যদি জানতে চাওয়া হয় কোরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদ কে করেছিলেন, নি:সন্দেহে সকল বাঙালিই চোখ বুজে উত্তরটা দিতে পারবেন.....গিরিশ চন্দ্র সেন।
অথচ এই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়িটিই যে বাংলাদেশে এখনও প্রায় ভগ্নাংশ হয়ে দাড়িয়ে আছে, তার খবর ক'জনা রাখে!
তবে এখানে আমি আপনাদের কিছু আশার কথা শোনাবো, তার আগে এক নজরে দেখে নেই এই মনিষীর সংক্ষিপ্ত জীবন পরিক্রমা........
১৮৩৫ সালে ঢাকা মহাকুমার মহেম্বরদি পরগনার পাঁচদোনা গ্রামে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন জন্মগ্রহন করেন। পিতা মাধমরাম সেনের পূর্ব পরুষেরা ছিলেন নবাব আলিবর্দী খানের দেওয়ান। গিরিশ চন্দ্র সেন যখন মাত্র দশ বছর বয়সের শিশু, সেই সময় তাঁর বাবা মারা যান।
গিরিশ চন্দ্র সেনের শিক্ষা জীবন ছিল বেশ বৈচিত্রময়। মাত্র সাত বছর বয়স থেকেই তিনি তাঁর দাদামশায়ের কাছে ফার্সি শিখেছিলেন, পরে ইংরেজি শেখার জন্য তাঁকে ঢাকার পোগেজ স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু প্রধান শিক্ষকের বেত্রঘাতের ভয়ে, এখানে তাঁর স্কুল জীবন বেশি দীর্ঘয়িত হয়নি। এসময়ে তাঁর পরিচয় হয় পন্ডিত মুন্সি কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পরিচয় হয়, তাঁর সান্নিধ্যে এসে তিনি বিখ্যাত ফার্সি বই গুলো সব পড়ে ফেলেন।
এরপর তিনি ময়মনসিংহের একটি সংস্কৃত স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই পড়াশুনা করে পাঠশালা পর্ব শেষ করে, হার্ডিঞ্জ স্কুল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ করেন। পরে ময়মনসিংহ স্কুলে সেকেন্ড টিচার হিসাবে জয়েন করেন।
পরবর্তিতে কেশব চন্দ্র সেনের মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ব্রাক্ষ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৬৯ সালে কেশব চন্দ্র সেন পৃথিবীর আদি ধর্ম গুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার জন্যন ব্রাক্ষ্ম সমাজের চার জন পন্ডিকে নিযুক্ত করেছিলেন, এর মধ্যে গিরিশ চন্দ্র সেন দায়িত্ব লাভ করেন ইসলাম ধর্ম নিয়ে কাজ করার, খুলে যায় নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার।
এই সময়ে গিরিশ চন্দ্রের আরবী ভাষা জানা না থাকায় ১৮৭৬ সালে তিনি আরবি শিক্ষার জন্য গিরিশ চন্দ্র লক্ষ্মৌ গিয়েছিলেন। সেখানকার ব্রাহ্ম সমাজের আনুকূল্যে এবং সহযোগিতায় মৌলবী এহসান আলী সাহেবের কাছে আরবি ব্যাকরণ ও দিওয়ান-ই-হাফিজের পাঠ গ্রহণ করেন। লক্ষ্মৌ থেকে কলকাতায় ফিরে আরেকজন মৌলবীর (নামটা জানা নেই) কাছে এ বিষয়ে আরও কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ঢাকায় নলগোলায় মৌলবী আলিমউদ্দিন সাহেবের কাছে আরবি ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন।
