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম। রুমকি হাসতে শুরু করলো। সেই কাঁচভাঙ্গা জলতরঙ্গ হাসি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক মোহিনীকে, যার হাসির সঙ্গে দুলে উঠে পুরো শরীর, মোহনীয় ভঙ্গিতে।


**********************************************


আমরা খুব তাড়াতাড়ি ছ'মাসের মধ্যেই বিয়ে করে ফেললাম! এত শিঘ্রী বিয়ের কোনো পরিকল্পনা ছিলো না আমাদের তবুও করতে হলো। বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন ।
আলিশান বাড়ি আর নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে উঠলাম শাওনের এক রুমের বাসায়। ঐ রুমের সাথেই ছিলো এক টুকরো ছাদ। সে রাতে সারা আকাশ জুড়ে ছিলো ঝিকিমিকি তারার মেলা। আমার গায়ে কোনো নববধুর গয়না ছিলো না। খুব সাদামাটা একটা আকাশী রঙ শাড়ি আর খোঁপায় জড়ানো ছিলো সুবাসিত বেলিফুলের মালা। সেই ঝিকিমিকি তারা ভরা রাত আর বেলিফুলের স্নিগ্ধ অপরূপ সুবাস আজও হঠাৎ হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে আসে বাতাসে। আমার পঞ্চইন্দ্রীয় দিয়ে প্রাণপনে তা কিছুক্ষণ ধরে রাখার চেষ্টা করতে না করতেই পালিয়ে যায় আবার। হঠাৎ আসে, হঠাৎই যায়। কি ভীষন সুন্দর রোমান্টিক রাত ছিলো সেদিন। খুব দখিনা বাতাসও বইছিলো সেই রাতে। কখনও ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম, কখনও পাশাপাশি, ছাদে ছিলাম আমরা প্রায় মধ্যরাত্রী পর্যন্ত! সেই স্বর্গীয় মধুর মধুচন্দ্রিমার রাত ঠিক ঐ ভাবে অপার্থীব সুন্দরভাবে সবার জীবনে আসে কি না জানা নেই আমার।
কিছুদিনের মাঝেই শাওনের সেই পলেস্তারা খসে পড়া বিতিকিচ্ছিরি কামরাকে স্বর্গ বানিয়ে ফেললাম আমি। শাওন শিল্পী ছিলো বটে তবে ওর সেই পুরনো আবাসস্থলটাকে শিল্পসন্মত করে তুললাম আমি আমার মনের প্রতি বিন্দু ভালোবাসায় মুড়িয়ে।
শাওন ছবি আঁকতো আর আমি হতাম ওইসব ছবির মডেল । ঘন্টার পর ঘন্টা জামা কাপড় খুলে চুপচাপ বসে- দাড়িয়ে বা শুয়ে থেকেছি ওর সামনে , চেয়েছি শাওন অনেক বড় কিছু একটা করে ফেলুক ,বিখ্যাত কোন শিল্পকর্ম উপহার দিক, যেই ছবি সাড়া জাগাবে পুরো বিশ্বে মোনালিসার মত ।
আমাদের সেই পাঁচমাসের জীবনে কোনো দুঃখ ছিলো না । ছিলো শুধু ভালোবাসা আর অনিঃশেষ বাঁধভাঙ্গা প্রেম। লাগামহীন, বাঁধনছেড়া। আমরা ভালোবাসতাম, অভিমান করতাম, আবারও ভালোবাসতাম!

