আফজাল হোসেনের গাড়ীর খুব শখ।
কম দামী হোক ক্ষতি নেই। চকচকে না হোক তাতেও ক্ষতি নেই। ধবধবে সাদা একটা গাড়ী তার চাই। সেই গাড়ীতে তিনি অফিসে যাবেন। অফিসের দাড়োয়ান যখন বড় স্যারদের গাড়ীর মতো করে তার গাড়ীর জন্যও অফিসের গেট খুলে দিবে, তখন তিনি কি করবেন, তাও ভেবে রেখেছেন আফজাল হোসেন। খুব মায়া ভরা একটা হাসি দিবেন। গাড়িটা খানিক থামিয়ে দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘কি হে মোবারক মিয়া, খবর কি তোমর? দিনকাল যাচ্ছে কেমন?’
মোবারক মিয়ার উত্তর যদি সন্তোষজনক হয় তাহলে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার চকচকে একখানা নোট বের করে হাতে গুজে দিবেন।
সমস্যা হচ্ছে, এই পঞ্চাশ টাকার চকচকে নোট প্রতিদিন দেয়া যাবে না। এতো টাকা দেওয়ার সাধ্য আফজাল হোসেনের নেই। গাড়ী কেনার সাধ্যও তার নেই। যদিও তার মতো ছোট পোস্টে চাকরী করে এমন অনেকেই গাড়ী-বাড়ী করে ফেলেছে। কেবল আফজাল হোসেনই পারেন নি। তারা পারলে আফজাল হোসেন কেন পারেন নি? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আফজাল হোসেন দিতে চান না। কে কিভাবে অর্থ উপার্জন করবে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। এই নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতে রাজি না।
তার জমানো টাকা অবশ্য কিছু ছিলো। বারো-তেরো লাখ টাকা। এই টাকা তিনি জমিয়েছিলেন তিল তিল করে। একটা গাড়ীর জন্য। বছর দশেক আগে একবার গাড়ী প্রায় কিনেও ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হয় নি। হয় নি কারণ বড় ছেলে জহিরের হঠাৎ মোটর সাইকেলের শখ হলো। সেই শখ এমনই যে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ। ছেলের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রেখে বাবাতো আর শখ পূরণ করতে পারে না। আফজাল হোসেন জমানো টাকা থেকে ছেলেকে মোটর সাইকেল কিনে দিলেন। তার গাড়ী কেনা আর হলো না। তাতে অবশ্য লোকসান কিছু হয় নি। লাভই হয়েছে। গাড়ী কেনার প্রস্তুতি হিসেবে তিনি ড্রাইভিংটা শিখে ফেলেছিলেন।
ড্রাইভিং শিখতে তার তেমন কষ্ট হয় নি। সাইকেল চালানো কঠিন কাজ, ড্রাইভিং না। সেই সাইকেল তিনি গত আঠারো বছর ধরে চালাচ্ছেন। সুতরাং চার চাকার গাড়ীতো তার কাছে দুধভাত।
গাড়ী অবশ্য তার হবেই। ছোট ছেলে বশিরকে কানাডা পাঠিয়েছেন। সুতরাং গাড়ী হতে আর দেরী কি? এই হলো বলে। আফজাল হোসেন অবশ্য ছোট ছেলের আশায় থাকতে চান নি। নিজের জমানো টাকায়ই কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো বশির কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলায়। মেয়ের বাবা বেকার ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দিবেন না। এই নিয়ে হৈ চৈ, কান্না কাটি, বিষ খাওয়া অবধি হলো। বশির শেষ পর্যন্ত বায়না ধরলো তাকে বিদেশ পাঠাতে হবে। তার এক বন্ধু কানাডায় থাকে, সে বলেছে, লাখ পনেরো টাকা হলে কানাডায় বশিরের একটা ব্যবস্থা সে করে ফেলতে পারবে।
