আগের পর্ব (২৯)
আমার খাওয়া দাওয়ার রুচিবোধ শুন্যে এসে ঠেকল, মুখ দিয়ে কিছুই নামেনা, বমি আসতে চায় কিছু খেলে, প্রতিদিন সকালের নাস্তাটা একটু মুখে দিয়েই বাকিটা রেখে চলে যাচ্ছি, আমার চাল চলন এমন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিল যে চোখে পড়ার মতো, বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, "তোর কি কিছু হয়েছে? কোন সমস্যা? অফিসে বা অন্য কোথাও!" বললাম না, আমি ঠিক আছি, বাবা আবার প্রশ্ন করলেন, "একটা প্রস্তাব নিয়ে যাবার কথা ছিল, ওটার ব্যাপারেতো আর কিছুই বললিনা, বললাম " বাবা রুমির বিয়ে হয়ে গেছে, ওর পেরেন্ট্স আমার ব্যাপারে না করে দিয়েছিল, তাই আপনাকে আর জানানো হয়নি।"
এই প্রথম বাবাকে খুব কাছের মানুষ মনে হল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, মন খারাপ করিসনা, সবই আল্লাহর ইচ্ছে, আল্লাহ যেভাবে ঠিক করে রেখেছে সেভাবেই হবে, তুই মন খারাপ করিসনা, হয়তো এতেই তোর মংগল আছে তাই এমনটা হয়েছে," আমি কোন জবাব দিলামনা, ভাবীও এগিয়ে আসলেন আমার এই বিপদে, ভাবী যখন দেখলেন আমার খাওয়া দাওয়া অনিয়ম হচ্ছে চেষ্টা করছিলেন আমাকে বুঝাতে, সকালে এখন আর টেবিলে নাস্তা রেখে চলে যাননা, পাশে বসে থাকেন, রুটি একটা খাবার পর আরো একটা এগিয়ে দিচ্ছেন, "এভাবে না খেয়ে থাকলে কি হবে? একটু চেষ্টা কর আরো একটা খেতে হবে, এই নাও বলে আমাকে জোর করেই খাইয়ে ছাড়ছেন।"
আমিও চেষ্টা করছিলাম স্বাভাবিক হতে, কিন্তু শনিবার আসলেই আমার তালগোল পেকে যায়, সেদিন যেহেতু অফিস ছুটি আমি নিজের অজান্তেই চলে যাচ্ছি রুমির কলেজে, রুমির সাথে দেখা করার জন্য না, এমনিতে ওখানে যাচ্ছি, কলেজ গেইট এর পাশে বাস ষ্টেন্ডে নেমে আবার অন্য একটা বাস ধরে চলে আসছি, কেন এমনটা করছি আমি নিজেই জানিনা, আবার ঘরে বসে থাকলেও অস্থিরতায় ভূগছি, খুব কষ্ট করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিতো এই শনিবার যাবনা, কিন্তু পরের শনিবার আর ধরে রাখা যাচ্ছেনা, ঠিকই চলে যাচ্ছি।
সেদিন ছিল শুক্রবার, সকালে বের হলাম উদ্দেশ্যবিহীন, জুমার নামাজ পড়লাম শহরের এক মসজিদে, তারপর চলে গেলাম বড় আপার বাসায়, আমার খবর ঘরের সবাই জেনে গেছে, তাই কেউ আমাকে কোন প্রশ্ন করে বিরক্ত করেনা, আমি যা করছি সবাই উৎসুক হয়ে দেখছে, কিন্তু আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে, আমি বড় আপার বাসায় গিয়ে বললাম আপা কিছু খাব, ক্ষিধে লেগেছে, যা আছে দিন, আপা বলল একটু বস, চুলোর তরকারী হবার পথে, আমি বললাম পুরোনো তরকারী থাকলে তাতেই চলবে, খেয়ে ঘুমাব, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তাই হল, খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
বিকেলের দিকে নাহিম ভাই ফোন দিল, রিং পড়ার শব্দ শুনে ঘুম ভাংল, নাহিম ভাই বললেন, আজ সমুদ্র দেখতে যাচ্ছি, যাবেন? পতেংগা সমূদ্র সৈকত, গেলে ওখানেই চলে আসেন, আমরা অফিস কলিগরা সবাই যাচ্ছি। আসলে নাহিম ভাই আমাকে স্বাভাবিক করার জন্য চাচ্ছিলেন, আমি যাতে সবার সাথে মিশে একটু হাসি ঠাট্টা করে সময় কাটাই, তাতে তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হওয়া যাবে, তাই নাহিম ভাই এমনটা করছিলেন, কোথাও গেলে আমি যাব কিনা জিজ্ঞেসা করেন, ওনি একটু বেশীই পছন্দ করতেন আমাকে, নাহিম ভাইকে বললাম আপনারা যান, আমিও আসছি ওখানেই দেখা হবে।
