কক্সবাজার কতবার গেছি কিন্তু কখনোই মহেশখালি যাওয়া হয়নি কেন যেন। তাই এবার আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল কোনভাবেই এই ঐতিহাসিক প্লাস নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের আধারটাকে মিস করা যাবে না।
কক্সবাজারের ফিসারি ঘাট থেকেই ট্রলার আর স্পিড বোট গুলো ছাড়ে সোনাদিয়া, মহেশখালি, খুব সুন্দর নামের জায়গা গুলোর। জীবন যে সব মাছের শুটকি দেখেছি আজ জীবন্ত তাদের দেখতে পেলাম.... সুরমা, কোরাল, রিটা, টেকচাঁদা, রুপচাঁদা আরও কত কি! পুরো সমুদ্রিক মাছের ভান্ডারই এটা বলা যায়।
ফিসারি ঘাট থেকে কাঠের পুল পার হয়ে, কতগুলো নৌকার উপর দিয়ে হেটে তারপর স্পিড বোটে চড়তে হয়..........
বাকখালি নদীর বুকচিরে চলছি আমরা, পিছনে আমাদের একসর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে একদল গাংচিল। মহেশখালি পৌঁছার মুখেই কেওড়া গাছের সারি যেন স্বাগত জানাল........
নেমে পড়লাম আমরা মূলভুমিতে।
অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগোর মতে, ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দের প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়।
১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ চট্টগ্রামে আরাকানী শাসন শুরু হলে মূল ভূ-খন্ড থেকে পৃথক থাকার কারণে মহেশখালী দ্বীপের উপর শাসকগোষ্ঠীর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা বরং এখানে একটি সংঘবদ্ধ জলদস্যুদের আবাসস্থল গড়ে ওঠে বলে তিনি অনুমান করেছেন। মূলত কোম্পানী শাসনামলেই মহেশখালী দ্বীপটি ইংরেজদের নজরে পড়ে। সাগরের মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপটি, ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ওয়ারলেজ নামক জনৈক ইংরেজ কর্মচারী বন্দোবস্তি নেবার জন্য আবেদন করলে, ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে দ্বীপটির বন্দোবস্তি সংক্রান্ত দলিল সম্পাদিত হয়।
মহেশখালির পুরানো ও পরিত্যক্ত ঘাট, কালের সাক্ষী হয়ে এখনও টিকে আছে।
দারুন এই দ্বীপটিতে দেখার আছে অনেক কিছুই।
মন্দির ঘাটে নেমে দ্বীপে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পরবে রাখাইন এই মন্দিরটি.....
শুরুতেই রয়েছে একটি নিবেদন স্তুপ (ভোটিভ স্তুপ)।
স্তুপের একটি মজার জিনিস খেয়াল করলাম, সেটা হলো গড়ুর পাখির উপস্হিতি। গড়ুর মুলত হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর বাহন, উনি যে এখানে কেন এলেন তা বুঝলাম না
এরপরে সামনে আরকানী খ্যিয়াং স্টাইলে তৈরি বৈদ্ধ মন্দির, এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও থাকে।
এরপরে দেখতে গেলাম আরেকটা বৌদ্ধ মন্দির কমপ্লেক্স।
এটা তুলনামুলক ভাবে অনেক বড়, আর এখানে একই কমপ্লেক্সের মধ্যে তিনটা মন্দির আছে। এখানকার আকর্ষনীয় নিদর্শন হল ভেতরের বুদ্ধ মূর্তি গুলো।
ভেতের ঢুকেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে রয়েছে এই মূর্তিটা......
এরপরে মন্দির নং এক, যথারিতী আরকানী রিতীতে তৈরি .....
এর ভেতরে রয়েছে ধ্যানী বুদ্ধের পিতলের একটা বড় মূর্তি......
মূর্তির প্যাডেস্টেলটা অবশ্য কাঠের তৈরি, সোনালী রং করা। দু'পাশে দুটো ঘন্টা আছে, বেশ পুরানো।
এরপরে আরেকটা মন্দির.......
