তখন গোধূলী লগ্ন। সন্ধ্যাকাশের মায়াময় আগুনরঙা কমলা আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। বিশাল বিস্তৃর্ণ গবাক্ষপথে বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছিলো সেই আলো। আমি ঠিক যে রাজপ্রাসাদটার মাঝে দাড়িয়ে রয়েছিলাম সেই প্রাসাদের হীরের তৈরী দেওয়ালগুলো ঝলমল করছিলো আগুনরঙা আলোয়। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম!
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সামনে। অদ্ভুত সেই আলোকরশ্মী প্রাসাদের দেওয়ালগুলোয় ঠিকরে পড়ে সৃষ্টি করেছিলো এক রঙধনু মায়াজাল।
আরো সামনে এগুতেই দেখতে পেলাম প্রাসাদটির বাইরের অংশটুকুও। নাহ স্বর্গ দেখার সাধ বুঝি এ জীবনেই মিটে গেলো।
লাল নীল গোলাপী ক্রিস্টাল সৌন্দর্য্যের প্রাসাদটি দুচোখ ভরে দেখছিলাম। দেখে দেখে যেন আশ মেটেনা আমার।
বাগানে দাড়িয়ে জলকন্যা। তার অপরুপ সৌন্দর্য্যে আমাকে যেন হাত ছানি দিয়ে ডেকে যাচ্ছিলো।
সে ডাক উপেক্ষা করে ফিরে এলাম প্রাসাদটির ভেতরে। এত সৌন্দর্য্য দেখে দেখে তো আর পেট ভরবেনা, দেখি খুঁজে কি খাবার দাবার পাওয়া যায় এই হীরক রাজার দেশে।
ডাইনিং রুমে টেবিলে থরে থরে সোনা রুপা মনি মুক্তার থালায় সজানো রয়েছে রাশি রাশি খাবার। তারি একটির ঢাকনা খুলতেই চমকে গেলাম। কি এটা? থালার উপরে আরেক ছোট্ট প্রাসাদের রেপ্লিকা। এটা কি খাওয়া যায়? ভয়ে ভয়ে একটু কোনা ভেঙে মুখে দিলাম। আহ! মন জুড়ালো ও আমার প্রান ভরালো !!! এ দেখি স্বর্গীয় সুস্বাদু রুটি।
একটু মাখন হলে মন্দ হয়না। মাখন খুঁজতে গিয়ে ঢাকনা উঠালাম পাশের বাটিটার। মরি মরি কি দেখি এ ধরায়!
ননীর পুতুলের কথা শুনেছি। কিন্তু এ দেখছি আস্ত এক ননীর রাজপ্রাসাদ। তায় আবার মাখনের তৈরী! এ প্রাসাদ দিয়ে আমি উদর পূর্তী করবো? অসম্ভব! এই সৌন্দর্য্যময় শিল্প আমার পক্ষে খেয়ে ফেলা কিছুতেই সম্ভব নয়। পাশের বাটিটার ঢাকনী উঠালাম আশায় আশায়। আমার তো চোখ এইবার গুল্লু গুল্লু হয়ে গেলো!
এবার প্লেটের পরে বসে আছে আস্ত একখানা গাড়ি। তাও আবার ননীর পুতুল গাড়ি। শেষ মেষ মাখন রুটি খাবার চিন্তা বাদ দিয়ে জেলী খুঁজতে গেলাম। সে আবার আরেক কান্ড!
জেলীর বদলে দেখি সে জায়গাখানি দখল করেছেন জেলী প্রাসাদ। কি তার সৌন্দর্য্য! কি তার বাহার!
নাহ রুটি জেলী মাখন কিছুই আর খাওয়া হলোনা আমার। হাত বাড়ালাম মাংসের ডিসে। এইবার আৎকে ওঠার পালা। পৃথিবীতে এত মাংসের কালিয়া কোপ্তা, কাবাব, বিরিয়ানী থাকতে একি দেখি আমি! মাংসের জুতা?