**********************************************

সাড়ে নয় বছর! একদম কম নয় সময়টা। আমি বেঁচেই ছিলাম কিন্তু এটাকে জীবন বলা হলে এরচেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। রুমকি আমাকে ডিভোর্স দিয়েছিল, আমি জানি না, হয়তো বাধ্য হয়েছিল বা যাইহোক, আমি কষ্ট পেয়েছিলাম প্রচণ্ড। কেউ দেখতে পায় নি, অনুভব করতে পারে নি কি পরিমান যন্ত্রণা -ব্যথা আমি বয়ে চলেছি এই দীর্ঘ সময় ধরে ।গভীর রাতে অন্ধকার ঘরে গাল বেঁয়ে গড়িয়ে পড়া জলের স্পর্শ কেবল অন্ধ রাতই হয়তো টের পেতো ।
আমি এমনিতেই একা আর স্বজনহীন ছিলাম, রুমকি চলে যাওয়ার পর একদমই একা হয়ে গিয়েছিলাম, কিছুই ভালো লাগতো না ।সারাদিন কেবল পুরনো দিনের কথা ভাবতাম,ক্ষণস্থায়ী সংসারের দিনগুলো চোখের সামনে ভাসতো। সেই প্রথম দেখার মুহুর্ত, সেই টিএসসির বিকেল, মধুর ক্যান্টিন, সব ছাপিয়ে রুমকির হাস্যোজ্জ্বল অনিন্দ্য মুখশ্রী!
রুমকির সাথে বিচ্ছেদের পর আমি চলে গেলাম লোকালয় ছেড়ে বহুদূরে। আদিবাসীদের গ্রামে। আমার জীবনের সকল আশা, ভরসা, আবেগ, উচ্ছাস বুঝি রুমকির সাথেই বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। কোনোদিন আমি উচ্চাকাঙ্খী ছিলাম না। শুধু আপনমনে ছবি আঁকতেই আমার ভালো লাগতো। নানা রকম রঙে আমি সুখ ও দুঃখের ছবি আঁকতাম তবে রুমকি আমাকে চিনিয়েছিলো ভালোবাসার রঙ।
রুমকির সাথে এক একটি ছুটির মধ্য দুপুর, পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে খুনসুটি, জানালা দিয়ে ধেয়ে আসা গ্রীস্মের প্রচন্ড দাবদাহে কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁকে বসে থাকা কাক দম্পতি, এসব প্রচন্ড ভালোবাসার ছবি আমি অনেকদিন আঁকতে চেয়েছি।আঁকতে চেয়েছি পড়ন্ত বিকেলের কোমল আলোয় ছাদে মোড়া পেতে চা আর মুড়িমাখার ভালোবাসার ছবি অথবা প্রথম বর্ষায় আমাদের যুগল স্নানের স্মৃতি।
অজস্র ভোর আমরা পর্ণকুটিরের সামনের এক চিলতে পার্কের ঘাসে হেঁটে ফিরেছি । তারপর দুজন মিলে রান্নার আয়োজন, কলতলায় স্নান। রুমকি, ঝকঝকে পলিশ করা দেহ বল্লরীর রুমকি পরম ভালোবাসায় আকড়ে ছিলো ছন্নছাড়া সেই আমাকে স্বল্প কয়েকটা দিন। তার আগে এই দুনিয়ার সবখানেই আমি ছিলাম চরম অপাংক্তেয় । এমন করে কেউ কখনও আগে ভালোবাসেনি আমায়! এমন করে কেউ কখনও দুঃখও দেয়নি আমাকে।