সৈকতে গিয়ে পুরোনো কলিগ সবার সাথে দেখা হল, আমি এমনিতেই কম কথা বলি, আর এখনতো একেবারেই কমিয়ে দিয়েছি, কারো সাথে কথা বলতেও যেন আমার কষ্ট হয়, নাহিম ভাইরা হাটু পানিতে নেমে হাটুস্নান করছিল, আমি তীরে বসেছিলাম একা আর ভাবছিলাম, আচ্ছা রুমির বর দেখতে কেমন? নিশ্চয় খুব সুন্দর হবে, আর ধনী হবেতো অবশ্যই, খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, একবার দেখতে পারলে খুব ভাল হতো।
জানিনা আল্লাহ আমার কথাটা গুরুত্ব দিয়েছে কিনা, দেখতে পাচ্ছি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হাত ধরে দুজনে একটু ঘেষেই এদিকে আসছিল, সম্ভবত নব দম্পতি হবে, অনেকটা কাছে আসতেই আমার চোখ ছানাবড়া! আমিও ওঠে গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালাম, তিনজন মুখোমুখি চেয়ে আছি ত্রিভূজ হয়ে। প্রশ্ন করলাম রুমি কেমন আছো? রুমি হা করে তাকিয়ে ছিল যেন, উত্তর দিলনা, তারপর ওর বরকে পরিচয় করিয়ে দিল, ও হচ্ছে শাকিল, হ্যান্ডশেক করলাম, রুমির বর জানতে চাইল কোন শাকিল? রুমি জবাব দিল, ওইযে তোমার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল, " ও ও মনে পড়েছে, আপনার সাথে পরিচয় হতে পেরে খুশি হলাম, আমরা তিনজনই তখন কিংকর্তব্য বিমূঢ়,আজ আসি অন্যদিন আবার দেখা হবে বলে রুমির বর আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইল, আমিও সরে দাঁড়ালাম, নাহিম ভাই দূর থেকে খেয়াল করছিল আমাকে, কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কার সাথে কথা বললাম এতক্ষণ? বললাম রুমি আর তার বর।
সদ্য পুরোনো ক্ষতটা আবার জেগে উঠলো, আমার চোখ দিযে আবার পানি গড়াতে লাগল, নাহিম ভাই আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, এখানে ভাল লাগছেনা, চলেন অন্য কোথাও যাই, নাহিম ভাই বুজতে পেরেছিলেন এখানে থাকলে আমাকে সামলানো যাবেনা, ছোট বাচ্চাদের মতো হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকবো, আমরা চলে এলাম কর্ণফুলি নদীর মোহনায়, এদিকটার দৃশ্য খুবই সুন্দর, নদী আর সাগরের মিলন সংগম।
নাহিম ভাইকে বললাম
-আমি রুমির বিয়েটা মেনে নিতে পারছিনা, রুমি ভুল করেছে
-রুমি যাকে ইচ্ছে বিয়ে করেছে তাতে আপনার মানা না মানার প্রশ্নে তাদের কিছু যায় আসেনা, বললেন নাহিম ভাই।
-মামুন ভাই প্রশ্ন করলেন আপনার এমন মনে হল কেন?
-আমার ধারণা ছিল রুমির বর হবে রাজপুত্রের মতো, এখন যাকে দেখলাম রুমির পাশে খুবই বেমানান, ওর বরের চোখে সমস্যা আছে, যাকে বলে আড়চোখা, যেটা স্বাভাবিক ভাবেই সবার চোখে পড়বে, এমন কাউকে রুমি বিয়ে করবে আমি মেনে নিতের পারছিনা।
নাহিম ভাই একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, দেখুন আপনি এখন স্বাভাবিক নন, তাই কি দেখতে কি দেখেছেন ঠিক নেই, ওরা কেউ বিশ্বাস করলনা আমাকে, নাহিম ভাই এর একই কথা, রুমি যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুক, হোক সে কালো, অন্ধ, লেংড়া, খোঁড়া, এটা তার অভীরুচি, আপনার আমার কিছু্ই করার যেমন নেই তেমনি মন্তব্য করাটাও অনুচিত।
চলবে...
পরের পর্ব (৩১)
১. ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১:৪২ ০
শুভ নব বর্ষ।