এ কারা খায়? যেই খাক আমি খেতে যাচ্ছিনা বাবা। ছি ছি । জুতা তাও আবার মাংসের। ইয়াক থু!
সব খাবারের আশা বাদ দিলাম। কিন্তু চায়ের তেষ্টা পেলো। ঐতো সামনেই রয়েছে টিসেট টা। যেইনা চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছি। আৎকে উঠতে হলো আবার। ফেলে দিলাম কাপটা হাত থেকে । কারন নরম নরম লুতুপুতু কাপটাও মাংস দিয়েই তৈরী। কি ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার!
দৌড়ে পালালাম কিচেনে। সেখানে দেখি অপরুপ সৌন্দর্য্যের একটি কারুকাজ করা মিষ্টি কুমড়া পেয়ালা। ঢাকনীটা তুলে ভেতরে কিছু মিললো না। কি আর করা ঘুরেফিরে বাড়িটায় দেখতে লাগলাম প্রান ভরে।
হঠাৎ দেখি ঘরের এক কোনায় পড়ে আছে ওটা কি? আলাদীনের পিদিম!!
হাতে নিয়ে একটু কৌতুহল হলো। একটু ঘষে দেখবার সাধ হলো। ঘষা দিতেই হা হা হো হো বিকট আওয়াজে আমার আত্মা উড়ে গেলো।
একদৌড়ে বেরিয়ে এলাম বাগানে। দেখি দাড়িয়ে আছে সিনডেরেলার সেই কুমড়ো গাড়ি।
গাড়িটার সামনে আবার রাখা আছে সেই বিখ্যাত গ্লাস সু জোড়া। কোনো কিছু না ভেবেই ঐ জুতা পায়ে গলিয়ে উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি সো সো করে ছুটলো। ছুটতে ছুটতে আকাশ বাতাস উড়িয়ে আমাকে এনে ফেললো আমার এই দরিদ্র কুটীরের এক প্রান্তে।
বাব্বাহ। বড় বাঁচা বাঁচলাম। মনে পড়লো রবিঠাকুরের সেই বিখ্যাত ছেলেবেলার তালগাছ কবিতা টির শেষ অংশটুকু।
তার পর হাওয়া যেই থেমে যায়
পাতা কাঁপা থেমে যায়....
মনে হয় মা যে হয় মাটি তার
ভালো লাগে আরবার
পৃথিবীর কোনটি!
অবশেষে বুঝলাম, আমার এই পৃথিবীর কোনটিই ভালো। কোনো দরকার নেই এমন দেশটি ছেড়ে ঐ হীরক রাজার দেশে যাবার। ঐসব খাবার খাবার। যেমন আছি দুবেলা দুমুঠো খেয়ে সেই ভালো।
এখন সত্য ঘটনাটা সবাইকে বলি। পত্রিকায় দেখা এক বৈদেশী মাখন বাবুর মাখন বাড়ির কথা পড়ে। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখি কি অদ্ভুত সব শিল্পকর্ম! আমি মুগ্ধ হলাম। একে একে বরফ শিল্প, খাদ্য শিল্প, সব্জী শিল্প দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।
বাব্বাহ! ঐ দৈত্যের কথা মনে পড়লেই এখনও আমার বুক ঢিপ ঢিপ করে । ভাগ্যিস স্বপ্নের মাঝেও ঐ সিনডেরেলার কুমড়ো গাড়ি আমার জীবন রক্ষা করেছিলো। আর ঐ যাদুর জুতা না থাকলে তো বাড়ি ফিরিয়েই আনতে পারতোনা আমাকে কেউ আর। ঐ রাক্ষসপূরীতেই ধুঁকে ধুঁকে মরতে হত!
এবার কানে কানে একটা কথা বলি আপনাদেরকে। স্বপ্ন বলুন আর যাই বলুন জুতাটা কিন্তু আমার কাছেই আছে এখনও । বিশ্বাস না হয় দেখুন। এই যে ছবি দিলাম।
এই সেই যাদুর জুতা। যা সিনডেরেলাকে একদিন বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলো আর আজ বাঁচালো আমাকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:২৬