**********************************************

আমার নিজ হাতে গড়া সেই স্বপ্ন সুন্দর একরতি স্বর্গের মত সংসার ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিলো যেদিন, সেদিনটা আমার খুব মনে পড়ে। সেদিন হঠাৎ এক পড়ন্ত দুপুরে আকস্মিক সংবাদ আসে! বাবা খুব অসুস্থ। এক নিমিশে আমি সব ভুলে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকি। বাবার কাছে যাবার জন্য আকুল হয়ে উঠি।আর এই যাওয়াই হয় আমার শেষ প্রস্থান ।বাবা আমাকে আর আসতে দেন নি, ব্লাকমেইল করে শাওনকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করেন ।
কিন্তু বহু চেষ্টা করেও বাবা আমাকে আবার বিয়ে দিতে পারেন নি। কয়েক বছর পর বাবার মৃত্যু হয় । শুরু হয় আমার একাকী পথচলা। তবুও লজ্জায় আর কখনও শাওনের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস পাই নি আমি। যদিও আরও একটি যুদ্ধ আমাকে একাই যুঝতে হয় এরপর। ডিভোর্সের সময় আমি ছিলাম ৩ মাসের অন্তঃসত্বা,বাবার শত হুমকি ধামকি, অনুরোধের পরেও আমি এবরসন করতে রাজি হই নি ।
শ্রাবনকে নিয়ে আমি একাকী পাড়ি দেই এর পরের নয়টা বছর। শ্রাবন আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করে ওর বাবার কথা। আমি ওকে আশ্বাস দিয়েছিলাম খুব শিঘ্রী আমি বাবার সাথে দেখা করিয়ে দেবো তাকে।

**********************************************

এতগুলো বছর পর রুমকি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে! এটা কি ভীষন বিস্ময়কর! আমিতো চিরতরেই ওকে বিদায় বলেছিলাম । আমি কারো কাছে কখনো কিছু চাই নি, চরম দূর্দিনেও না ।আমি কেবল আমার মতো বাঁচতে চেয়েছি আর তাই বেঁছে নিয়েছিলাম এই একাকী,নির্ঝঞ্ঝাট,নিস্তরঙ্গ জীবন!
রুমকি বুড়িয়ে গেছে অনেকটা, ওর বিষাদ ভরা চোখে ভিড় করেছে যেন রাজ্যের বেদনা ।রুমকির এমন রুপ আমার অদেখা। ও ছিল প্রাণবন্ত, জ্বলজ্বলে, উচ্ছল। ওর উপস্থিতি যেকোনো পরিস্থিতিতেই উদ্দীপ্ত করতো আমাকে। এই রুমকি আমার অপরিচিত তবুও ওর সেই বিষাদমাখা চোখে চোখ রেখে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে আমার।
রুমকির অনুরোধে পরদিন ওর বাড়িতে গেলাম। এই প্রথম এ বাসায় আসা আমার। রুমকির পেছনে আড়াল হতে উঁকি দেয় ছোট্ট ৮/৯ বছরের ঝাঁকড়াচুলো মিষ্টি এক ছেলে । ওকে দেখে চমকে উঠি । মনে হয় কোথায় যেন দেখেছি এই ছেলেকে।
এতগুলো বছর পর রুমকীর আমাকে ডাকার কারণ পরিষ্কার হয়ে যায়। হিম শীতল রক্তস্রোত বয়ে যায় আমার মেরুদন্ড বেয়ে। দূরারোগ্য কান্সারে ভুগছে রুমকি। তার মৃত্যুর পর এই ছেলের দায়িত্ব সে তার বাবাকেই দিয়ে যেতে চায়। আমি নির্বাক বসে থাকি।

