বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে......
এ প্রবাদ বাক্যটি তখনও পড়িনি, তখনও পৃথিবীর অনেক রহস্যই জানা হয়নি কিন্তু জগতের কি এক অপার রহস্যবলে জেনে গিয়েছি সে অমোঘ সত্যটি যে মায়ের কোলটিই শিশুদের জন্য সবচাইতে নিরাপত্তার স্থান। সে মা হোক না কোনো মানবী বা কোনো পশুমা। যার যার শিশুর পরম নিরাপত্তার স্থান তার জন্মদাত্রী মায়ের কোল।
কিন্তু যখন ৪/৫ বছর বয়সে বিশাল সিনেস্ক্রিনে ভেসে উঠতে দেখলাম গহীন সবুজ বন আর সে গভীর বনে ছোট্ট এক শিশু ঝুড়ির মধ্যে হাত পা নেড়ে কাঁদছে। আশে পাশে তার মা বাবা কোনো জনমনিষ্যির দেখা নেই আর আরো ভয়ংকর দৃশ্য এক নেকড়ে সে কান্না শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলো। শিশুটিকে মুখে তুলে নিয়ে ছুট লাগালো নিজের বাড়ির দিকে। তখন সেই ছোট্ট আমার চোখও গুল্লু গুল্লু হয়ে গেলো। আর আরো আরো চোখ গুল্লু গুল্লু করে ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছিলাম বুঝি এখুনি মহাভোজ হবে নেকড়ে ও তার সন্তানদের এই সুন্দর ফুটফুটে শিশুটির শরীর ছিন্ন ভিন্ন করে তাদের ধারালো নখরে।
কিন্তু আমার ভয়কে অমূলক করে দিয়ে কিছু পরেই সিনেস্ক্রিনে ভেসে উঠলো সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য! নেকড়ের পিঠে চড়ে মানব সন্তান মুগলী ছুটে চলেছে। এক গাছের ডাল হতে আরেক গাছে সাঁই সাঁই করে বন বাঁদাড় পার হয়ে চলা। ( মনে আছে পরে এমন করে ছুটবার ইচ্ছেয় পর্দা ধরে ঝুল খেয়ে পর্দার লাঠি সহ মাথায় ভেঙ্গে পড়ে মায়ের হাতে, পিঠে তাল পড়ার কথা) সে যাই হোক মুগলী বেশ আয়ত্ব করে নিলো দুঃসাধ্য সব কার্য্যকলাপ যা মানব সন্তানদের জন্য মোটেও সহজসাধ্য নয়। খুব অবাক হয়েছিলাম কি করে সম্ভব ঐ গহীন বনে বানরের মত লাফিয়ে চলা, ডাল হতে ডালে ঝুলে ঝুলে এই ভাবে গভীর খাদ পেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু সে ছিলো চলচ্চিত্র। সিনেমায় তো কত কিছুই হয়। এতে আর অবাক হবার কি আছে?
কিন্তু অবাক হলাম বেশ বড় হয়ে! যেদিন জানলাম সিনেমার বাইরের এই বাস্তবেই জন্ম নেওয়া এমনি দুজন অমলা আর কমলার কথা।
http://en.wikipedia.org/wiki/Amala_and_Kamala
Click This Link
Click This Link
এরপর এক হিন্দী সিনেমায় দেখলাম হসপিটাল হতে চুরি হয়ে যাওয়া জমজ বাচ্চাদের একটা শিক্ষিত বাবার বাড়িতে মানুষ হলো আর সে হলো ভদ্র, নম্র ও সুশিক্ষিত। পক্ষান্তরে পকেটমার বাবার বাড়িতে লালিত পালিত শিশুটি বড় হয়ে হলো মহিলা পকেটমার। কি সাংঘাতিক! ( আমার অবশ্য নম্র ভদ্রটার চাইতে ড্যাম কেয়ার মহিলা পকেটমারকেই বেশী ভালো লাগছিলো) সে যাই হোক তখন আমার ধারণা আরো পাকাপোক্ত হলো যে পরিবেশ মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা ভাবনা চিন্তায় এক বিরাট প্রভাব ফেলে।
তাহলে যে কিছু হলেই আমরা দোষ দেই চোরের ছেলে চোরই হয়েছে অথবা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হই, গিয়ানীর ছেলে গিয়ানী পন্ডিৎ। আসলে সেটা পুরোই ভুল। মহাপন্ডিতের ছেলেকেও যদি কোনো চোর ডাকুর বাড়িতে মানুষ করা হয়, আর শেখানো হয় চুরিবিদ্যা তবে সে পন্ডিৎ না হয়ে চুরি ডাকাতিই শিখবে তবে আমি নিশ্চিৎ সে হবে আরো বড় চোর অথবা ডাকাত। চুরি বিদ্যায় মেধা ও মাথা খাঁটিয়ে সে হবে আরো বড় কোনো চোর বা ডাকু কারণ বংশগতির প্রভাবে তার বুদ্ধিটাও থাকবে বেশ ধারালো। বংশগতি আর পরিবেশ এই দুই প্রভাব মনুষ্য চরিত্রে কতখানি তা রীতিমত বিতর্কের বিষয়।
তবে গুণীগিয়ানীরা বলেন ভিন্ন কথা। আমরা নাকি শুধুই শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলিই বংশগতভাবে পেয়ে থাকি, আচরণ পুরোপুরি কখনোই নয়। প্রায় সব ধরণের আচরণই মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা ও পরিবেশের কারণে পেয়ে থাকে। কোনো বিশেষ আচরণ শুধুমাত্র বংশগতির মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চালিত করা যায়না।