এভাবে ভাষা শিক্ষা শেষ হবার পরে গিরিশ চন্দ্র সেন কোরআন শরিফ অনুবাদের কাজটি শুরু করেছিলেন ১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর। এই সময়ে তিনি প্রথম প্যারাটা অনুবাদ করেছিলেন। পুরো কোরআন অনুবাদ কাজ শেষ করতে তাঁর সময় লেগেছিল ছয় বছর। এই সময়ে এই অনুবাদ গুলো দুই তিন প্যারা করে এক সাথে মুদ্রন হতো, ৫০০ থেকে ১০০০ পর্যন্ত কপি হয়েছিল এক একটা মুদ্রনের, আর মূল্য ছিল দুই থেকে তিন আনা পর্যন্ত।
বাংলায় অনুবাদিত পূর্নাঙ্গ কোরআনের প্রথম মুদ্রন হয় কোলকাতা থেকে। কোরআন অনুবাদের পরে তৎকালিন মুসলিম সমাজ থেকে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনে কে সন্মানসূচক "মাওলানা" উপাধি দেয়া হয়েছিল।
কুরআন শরিফ অনুবাদের পরে ধন্যবাদ জানিয়ে গিরিশ চন্দ্র সেনের কাছে লেখা কোলকাতা মাদ্রাসার সিনিয়র সক্লার আহম্মদ উল্লাহর চিঠি
এর পাশাপাশি তিনি "বামবোধিনী পত্রিকা" নামে একটা মহিলা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
তাঁর প্রথম বাংলা অনুবাদ ছিল ফরাসি ভাষায় রচিত শেখ সাদির "গোলস্তান"। এর অনুবাদ গ্রন্থ 'হিতোপোখ্যান মালা" সেই সময়ে শিক্ষা বিভাগে পাঠ্য ছিল।
গিরিশ চন্দ্র সেন ইসলাম ধর্ম বিষয়ক ২২টি বই রচনা করেছিলেন, এছাড়া নববিধান নিয়ে তাঁর মোট ১৩ টি বই ছিল।
গিরিশ চন্দ্র সেনের লেখা একটা বইয়ের অরিজিনাল কপি!
এই কর্মবীর মনিষীর মৃত্যুবরন করেন ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট।
আপনি যদি এই মহামনিষীর বাড়িটি, যেখানে তিনি তাঁর জীবনের একটা বড় অংশ অতিবাহিত করেছেন, দেখতে চান তাহলে আপনাকে যেতে হবে নরসিংদি জেলার মনোহারদির পাঁচদোনা গ্রামে।
চারিদিক থেকে লোকজন জমি দখল করতে করতে বাড়িটাকে একদম ঢেকে ফেলেছে!
সম্প্রতি স্থানীয় ভাবে তাঁর বাড়িটি সংরক্ষন করে সেখানে গিরিশ চন্দ্র সেনের একটা মিউজিয়াম তৈরি করার পরিকল্পনা চলছে, বাকি শুধু বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব বিভাগের অনুমতি।
বাইরে থেকে দেখা না গেলেও ভেতরে পুরো বাড়িটা মোটামুটি ভাবে পুন:নির্মান যোগ্য আছে!
স্থানীয় ভাবে গিরিশ চন্দ্র সেনকে নিয়ে নিরলস ভাবে গবেষণা করে যাচ্ছেন খন্দকার ফয়সাল আহম্মেদ নামের একজন চমৎকার মানুষ। চমৎকার বললাম এ কারণে যে, বর্তমানে প্রফেশনাল লোক ছাড়া যখন কেউ এ ধরনের গবেষনায় আসতে চায় না, সেখানে একজন ব্যাবসায়ী হিসাবে তার এ অধ্যবসায় সত্যিই মুগ্ধ হবার মতো। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনও খুবই আগ্রহী এই বাড়ি সংরক্ষন আর পুন:নির্মানে। যদি তারা এ কাজে সফল হয় তাহলে একটা হবে বাংলাদেশে পাবলিক আর্কিওলজির অন্যতম একটা পদক্ষেপ!
আর্চ, লিন্টেল গুলো মোটামুটি অক্ষত আছে
পৃথিবীর অনেক দেশেই এভাবে প্রত্নসম্পদ গুলো স্থানীয় আর ব্যাক্তিগত ভাবে সংরক্ষিত হয়ে আসছে, বাংলাদেশে এটার শুভ সূচনা হতে যাচ্ছে, সেই সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম আমরা....
বই এবং চিঠির অনুকৃতিটা ফয়সাল আহম্মেদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে নেয়া।