স্ত্রী রাহেলা খাতুন এসে আফজাল হোসেনকে ধরলেন। ছেলের একটা ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে। বশিরও এসে বাবার পা জড়িয়ে ধরলো, ‘বাবা, তুমি আমারে কানাডা পাঠাও বাবা, আমি এক বছরের মধ্যে তোমার গাড়ী কেনার টাকা পাঠাই দিবো। আর নাইলে আমি বিষ খেয়ে মরবো বাবা। বিষ খেয়ে...।’
আফজাল হোসেনের আবারো গাড়ী কেনা হলো না। তিনি বশিরকে কানাডা পাঠালেন। তার মনে মনে অবশ্য একটা আশা আছে, বশিরের পাঠানো টাকায় হয়তো আরেকটু ভালো একটা গাড়ী কেনা যাবে। তিনি কাউকে বলেন না, কিন্তু অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই গাড়ীর শোরুমে যান। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেন। তার কেমন ভয় ভয় লাগে। দূরে দাঁড়িয়েই মনে মনে দাম আন্দাজ করেন। সাহস করে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। বশির কানাডা যাওয়ার পর থেকে তিনি আর সাইকেল চালিয়ে অফিসে যান না।
সাইকেলটার অবস্থাও অবশ্য ভালো না। বহু বছরের পুরনো সাইকেল। প্রথমটা চুরি হওয়ার পর সেকেন্ড হ্যান্ড কিনেছিলেন। এক যুগতো হবেই। লক্কর ঝক্কর হয়ে গেলেও এই সাইকেলটার কোথায় যেন প্রাণের ছোঁয়া পান আফজাল হোসেন। কিন্তু যার ছেলে কানাডা থাকে তার কি আর ভাঙা সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাওয়া মানায়?
আফজাল হোসেন তাই সাইকেল তুলে রেখেছেন ঘরে। গত তিন বছর আর ছুঁয়ে দেখন নি। বাসে করে অফিসে যান। আর বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন রাস্তাভর্তি সাদা ধবধবে সব গাড়ী। তার চোখ চকচক করে ওঠে। একটা গাড়ী তার হলো বলে!
কিন্তু বশিরের কানাডায় কি সব ঝামেলা হচ্ছে। প্রথম বছরে সে টাকা পাঠাতে পারে না। ঝামেলা সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে সে। টাকা পাঠাবে কি? তার পরের বছরও না। কানাডার কাগজপত্র নিয়ে কিসব গোলমাল হয়েছে, সেখানে টাকা লাগবে। বশির অবশ্য বলেছে, এবার সে টাকা পাঠাবেই। কিন্তু সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ রাহেলা খাতুনের ডাকে ঘুম ভাঙে আফজাল হোসেনের।
‘শুনছো?’
‘হ্যা বলো।’
‘বড় বউর কাছে একটা কথা শুনলাম।’
‘কি কথা?’ আফজাল হোসেনের ঘুম তখনো পুরোপুরি কাটে নি। তিনি ঘুম জড়ানো কণ্ঠেই রাহেলা খাতুনের কথার জবাব দিচ্ছেন।
‘বশির নাকি অর বউরে কানাডা নিয়া যাইতেছে।’
‘তো সে থাকে কানাডা, বউ কই থাকবো? বউ কি সোমালিয়া থাকবো? বউ নিয়া যাওয়াই ভালো।’
‘তুমি বুঝতেছো না। বশির এতোদিন যে টাকা পয়সার সমস্যার কথা বলছে, ওর আসলে কোন সমস্যাই ছিলো না। ও বউরে নিয়া যাওয়ার জন্য এই সব বলছে। এখন সব ফাইনাল হইছে।’
‘রাত দুপুরে আমার এতো বোঝাবুঝির দরকার নাই। ঘুমাতে দাও।’
সকালে খাবার টেবিলেও রাহেলা খাতুন কথাটা তোলেন। আফজাল হোসেন অবশ্য তাতে আশাহত হন না। পাত্তাও দেন না খুব একটা। তিনি বরং মাঝরাতে জায়নামাজ পেতে নামাজে বসেন। ছেলের জন্য দোয়া করেন। সেই দোয়ার কোথাও খুব আবডালে, আড়ালে, লুকিয়ে চুকিয়ে তার গাড়ীও থাকে। আফজাল হোসেন প্রতিদিন সকালে বাসে চেপে অফিসে যান, আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাইরে, ‘ইশ, ওই যে ওই গাড়ীটা, ওই সাদা গাড়ীটার মতন। না না, ওটা না, ওইটা, ওই, ওইটা।’
২.
