আচার জিনিসটা মনে হয় বেশির ভাগ মানুষেরই পছন্দের খাদ্যতালিকায় একেবারে প্রথম দিকে থাকে। আমারও খুব পছন্দের, তবে মিষ্টি আচার। বাবা আর ভাইয়ার পছন্দ টক জাতীয় আচার থাকায় বাসায় মা বেশির ভাগ আচারের আইটেমই টক বানাতেন। তখন মনে মনে ভাবতাম দাড়াও আমি বড় হয়ে নেই, তখন মন কে মন মিষ্টি আচার বানিয়ে ঘর একদম ভরে ফেলবো!!
জীবনের একটা বড় অংশ কেটছে কলোনীতে। সে সময়ে খুব মজার একটা বিষয় দেখতাম মা, খালাম্মাদের। কেউ যদি বিশেষ ধরেণের কোন খাবার বা কুশি কাটার কাজ বা উলের কাজের কোন কিছু বানায়, সাথে সাথে অন্যদেরও সেই রকমের জিনিসটাই বানানো চাই। আচারে বা পিঠা পুলি হলে তো কথাই নেই। এক সাথে শুরু হয়ে যেতো। তাই জলাপাই আর আমের সময়ে আমাদের পিচিকিপাচকাদের রিতীমত ঈদ। কখন আচার তৈরি শেষে রোদে দেয়া হবে সেই অপেক্ষায় দিন কাটতো, আর আচারের সানবাথ শুরু হয়ে গেলে আমাদেরও চলতো তাদের উপর চোরাগুপ্তা আক্রমন। এমন কি সেই গেরিলা হামলা থেকে নিজেদের বাসার আচারেরর বোতলও বাদ যেত না! রাজশাহীর খালাম্মা ছিলে ন খুব মজার সব আচার বানাতেন, কিন্তু সেই আচারে কেউ ভাগ বসাতে পারতো না। খাবার ঘরের মিটসেফের তাক ভর্তি বয়ামের পর বয়াম, নিজের দু'ছেলে এরা তেমন খেতো না, তাই জমাই হতে থাকত। কোন আচার যদি একদম পুরানো হয়ে যেতে তখন খালাম্মা আমাদের তা ডেকে ডেকে খেতে দিতেন আর আমারও লোভির মতো তা খেয়ে শেষ করে দিতাম।
যাই হোক নিজের হাতে প্রথম আচার বানিয়ে ছিলাম বিয়ের পরে। নতুন বউ আচার বানানোর শখ করেছে, আমার শ্বশুর মশাই বাজার থেকে নিজে কাচা ডাসা আম কিনে আনলেন। আমের মোরব্বা বানাবো, নিজেই কাটলাম কেচলাম খুব উৎসাহ নিয়ে। শাশ্বুরি দেখিয়ে দিলেন কি ভাবে কেচতে হয় খেজুর কাটা দিয়ে। আমি ভাবলাম মোরব্বা বানানো কি আর এমন কঠিন কাজ নিজেই পরবো,আম্মুর কাছ থেকে সব রেসিপি জেনে নিয়ে নিজেই শুরু করে দিলাম। দিন শেষে ফলাফল যা দাড়ালো সেটা আমের মোরব্বা না হয় জেলী হয় গেলো
আমি লজ্জায় গরমে মুখ লাল করে চুলোর পাশেরই দাড়িয়ে রইলাম!! শেষ পর্যন্ত আমার শ্বশুড়ী মা উদ্ধার করলেন আমাকে, বললেন এটাও একরকম হয়েছে আচার হয়েছে বৌমা, এটাকে আমারা "গলা মোরব্বা" বলি!!! পরে বুঝেচি এটা সান্তনাবানী ছিল
যাই হোক এখন আমি আর ততটা আনাড়ী নই, অন্তত আচার বানানোর ক্ষেত্রে। এই হরতালে তাই বানিয়ে ফেললাম বেশ কয় রকমের আচার। রেসিপি গুলো আপনাদের জন্য........................
