সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো- সিআইএ, এফবিআই, এনএসএ, আইআরএস* এরা সমন্বিতভাবে আমেরিকার মোট বাজেটের ১০ ভাগ ভোগ করে, যার প্রায় পুরোটাই এরা আবার বিভিন্ন ভূয়া বাজেট খাতে খরচ দেখায় যে কারনে স্বয়ং আমেরিকার আইন প্রনেতারাই সত্যিকারের খরচ কিভাবে হচ্ছে বুঝতে পারেন না।
৫০ এর দশকের প্রথম দিকে ইরান আর গুয়েতেমালার গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কিন্তু তথাকথিত ’বামপন্থি’ সরকাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে এই এজেন্সীগুলোর দর্শনীয় সাফল্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাদের কর্মকাণ্ডের ধরনটা কেমন হবে সেটা ঠিক করে দেয়। ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আর গুয়েতেমালার জ্যকব আরবেনজ দুজনেই ছিলেন ক্যস্ট্রো, পেট্রিস লুমুম্বা বা আলেন্দের মতোই ক্যরিসমাটিক নেতা। যারা কিনা বাম ঘেষাঁ বিপ্লবের অন্বেষায় ছিলেন। তাদের সবাইকেই ’কম্যুনিস্ট’ তকমা দেয়া হয় আর আমেরিকার বিভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অনুযায়ি সিআইএ তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করে। এই সবগুলো দেশে এবং অন্যান্য দেশেও (কিউবা ছাড়া) এইসব মহান ক্যরিসমাটিক নেতাদের- যাদেরকে তারা ভয় করতো- সবাইকেই তারা ক্ষমতাচ্যুত করায় ’সফল’, যদিও তার মাধ্যমে আমেরিকার আদর্শ বা কোন কৌশলগত স্বার্থ আদৌ রক্ষা হ’ল সেটা ভিন্ন ব্যপার।
সিআইএ ইকুয়েডরে দুটি সরকারকে উৎখাতে সাহায্য করে, যার জন্যে মাত্র ১০ জন আমেরিকান সিআইএ অপারেটরকে সেদেশে ফুলটাইম কাজ করতে হয়েছিল। ব্রাজিল, ইরান বা ভিয়েতনামের মতো আরো জটিল সমাজগুলোতে অবশ্য আরো অনেক বেশী লোক নিয়োগ করতে হয়।
খুন
সিআইএএর ভেতরে খুন এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসাবে বিবেচিত যে, গুপ্তহত্যার কার্যক্রমকে ১৯৬১ সালে প্রাতিষ্ঠানিকরন করা হয়। ইউফেমিসমের প্রতি (অপ্রিয়/নোংরা কিছুকে সুন্দর অন্য নাম দেয়া, যেমন বাথরুমে না বলে ওয়াশরুম বলা) সিআইএ-এর বিশেষ ঝোঁক আছে। তো তারা এই প্রোগামকে বলে ”এক্্িরকিউটিভ একশন”। নিজেদের হাতে যাতে সত্যিকারের রক্ত না লাগে সেজন্যে তারা এইসব ’গা ঘিনঘিনে’ কাজ করার জন্যে ভাড়া করে মাফিয়া ধরনের লোক এবং এক ধরনের এজেন্ট যাদের কোড নাম ” WI/ROGUE ‘”- সিআইএর কাগজপত্র অনুযায়ী যার মানে হোল- ”জালিয়াত আর একসময়ের ব্যংক ডাকাত”..।
কঙ্গোর (এখনকার নাম জায়ার) প্যট্রিস লুমুম্বাকে হত্যার জন্যে নিয়োগ করা হয়েছিল এমনই WI/ROGUE । আমেরিকার সিনেট সিলেক্ট কমিটি তাদের অনুসন্ধানে জানতে পেরেছিল- সিআইএ কঙ্গোর জনপ্রিয় বামঘেঁষা নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তীব্র প্রাণঘাতি বিষ পাঠিয়েছিল এবং আরো বিভিন্ন ”পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক” পদক্ষেপ নিয়েছিল।
১৯৬১ তে ডোমেনিকাতে রাফায়েল ট্রুজিল্লোকে যে ডোমেনিকান ভিন্ন মতালম্বী গুলি করে সে সিআইএর ঘনিষ্ট সংস্পর্শে ছিল বলে পরবর্তীতে সিনেট সিলেক্ট কমিটিতে জানানো হয়।
সংবাদমাধ্যম আর প্রকাশনা
মিডিয়াতে সিআইএর কর্মকাণ্ড সবচেয়ে বেশীখাতে ব্যবসা করা চেইন গ্র“পের মতোই বহুমুখি আর ব্যপক... (যাদের কিনা, মনে করা যাক, হোটেল আছে, বিমান আছে, ট্যাক্সি সার্ভিস আছে, ট্রাভেল এজেন্ট কোম্পানী আছে, ইন্সুরেন্স আছে; তারমানে একটা সেক্টরের সবগুলো পরিপূরক ব্যবসাতেই নিজেদেরই কোম্পানি আছে এমন কোন গ্রুপের মতোন) ।