আফজাল হোসেন অফিসে যাবেন।
বাসের টিকেট কেটে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার সিরিয়াল সাত নাম্বার। এই বাসের নিয়ম-কানুন আলাদা। প্রত্যেক স্টপেজ থেকে এরা দশজনের বেশি যাত্রী নেয় না। তিনি নিশ্চিত মনে লাইনে দাঁড়িয়ে হাকিমপুরি জর্দা দিয়ে পান খাচ্ছেন। সিটিং বাস। তার কাছে টিকেটও আছে। সিরিয়ালও সাত। সুতরাং তাড়াহুড়ার কিছু নাই। আঙুলের মাথা থেকে চুন নিয়ে তিনি আরাম করে পান চিবুচ্ছেন। লাইন থেকে খানিকটা সরে গিয়ে পিচিক করে পানের পিক ফেললেন। ফিরে এসে দেখেন আঠারো-ঊনিশ বছরের এক ছেলে তার জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে।
আফজাল হোসেন এক দৃষ্টিতে ছেলেটার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। ছেলেটা ফিরেও তাকালো না। উদাস নয়নে কোন এক মোবাইল ফোন কোম্পানির বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন দেখছে। আফজাল হোসেন কিছু বললেন না। এই অভিজ্ঞতা তার আছে। আজকালকার ছেলেপুলেদের ভেতর কেমন একটা বেপরোয়া ভাব চলে এসেছে। এই ভাবকে তিনি ভয় পান। এরা কখন কি করে ফেলে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে ছেলেটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার সিরিয়াল হয়ে গেলো সাত থেকে আট। অবশ্য দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এই স্টপেজ থেকে কম করে হলেও দশজন যাত্রী বাসে উঠবে। সুতরাং বাসে সিট পেতে তার অসুবিধা হবার কথা না। আফজাল হোসেন আবার আরাম করে পান চিবুতে শুরু করলেন। সাথে হাকিমপুরি জর্দা আর কাঁচা সুপুরি।
বাস এসেছে। আফজাল হোসেন পায়ে পায়ে বাসের দরজার দিকে এগোচ্ছেন। তার সামনের ছেলেটা পর্যন্ত বাসে উঠে গেছে। তিনি ডান পা-টা মাত্র উঁচু করেছেন এই মুহুর্তে হেলপার হাত বাড়িয়ে বাসের দরজা আটকে দিলো।
‘পরেরটায় আসেন চাচা মিয়া, এইটায় আর সিট নাই।’
‘সিট নাই মানে? সিটতো আছে।’
‘আছে, তয় আগের স্টান থেইকা জোর কইরা তিন জন বেশি উইঠা গেছে, হের লাইগা এইহান থেইকা তিন জন কম নিতে হইবো।’
আফজাল হোসেন কিছু বলতে যাবেন। ভিতরে ভিতরে কথা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন কিন্তু বাস ছেড়ে দিলো। তিনি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার অসম্ভব মন খারাপ হয়েছে। কারণে-অকারণে তার মন খারাপ হয় না। কিন্তু আজ হলো। গত কিছুদিন ধরেই এই ব্যাপারটা তিনি লক্ষ্য করছেন। তার ক্ষেত্রেই সব উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটে।
সেদিন অফিসেও ঘটলো। পাঁচটা বেজে গেছে। অফিস থেকে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি বেরোতে যাবেন, এইসময় বড় সাহবের ঘর থেকে পিয়ন আজিজ মিয়া মোটা এক ফাইল নিয়ে হাজির, ‘বড় স্যারে আপনেরে কইছে এই ফাইলডা শেষ কইরা যাইতে।’ আফাজাল হোসেন একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন, পাঁচটা বেজে ছত্রিশ। কিছু বললেন না। চুপচাপ হাতের কাজটা শেষ করে বড় সাহেবের পাঠানো ফাইল নিয়ে বসলেন। শেষ পর্যন্ত অফিস থেকে বেরোলেন রাত আটটায়। পরদিন হরতাল। রাস্তায় গাড়ী-ঘোড়া বলতে কিছু নাই। ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকে শেষে হাঁটা দিলেন। মতিঝিল থেকে হেঁটে মোহাম্মদপুর। এই বয়সে এতো হাঁটা শরীর সহ্য করে না। সারা শরীর ব্যাথা। পা ফুলে ভয়ানক অবস্থা। চারদিন অফিসে যেতে পারলেন না।