আমের মোরব্বা:
যা যা লাগবে.............আম দুই কেজি, চিনি এক কেজি, গরম মশলা (এলাচি, দারচিনি, লবঙ্গ, তেজপাতা)।
ভেতরে অল্প আটি বেধেছে এমন কাঁচা আম মোরব্বার জন্য সবচেয়ে ভাল। প্রথমে আম গুলোকে পুরু করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। এরপরে মাঝখান দিয়ে দুই টুকরো করে আটি ফেলে দিয়ে ভাল করে কেচতে হবে খেজুর কাটা বা টুথপিক কিংকা কাটা চামচ দিয়ে। আমি খেজুর কাটা দিয়ে কেচতে গিয়ে একবার আমের বদলে নিজের আঙ্গুলটাই কেচে ফেলেছিলাম, তাই এখন আর ও মুখো হই না। কাটা চামচে ব্যবহার করি।
আম সব ভাল করে কেচা হলে প্রথমে চুন গোলা পানিতে ঢুবিয়ে রাখতে হবে। তিন ঘন্টা পরে পানি ফেলে দিলে আবার লবন গোলা পানিতে ঢুবিয়ে রাখবেন। এভাবে তিন ঘন্টা পরে পরে লবন পানি চেঞ্জ করে দিতে হবে। এভাবে পুরো দু দিন আমা লবন পানিতে রাখতে হবে, এতে টক ভা টা চলে যাবে।
এরপরে চার কাপ পানিতে চিনি এবং গরম মশলা দিয়ে জ্বাল দিতে থাকবেন, সিরা একটু ঘন হয়ে আসলে আম গুলো ছেড়ে দিতে হবে ওর মধ্যে। ৫/৬ মিনিট জ্বাল দিয়ে নামিয়ে ফেলুন। পরের দিন আবার এমন করে ৫/৬ মি: জ্বাল দিন, হালকা করে আম গুলো নেড়ে চেড়ে দিন। খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি সময় জ্বাল না হয়, তাহলে গলে যেতে পারে। এভাবে তিন দিন জ্বাল দিয়ে পরে বয়ামে ভরে রোদে দিন। দু তিন দিন রোদের দিলেই রেডি হয়ে যাবে মজার আমের মোরব্বা।
আমের কাশ্মিরী আচার:
আম গুলোকে লম্বা লম্বা করে আধ ইঞ্চি পুরু করে কেটে নিন। আগের মতোই প্রথমে চুন পরে লবন গোলা পানিতে ঢুবিয়ে রেখে টকটা দূর করে নিন।
চিনির সিরা তৈরির পদ্ধতি আগের মতোই, বাড়তি যে মশলা দুটো যোগ করতে হবে সেগুলো হলো আদা আর শুকনা মরিচ। শুকনা মরিচ গুলো বোটার দিকে কেঁচি দিয়ে কেটে ফেলুন, তারপর হালকা করে চাপ দিলেই ভেতরে বীজ গুলো বের হয়ে আসবে। বীজ ফেলে দিয়ে মরিচ গুলোকে কেচি দিয়ে গোল গোল ছোট ছোট টুকরো করে কেটে লেবুর রসে ঢুবিয়ে রাখেন। আর আদা পাতলা পাতলা গোল করে কেটে চিনির সিরার সাথে মিশিয়ে দেবেন প্রথম থেকেই। এরপরে সিরা মোটামুটি ঘন হয়ে আসলে আমা আর মরিচের টুকরো মেশাবেন। আগের পদ্ধতিতেই জ্বাল প্লাস রোদে দেবেন।
করমচার আচার:
করমচা দু ভাগ করে বিচী ফেলে দিতে হবে। এরপরে লবন গোলা পানিতে একদিন ডুবিয়ে রাূন। হবুহু আমের কাশ্মিরী আচারের পদ্ধতিতেই বানানো যাবে।
আম রসুনেরট টক আচার:
আম ছোট ছোট টুকরো করে কেটে একটু হলুদ মাখিয়ে রোদে একদিন শুকাতে হবে। পানি মোটামুটি শুকিয়ে আসলে রসুন বাটা আর বেশি করে সরিষা বাটা দিয়ে আরেক দিন রোদে দিতে হবে।
এরপরে বয়ামের ভরে আস্ত শুকনা মরিচ, আস্ত রসুনের কোয়া (এক কেজি আমে ৫/৬টা) দিয়ে, সরিষা তেলে হালকা গরম করে ঢেলে দিতে হবে, যেন আমের টুকরো তেলে ঢুবে থাকে। এর পরে রোদে দিনে ৪/৫ দিন।
খোসা সহ আমের আচার:
আম ভাল করে ধুরে খোসা সহ চৌকা চৌকা ছোট টুকরো করে নিতে হবে। হলুদ মাখিয়ে রোদে একদিন রেখে পানি শুকাতে হবে। এরপরে কড়াইতে পরিমান মতো সরিষা তেল নিয়ে এতে আদাবাটা, রাসুন বাটা, পাঁচফোড়ন বাটা, লবন দিয়ে তাতে আম ছেড় দিন। ভাল করে কষান, খুন্তি দিয়ে আম গুলো একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা করে দিতে হবে। আমা একটু গলে আসলে উঠিয়ে ফেলুন চুলো থেকে, এরপরে বিয়ামে ঢেলে গরম সরিষা তেল দিয়ে ঢুবিয়ে দিন। তারপরে রোদে দিতে হবে ৫/৬ দিন।
আমের জেলি:
পাকা আম এক কেজি নিয়ে খোসা ফেলে আম গুলো ডুবো পানিতে সিদ্ধ করবেন। পানি শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে আসলে আম গলো তুলে রস বার করে মোটা ছাকনিতে ছেকে নিন যাতে আশ গুলো রসে না আসে।এরপরে আধকেজি চিনি দিয়ে আমের রস আর সিদ্ধকরা পানি চুলোয়ে বাসন।
ফুটে উঠে যখন সাদা ফেনা উঠবে তখন এরমধ্যে দুই টেবিল চাম লেবুর রস দিয়ে নাড়তে থাকবেন।
এভাবে ১০/১২ মি: জ্বাল করে দেখতে হবে জেলি হলো কিনা। এটা চেক কারা সহজ একটা সিস্টেম আছে। এক কাপ পানিতে কয়েক ফোটা জেলি ফেলতে হবে, জেলী হয়ে গেলে সেটা নিচে জমা হবে, না হলে পানিতে মিশে যাবে বোঝা যাবে না।
রস ঘন হয়ে আসলে নামিয়ে ফেলুন, একটু ঠান্ডা হলে শুকনো বয়ামে ঢেলে ফেলুন।
আম গুড়ের মিষ্ট আচার:
আটি শক্ত হয়েছে এমন আম নিতে হবে এই আচারের জন্য। আম খোসা ফেলে টুকরো টুকরো করে কেটে নিতে হবে আটি সহ। এরপরে হাড়িতে গুড় জ্বাল দিয়ে সিরা বানিয়ে এতে আমারে টুকরো, পাচঁ ফোরনের গুড়ো, থেতো করা রসুন, রিমান মতো লবন দিয়ে কসাতে হবে। আমা গুলোকে ঘুটে গলাতে হবে। এরপরে বড় ট্রেতে ঢেলে রোদে দিন। শিকিয়ে আসলে গলা আম গুলোকে নিয়ে আটির টুকরো গুলোর সাথে মুঠি করে করে লাগিয়ে দিন, তারপর আবার রোদে দিন।
এত সব আচারের রেসিপি জিবের জল আটকে কষ্ট করে পড়ার জন্য একটা বোনাস রেসিপি
আমের আইসক্রীম:
যে জিনিস গুলো লাগবে .............
তরল দুধ ৩ কাপ
ঘন দুধ ১ কাপ
ডিমের কুসুম তিনটা(ভাল করে ফেটে নিতে হবে)
চিনি পরিমান মতো
আইসিং সুগার ৩ টেবিল চামচ
চিনি
আমের রস আর ছোট ছোট টুকরো দুই কাপ।
প্রথমে দুধ চিনি আর ডিম মিশিয়ে জ্বাল করুন। এরপরে মোটামুটি ঘন হয়ে আসলে এতে কর্নফ্লাওয়ার গুলো মিশিয়ে আবার ফোটান। ঠান্ডা হয়ে আসলে বাটিতে ঢেলে ডিপ ফ্রিজে রাখুন। এই মিশ্রনটা আধা আধি ভাবে জমাট বাধলে বের করে এতে আমের রস আর টুকরো, ঘন দুধ, আইসিং সুগার মিশিয়ে বিটার দিয়ে ভাল করে বিট করে আবার ফ্রিজে জামতে দিন। আধা ধি জমলে আবার বের করে ক্রীম মিশিয়ে বিটার দিয়ে বিট করে আইসক্রীমের ছাচে ঢেলে ডিপে জমান।
আচারের রেসিপি পোস্টের এখানেই সমাপ্তি। যারা এই পোস্ট পড়ে আমার বাসায় বেড়াতে আসার পরিকল্পনা করছেন তাদের সবার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি, "আমি গেছি মার্কেটে বাড়িতেই নেই"
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:১৫