মানুষের আচরণ কতখানি বংশগত আর কতখানি মনুষ্য সমাজের প্রভাবের ফল সেটা পরীক্ষা করতেই বিজ্ঞানী কেলগ নিজের সন্তান ও তার চেয়ে বয়সে কিছু বড় এক শিম্পাঞ্জির বাচ্চাকে একি সাথে বড় করলেন নয় মাস। একই রকম জামাকাপড়, একই সাথে একি খাবার খেতে দেওয়া, একই রকম খেলাধুলা শেখানো হলো। দেখা গেলো এক অবাক ব্যাপার। শিম্পাঞ্জির শিশুটি কিছু কিছু আচরণ মানুষের বাচ্চাটির আগেই শিখে ফেললো। যেমন চামচে করে খাওয়া।
কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেলো ভাষা, বুদ্ধি ও কিছু মানবীয় আচরণে মানুষের সন্তানটিই অগ্রগামী। ভাষা শিক্ষা ও মানুষের কিছু জটিল আচরণ শুধুমাত্র উন্নত মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষেই সম্ভব।
তবে এ উন্নত মস্তিষ্কের কার্য্যকলাপ অনুন্নত পরিবেশের প্রভাবে অনেকখানিই বা পুরোপুরিই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
এমন কতগুলি দুর্ভাগা শিশুদের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা আজন্ম মানব সমাজের বাইরে বড় হওয়ায় অস্পষ্ট আওয়াজ বা শব্দ ছাড়া কোনো ভাষা শিখতে পারেনি। সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখেনি। ভালুক পরিবারে বড় হওয়ায় ভালুকের মতই হাটতে শিখেছে, চলতে শিখেছে। শিয়াল মায়ের দুধ খেয়ে বড় হওয়ায় এমনি এক শিশু শিখেছে শিয়ালের ভাষা। এরা মানব সন্তানের চাইতে প্রচন্ড শক্তিশালী ও ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন ছিলো। এমন আরো কিছু Feral Children সংক্রান্ত তথ্য
http://www.feralchildren.com/en/children.php
এসব দেখেই বোঝা যায় মানুষ বংশগত গুনাবলীর জন্যই মানুষ হয়না। আবার কেলগের পরীক্ষা থেকে বোঝা যায় মানুষের সমাজে পশুদেরকে লালন করলেই তারা পশু থেকে মানুষ হয়ে যেতে পারেনা। মানুষের আচরণ কিছুটা বংশগতির সাহায্যে নির্ধারিত হলেও বেশীরভাগই ভালো পরিবেশ ও শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে ওঠে।
এবার বলি এতক্ষণ আমার ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার কারণ। আমার বাসার ঠিক পাশেই রয়েছে এক বিশাল ফ্লাটবাড়ি। ক'দিন আগে তখন বেশ ভোর, বারান্দায় দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে ভোরের পাখীদের গান শোনায় মগ্ন ছিলাম। ঠিক সে সময়, পাশের বাড়িটির বিশাল ফটকে এক পুলিশের ভ্যানগাড়ি এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বাড়ির ডক্টরেট পিতা ও মাতার তরুন ছেলেটিকে মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণে পুলিশের গাড়িতে উঠে বসতে হলো ।
আজীবন কেরিয়ারিস্ট সুশিক্ষিত পিতা ও মাতার সময় হয়নি সন্তানটি বাড়ির বাইরে কোন পরিবেশে মিশছে, কি শিখছে তার খোঁজ রাখবার, জানবার সময় হয়নি তাদের ব্যাস্ততার সুযোগে, কোন অবহেলায় অবহেলিত সন্তানটি পা বাড়িয়েছে কোন দুর্গম পথে । আর তাই উন্নত মস্তিষ্ক প্রাণী হয়েও, সুশিক্ষিত পিতামাতার বাড়িতে লালিত পালিত হয়েও কোনো এক অজানা পরিবেশ ও শিক্ষার কারণে শিশুটি আজ বিপথগামী। পশুর মত কোনো পাশবিকতাই শিখেছে আজ সে।
পৃথিবীর সকল পিতামাতাকে তাই আজ খুব বলতে ইচ্ছে করে, আপনার সন্তানটির দিকে লক্ষ্য রাখুন, তাকে দিন একটি সুন্দর পরিবেশ ও সুশিক্ষাময় গৃহকোণ। ব্যাস্ততার স্রোতে গা ভাসিয়ে, নিজের প্রিয় সন্তানটিকে নিজের অজান্তেই ঠেলে দেবেন না কোন এক অন্ধকার অজানায়......
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ৮:১৩