আফজাল হোসেন লম্বা লাইনের মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। সবার সামনে। এটা অবশ্য একটা ভালো দিক। গ্লাস অর্ধেক খালি না দেখে, অর্ধেক ভরা দেখা ভালো। এবারের বাসে ওঠা নিয়ে আর কোন সংশয় নেই। তিনিই প্রথম। কিন্তু তার যা ভাগ্য, বাস কখন আসে কে জানে! দেখা যাবে আজ আর বাসই আসলো না। এই কোম্পানির বাকী সকল বাস আজই হয়তো কোথাও ভাড়ায় চলে গেছে। কোন মন্ত্রী-মিনিস্টারের শালার বিয়েতে গ্রাম থেকে বাসভর্তি লোকজন আসবে। সেই বাস ছাড়া পাবে ভোর রাতে। আগামীকালও হয়তো ট্রিপ দিতে পারবে না।
কিন্তু আফজাল হোসেনের আশংকা সত্যি না। বাস চলে এসেছে। এবং বাসের বা দিকে জানালার পাশে তিনি একটা সিটও পেয়ে গেছেন। সিটটাও ভালো। সামনের দিকে ভালো জায়গা আছে। হাত পা শক্ত করে রোবোকপ হয়ে বসে থাকতে হয় না। হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসা যায়। আজকাল ঢাকা শহরের বাসে বসার চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। সিটের যা অবস্থা। বসার পরে সামনে পা রাখার আর জায়গা থাকে না। কোন মতে রাখা গেলেও নট নড়ন-চড়ন হয়ে বসে থাকতে হয়। সেই বসা শরীরের আকার আকৃতি পর্যন্ত বদলে দেয়। বাস থেকে নামার সময় নিজেকে মতিঝিল বক ভাষ্কর্যের বক পক্ষিদের মতো মনে হয়।
আফজাল হোসেন আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে বসলেন। জানালা দিয়ে ভোরের ফুরফুরে হাওয়া আসছে। শেষপর্যন্ত সকালটা উপভোগ্যই হলো তাহলে! খানিক আগের তিক্ত অভিজ্ঞতাটা প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলেন। এই সময় খ্যাক খ্যাক শব্দে বাসটা থেমে গেলো। আফজাল হোসেন প্রথমে ভেবেছিলেন এটা কোনো স্টপেজ। কিন্তু তার ভুল ভাঙতে দেরী হলো না। যাত্রী-হেল্পার মিলে শুরু হলো বাস ঠেলাঠেলি। তুমুল শব্দ করে বাস চলতে শুরু করে, আবার সাথে সাথে থেমে যায়। আফজাল হোসেন চরম বিরক্তি নিয়ে এই ঠেলাঠেলি কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর বাস থেকে নেমে গেলেন।
চৈত্রের সকাল। ঠা ঠা করে তেঁতে উঠছে রোদ। আফজাল হোসেন খানিকটা হেঁটে সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। এখান থেকে মতিঝিলের বাস পাওয়া সহজ। সমস্যা হচ্ছে এখন অফিসের সময়। মতিঝিলের কোন বাসেই পা রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই। তিনি বৃদ্ধ মানুষ। তারপক্ষে দৌড়-ঝাপ করে বাসে ওঠা অসম্ভব। তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর খাবার বাটিটা কাঁধে ঝুলিয়ে মোহাম্মদপুরের দিকে হাঁটা দিলেন। আজই বশিরকে বলতে হবে টাকা পাঠাতে। গাড়ি না হলে আর অফিসেই যাবেন না আফজাল হোসেন।
আজই গিয়ে বশিরকে ফোন করবেন তিনি।
৩.