এখানেও আছে আরকানী রিতীতে তৈরি উপবিস্ট বুদ্ধের আরেকটা পিতলের বড় মূর্তি.......
এখানে একটা ইনস্ক্রিপশনও আছে, তবে এটা কোথা থেকে কবে আনা, সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেল না।
ইনস্ক্রিপশনের পাশে একই সাথে আছে দন্ডায়মান বুদ্ধের স্টাকো মূর্তি...
এঁর চারপাশে বেশ অনেক গুলো বোধিস্বত্ব মূর্তিও আছে।
এই মন্দির গুলোর মধ্যে অবশ্য ছবি তোলা নিষেধ, কেন যে নিষিব্ধ বুঝলাম না। তবে চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী, সো পাপ্পারজি চালিয়ে যাওয়া হলো পূর্নোদ্যোমে
এখন থেকে বের হয়ে গেলাম বিখ্যাত অদিনাথ মন্দিরটা দেখতে। আদিনাথ মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান।
যে পাহাড়টার মাথায় অদিনাথ মন্দিরটি নির্মিত, স্থানীয় জনশ্রুতিতে এটাই সেই পৌরানিক মৈনাক পর্বত।
পৌরনিক কাহিনী অনুযায়ি রাম রাবনের যুদ্ধের সময়, রাবন অমরত্ব পাবার আশায় কৈলাস থেকে শিবরূপি উর্ধমূখি শিবলিঙ্গকে বহন করে নিয়ে যাবার সময় দেবতাদের দৈববানী ভুলে গিয়ে এই মৈনাক শিখরে রেখেছিল। কিন্তু দৈব্যবানী অমান্য করায় সে শিবকে আর এখানে থেকে সরাতে পারেনি, আর মহাদেব তারপর থেকে এখানেই অবস্থান নেয়। শিবের আরেকটা নাম হলো মহেশ, এই মহেশের নামানুসারে এই দ্বীপের নাম হয়েছে মহেশখালি।
এটাই হলো সেই ভৈরব মূর্তি।
এছাড়া এখানে আর বেশ কিছু পাথরের অসম্পূর্ণ প্রাচীন মূর্তি আছে....
আদিনাথ মন্দিরের অস্টভুজা (দেবী দূর্গার একটি রূপ) দেবী। ১৬১২ সালে এক নাগা সন্ন্যাসী এই মূর্তিটি নেপাল স্টেইটের একটা মন্দির থেকে চুরি করে নিয়ে এসছিলেন, পরবর্তীকালে নেপাল রাজা এটা আদিনাথ মন্দির দান করে দেন।
এটার বিশেষত্ব হলো এই অষ্টভুজা সাধারণত ব্ল্যাক ব্যাসল্টে তৈরি হয়, কিন্তু এটার রং সাদা।
এই মন্দিরে একটা মজার জিনিস আছে, সেটা হলো বহু আগে থেকে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে এখানে একটি হনুমান থাকে। তবে তিনি ফটোসেশনে তেমন আগ্রহি নন বিধায় তার কোন ছবি দেয়া গেল না।
প্রতি বছরের ফাল্গুনে এখানে শিবচতুর্দশীর মেলা হয়। উপমহাদেশের আদি তীর্থস্থান হিসেবে প্রত্যেক হিন্দু এখানে পূজা করে। এই মন্দির কমপ্লেক্সে আছে একটি মসজিদ ও একটি রাখাইন বৌদ্ধ বিহার।
তাই অনেকে মন্দিরটিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক মনে করেন।
এছাড়াও মহেশখালিতে আরও যে সব দেখার জিনিস আছে তা হলো, সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ১৮৫ ফুটের মত উঁচু পাহাড়ে দুটি মিঠা পানির পুকুর, লবনের চাষ আর পানের বরজ।
ফেরার সময় মাতব্বরী করে আমারা ট্রলারে ফিরেছিলাম, সেটা ছিল একটা আমার জন্য একটা বিশ্রী অভিজ্ঞতা, সেই কথা আর না বলি
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৫৯