বই প্রকাশনা ছাড়াও প্রোপাগাণ্ডা চালানোর জন্যে (বিশ্বব্যাপি !) সিআইএর রয়েছে নিজের মালিকানাধীন বা ভর্তূকি দেয় এমন অসংখ্য সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সংবাদ সংস্থা, রেডিও আর টেলিভিশন চ্যানেল।
বিশ্ববিদ্যালয়
সিআইএ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়োগ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করে। একটা টার্গেট হল বিদেশী ছাত্ররা, যাদেরকে সিআইএ নিজ দেশের ভেতরে স্পাই হিসাবে পরিনত করতে পারবে। আরেকটা হল আমেরিকান ছাত্র যাদেরকে সিআইএর গোপন অপারেটর হিসাবে নিয়োগ করা যায়। ৩য় গ্র“পটি হল দেশী ও বিদেশ থেকে আসা প্রফেসাররা, যাদেরকে স্থায়ী এজেন্ট হিসাবে অথবা শুধুমাত্র একটা এসাইনমেন্টের জন্য নিযুক্ত করা যায়। এই কারনে সিআইএ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত লোকের সাথে গোপন চুক্তিভীত্তিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এইসব সিআইএ প্রফেসরদের মূল কাজ হল সম্ভাব্য নতুন এজেন্টদের খুজে বের করা ও তাদের মূল্যায়ন করা। কিছু প্রফেসররা সিআইএর প্রোপাগাণ্ডা লেখার কাজে এবং বিশেষায়িত গোপন মিশন চালানোর জন্যে ব্যবহৃত হন। একজন সত্যিকারের বা জাল প্রফেসর বা ছাত্রের জন্যে সারা পৃথিবী ভ্রমন করার আর সিআইএর আগ্রহের কোন বিষয়ে যাবতীয় রকম প্রশ্ন করে বেড়ানোর জন্যে দারুন অজুহাত হিসাবে কাজ করে তার পেশা। অনেক সময় একজন প্রফেসর হয়তো মনে করছেন যে তিনি কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যে বা কোন গবেষনার প্রয়োজনে তথ্য যোগাড় করছেন, আসলে যে প্রতিষ্টানটি সিআইএরই একটা মুখোশ!
এর বাইরেও সিআইএ ক্যম্পাসেও প্রচুর গবেষনা স্পন্সর করে, যেগুলোর বেশীরভাগেই সিআইএর সম্পৃক্ততা থাকে গোপন।... এমআইটিতে ১৯৫১ থেকে ১৯৬৫ পর্যšত সিআইএ সেন্টার ফর ইন্টারন্যশনাল স্টাডিজ এর অর্থায়ন করে, এবং ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ তে ন্যশনাল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের বাজেটের বেশিরভাগটাই তারা দেয়। সিআইএর অফিসাররা সেই সুযোগে আমেরিকার প্রতিনিধি হিসাবে বিভিন্ন আšর্তঃজাতিক সন্মেলনে যোগ দেন এবং অপারেশনাল কাজও সমাধা করেন। ষাটের দশকে সিআইএ মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কে এজেন্সির ভিয়েতনামের পুলিশ ট্রেনিং প্রোগ্রামের কাভার হিসাবে ব্যবহার করে। অব্যহতভাবেই সিআইএ শিক্ষক/ছাত্রদেরকে দিয়ে বা শিক্ষক/ছাত্র সেজে গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
কর্পোরেশন
আইনসিদ্ধ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলোকে সিআইএ ব্যপকহারে ব্যবহার করে। ফার্স্ট ন্যাশনাল সিটি ব্যংকের মতোন ফাইনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলো সিআইএ কে টার্গেট-দেশে বিপুল টাকা ট্রান্সফার করতে সাহায্য করে। ... মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনগুলো সিআইএর অপারেটিভদের বিদেশে ছদ্মবেশে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। ফেব্র“য়ারি ১৯৭৪ এ (প্রাক্তন) সিআইএ ডিরেক্টর উইলিয়াম কলবি সাংবাদিকদের জানান যে কর্পোরেট এক্্িরকিউটিভের ছদ্মবেশে সিআইএর ২০০র বেশী অপারেটিভ কর্মরত আছে।
এনজিও