রাত তিনটা।
আফজাল হোসেন রাহেলা খাতুনের পাশ থেকে চুপিচুপি উঠে এলেন। তারপর মোবাইল ফোনের টর্চলাইট জ্বালালেন। আজকাল কম দামী এই মোবাইল সেটগুলাতে অনেক সুযোগ-সুবিধা। কি সুন্দর আলো। তিনি আলো জ্বালিয়ে রান্নাঘরের পাশের ছোট্ট স্টোররুমটা খুললেন।
অন্ধকার স্টোররুমটা বহুদিন খোলা হয় না। কেমন ভ্যাপসা একটা গন্ধ। ধুলো-বালিতে একাকার। মাকড়সার জাল ঝুলে আছে এখানে সেখানে। দুটো ধেড়ে ইঁদুর সুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেলো। একটা হাতলভাঙা চেয়ার। পুরনো লেপ, কাঁথা, তোশকের স্তুপ। বই, ম্যাগাজিন, ছেড়া স্যান্ডেল, একটা ক্রিকেট ব্যাট। তিনটা স্ট্যাম্প। ওষুধের বড় কার্টন।
ওষুধের কার্টনটার ঠিক পেছনেই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাইকেলটা। একটু কাঁত হয়ে আছে। জং ধরা ধাতব শরীর। সাইকেল না, একটা যন্ত্রের কঙ্কাল যেন।
আফজাল হোসেন সাইকেলটাকে তুলে নিয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে গিয়ে বসলেন। ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন সাইকেলটা। ক’ফোটা নারকেল তেলও চিপে দিলেন চেইনের ভিতর। তারপর প্যাডেল ধরে ঘোরালেন। কেমন একটা উৎকট শব্দ হলো, কিন্তু ঘুরলো। খানিকটা ঘুরে থেমে গেল। আফজাল হোসেনের মুখে অদ্ভুত একটুকরো হাসি।
সেই হাসির অর্থ কি?
কারো পায়ের শব্দে ফিরে তাকালেন আফজাল হোসেন। রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রাহেলা খাতুন। সাইকেলের জংধরা চেইনে তেল ঘষতে ঘষতে আফজাল হোসেন বিড়বিড় করে বললেন, ‘রাস্তায় যা জ্যাম। তারওপর বাসে চড়তে চড়তে শরীরটায় কেমন জং ধরে গেছে। তাই ভাবতেছি, এখন থেকে আবার সাইকেলেই অফিসে যাবো। এই বয়সে শরীর ছাইড়া দেওন ঠিক না। কি বলো জহিরের মা?’
রাহেলা খাতুন জবাব দেন না। ধীর পায়ে আফজাল হোসেনের পাশে এসে বসেন। হাত দিয়ে সাইকেলের জংধরা শরীটা ছুঁয়ে দেখেন। আফজাল হোসেনও আর কিছু বলেন না। মোবাইল ফোনের টর্চটা শুধু নিভে যায়। অন্ধকার ঘর। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকার ঘরেও কেউ কারো দিকে তাকাতে সাহস পান না।
দুটি কম্পিত হাত কেবল শক্ত করে ধরে থাকে একটা জং ধরা ধাতব শরীর।