**********************************************

প্রায় বছরখানেক হলো, এখানে আছি আমরা। শ্রাবন আর আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। পাহাড়ী পাথুরে পথ বেয়ে হেঁটে যাই আমরা বহুদূর। ফিরে এসে আমি ওর জন্য নাস্তা বানাই, চা বানাই। দুজনেই স্কুলের পথ ধরি। একই স্কুলে বাচ্চাদেরকে ছবি আঁকা শেখাই আমি । ফিরে আসি বিকালে। আমি ওকে সাইকেল চালানো শিখাই, শিখাই কিভাবে মার্বেল খেলতে হয়, রোজ বিকেলে ডাংগুলি খেলি আমরা পাহাড়ী বাচ্চাদের সাথে। শ্রাবন এই মুক্ত বিহঙ্গ জীবনে সবটুকু স্বাধীনতা আর আনন্দ নিয়ে বাঁচুক, বুক ভরে শ্বাস নিতে শিখুক, সেটাই চাওয়া আমার। আমি চাই না যে স্নেহ, মমতাহীন একাকী পরাধীন জীবন আমি কাঁটিয়েছিলাম আমার শৈশব আর কৈশোরে, সেই জীবনের এক ফোটা নিরানন্দ প্রবেশ করুক শ্রাবনের জীবনে।
আমি ওকে আমার শৈশবের কথা বলি। কেউ ছিলোনা আমার। আমার কোনো আনন্দ ছিলোনা, ভালোবাসা ছিলো না। সব এক লহমায় পূর্ণ করে দিয়েছিলো এক রমনী, সে তার মা। আমার সারাজীবনের অপ্রাপ্তির বেদনা ভরিয়ে দিয়েছিলো সে। আমি ওকে আমাদের দেখা হবার কথা বলি। বিয়ের কথা, সংসারের কথা...... এত আনন্দের কথা বলবার সময়ও আমার চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে কখন জল গড়ায় বুঝতে পারি না আমি। শ্রাবন তার ছোট ছোট হাতে মুছে দেয় আমার চোখের গড়িয়ে পড়া জল।

রুমকি মারা যাবার দিন সন্ধ্যায় শ্রাবন আকাশে আবিষ্কার করেছিলো একটি তারা। রোজ সন্ধ্যায় আমরা দুজন ঐ তারাটার সাথে সারাদিনের সব গল্প করি। তারাটা চুপ করে শোনে। শ্রাবণ জানে মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়।
এক পরম মায়াবিনী দুখী প্রেমিকা আর মমতাময়ী মায়ের স্মৃতি আর ভালোবাসা নিয়ে কাটতে থাকে আমাদের দিনগুলো .. আমরা অপেক্ষা করি..






*** সায়ান তানভি ভাইয়া। আমার এবং অনেকেরই অনেক অনেক অনেক প্রিয় লেখক। তার গল্প পড়ে মুগ্ধ হই আর মুগ্ধ হই! তাই তার সাথে আমার এই গল্প লেখার প্রচেষ্টা! :)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ৮:১৭
৪৫৬ বার পঠিত
১০১টি মন্তব্য ১০৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এক্স লইয়া কি করিব

লিখেছেন আনু মোল্লাহ, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫১

যাচ্ছিলাম সেগুনবাগিচা। রিকশাওয়ালার সিট কভারটা খুব চমৎকার। হাতে সেলাইকরা কাঁথা মোড়ানো। সুন্দর নকশা-টকশা করা। নর্মালি এররকম দেখা যায় না। শৈল্পিক একটা ব্যাপার। শুধু সিটকভার দেইখাই তার-সাথে কোন দামাদামি না কইরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইলিশনামা~ ১

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


১৯৮৫ সালে ডক্টর মোকাম্মেল হোসাইন ‘ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যেই রিসার্চ পেপারটা( থিসিস – এম এস এর জন্য) জমা দিয়েছিলেন সেটা এখানে মিলবে;
[link|https://open.library.ubc.ca/cIRcle/collections/ubctheses/831/items/1.0096089|Spawning times and early life history of... ...বাকিটুকু পড়ুন

৯০% মুসলমানের এই দেশ? ভারতে কতগুলো মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করা হয়েছে? গতকালও ভারতে মসজিদের পক্ষে থাকায় ৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪২

সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার | SAD

লিখেছেন আজব লিংকন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৩



শীতকালীন সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, কনজাংকটিভাটিস, নিউমোনিয়া কিংবা খুশকি মতো কমন রোগের কথা আমরা জানি। উইন্টার ডিসঅর্ডার বা শীতকালীন হতাশা নামক রোগের কথা কখনো শুনেছেন? যে ডিসঅর্ডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্টগ্রাম আদালত চত্বরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি

লিখেছেন শান্তনু চৌধুরী শান্তু, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮



আজ চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নানান গুজব ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা এড়াতে প্রকৃত ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×