১৯৬৭ সালে র্যমপার্টস ম্যগাজিন ফাঁস করে দেয় যে এনজিও/দাতা সংস্থা/ফাউণ্ডেশনগুলোর নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে সিআইএ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার তাদের গোপন তৎপরতায় খাটায়। সিনেট কমিটি জানতে পারে যে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ পর্যšত রকফেলার, ফোর্ড আর কার্নেগী ফাউণ্ডশেন ছাড়া আšতঃজাতিক সম¯ত অনুদানের অধেকটা করেছে আসলে সিআইএ। ন্যশনাল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন ছাড়াও অন্য বড় অনুদানপ্রাপ্তদের মধ্যে আছে - ইন্টারন্যশনাল জুরিস্ট এসোসিয়েশন, ..আমেরিকান ফ্রেণ্ডস অফ দি মিডল ইস্ট, কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম আর এনকাউন্টার নামের একটি পত্রিকা।
প্রবাসী আমেরিকান
পূর্ব ইউরোপিয়, চিনা কিংবা অন্য যেকোন বর্নের প্রবাসী আমেরিকানদেরকে সিআইএ তাদের গোপন তৎপরতা-খেলার অংশ হিসাবেই চিšতা করে। ৬০এর দশকের মাঝামাঝিতে তে মিয়ামীতে প্রবাসী কিউবানদের মাঝে সিআইএ তার গোয়েন্দা কার্যক্রম সংগাঠিত করে।
সারা পৃথিবীর যেকোন দেশে সিআইএ তার গেপন তৎপরতার অপারেশন সংগঠিত করার ক্ষমতা সবসময় বজায় রেখেছে । মিডিয়া ব্যক্তিত্ব থেকে সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে এমন ব্যক্তিদের সিআইএ ’এসেট’ বা সম্পদ বলে। সিনেট কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ষাটের দশকে সিআইএ সারা পৃথিবীজূড়ে সার্বক্ষনিক বিকল্পসহ গোপন তৎপরতার-’সম্পদ’দের system of standby covert action-assets) ব্যবস্থা তৈরী করে।
(যেমন ডঃ ইউনুস বা ডঃ কামাল বা মতিউর রহমান বা গওহর রিজভী যদি সিআইএর এজেন্ট হতেন তবে তাদেরকে বলা যেত বাংলাদেশে সিআইএর এসেট বা সম্পদ। ধরা যাক ডঃ ইউনুস মূল ব্যক্তি আর ডঃ কামাল হলেন বিকল্প। এটা শুধুই উদাহরন, বা¯তবের সাথে কোন মিল থাকলে অনচ্ছাকৃত !- অনুবাদক)
নিজ দেশে ঘটনা নয়ছয় করতে পারে এমন কোন বিদেশীকে নিয়োগ করার বা টাকা দেয়ার জন্যে সিআইএর নির্বাহী বিভাগ বা বিচার বিভাগ বা অন্য কারো অনুমতি লাগে না। ..বলিভিয়ার ইন্টেরিওর মন্ত্রিকে সিআইএর হয়ে নিয়োগ করা বা উরুগুয়ের পুলিশকে ট্রেনিং করানোর ঘটনা ফাঁস হলে তা ওই দেশগুলোর সাথে আমেরিকার সম্পর্কের ওপর বি্েস্ফারক ফলাফল বয়ে আনতে পারতো, তারপরেও সিআইএ এসব বিষয়ে উর্দ্ধতন কোন অনুমোদনের প্রয়োজন বোধ করে নি।
গোপন তৎপরতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে, সিআইএ আরো বেশী করে তার ’গোপন তৎপরতার ’সম্পদ’দেরকে আšতঃজাতিক একাউ্ন্টসে "FI/CI" (foreign intelligence/counter-intelligence) নাম দিচ্ছে। যাতে- যদিও এই এজেন্টগুলি তাদের দেশের ঘটনাবলীর ওপরে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে কিন্তু সিআইএ প্রয়োজনে দাবী করতে পারে যে এদের কে শুধুমাত্র তথ্য নেয়ার জন্যেই ব্যবহার করা হ’ত অন্য কিছূ না । এটা শুধুমাত্র স্বল্প সময়ের জন্যে সত্যি হতে পারে, কিন্তু এই সব ইন্টেলিজেন্স এজেন্টরা এখনো আসলে সিআইয়ের গোপন তৎপরতার যেকোন ষড়যন্ত্রে ("plumbing in place") বরাবরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
--------------------------------------------------------------------------
*সিআইএ -সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি
এফবিআই- ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনেভেস্টিগেশন
এনএসএ- ন্যশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি
আইআরএস- ইন্টারনাল রেভেন্যুউ সার্ভিস
--------------------------------------------------------------------------
মর্টন হাল্পারিন, জেরী বার্মান, রবার্ট বরোসেগ, ক্রিস্টিন মারউইক এর
'যে রাজ্যে আইন নেই : আমেরিকান এজেন্সীগুলোর যতো ক্রাইম' বই থেকে কিছু অংশ
সূত্র-
View this link
obama admits us role in 1953 iran coup