somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তাড়নার গন্তব্যে

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



টুকটাক যা বাকি, সেসব নিয়ে টানাটানি করছিল শাহেদ। ছোট মতো জিনিস-পত্র ও পোটলাগুলোকে বস্তায় ভরেছে, হারিয়ে যাবার কোনও ভয় থাকবে না। ছেঁড়া একটা ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে স্বামীর হাতের কাছে রেখে বলল ‘সব এখানে আছে গাড়ির পেছনে সাবধানে রেখো।’ শাহেদ হুঁ বলে কাজে মন দিল। একটা বস্তা টেনে দরজার মুখে নিয়ে গেল।
‘তুমি ওদের নিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠো।’
হুড়োহুড়িতে হঠাৎ খেয়াল হল একটা ব্যাগ—ওটাকে বস্তায় ভরে পাশে দাঁড়ানো মর্জিনাকে মুখ বাঁধতে বলল।
‘তোর ভ্যান এসেছে?’
‘হুঁ।’
‘ডাক দে।’
ভ্যান-চালক ছেলেটাকে তুলতে বলবে অমনি স্ত্রীর ফোন। ফরহাদ সাহেবের গাড়ি বের হতে পারছে না ট্রাকের জন্য। ড্রাইভার রাগারাগি করছে। ‘এক্ষুনি আসছি...’ কথা বলা অবস্থায় ভ্যান-চালককে মাল-পত্র দেখিয়ে ইশারায় ভ্যানে তুলতে বলে বেরিয়ে গেল।
নিচে ছোট মতো একটা গোল বেঁধে গিয়েছে। তাই দেরি না করে দারোয়ানের হাতে চাবি দিয়েই রওনা করে দিল।

ট্রাকে কামাল যাবে। শাহেদ, স্ত্রী আর দুই ছেলে প্রাইভেট কারে, মর্জিনা বাসে। জগা ওকে তুলে দিবে, হাতে তিন হাজার টাকা দিয়েছে সিট যে কয়টা দরকার নিয়ে নেবে।

ভ্যানে বসে মর্জিনা চুল ওড়াতে লাগল। ছেলেটা যেন উড়ে চলেছে। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর দেখা হবে না মেয়েটার সাথে। বাসার সামনের দোকানটায় চা খাওয়ার ছুতোয় বসে থাকত, যদি দেখা মেলে। মেয়েটাকে ওর দারুণ লাগে, শ্যামলা মুখে খারা পাতলা নাক। কিন্তু সাদা দাঁতগুলোই সবচেয়ে বেশি প্রিয় জগার।

মর্জিনার মনটা বিষাদগ্রস্ত। কত কিছু আজ মনে পড়ছে! একদিন ডিম আনতে গিয়েছে—দোকানি চা বানানোয় ব্যস্ত, জগাকে বলল ডিম দিতে। জগা দুই হালি ডিম এগিয়ে দিল ‘এই যে আপনার ডিম।’
সে মুচকি হাসি দিয়ে বলল ‘আমার না, সাহেবের বউয়ের ডিম...’ টাকাটা হাতে দিতে চোখে চোখ রাখল মর্জিনা—চোখে দুষ্টুমি। জগা লাল হয়ে মাথা চুলকোতে লাগল।

‘আপনার বাড়ি কোন জেলায় আপা?’
‘নেত্রকোনা—একেবারে ভারতের লাগোয়া।’
‘এখন যাইতাছেন কই?’
‘বহুদূর, দিনাজপুর জেলা। সাহেব সেখানে বদলি হয়েছে।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ—জগা গা ছাড়াভাবে প্যাডেল ঘুরিয়ে যাচ্ছে। গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। মর্জিনা ডানে-বামে, দালান-কোঠা, গাছ-পালা, মানুষ দেখছে যেন এসব কখনও চোখে দেখেনি। ধীরে ধীরে শহরের ব্যস্ততা কমে আসতে লাগল। মাঝে মাঝেই দু-চারটি ধান ক্ষেত উঁকি দিতে লাগল। হঠাৎ চৈতন্য ফিরে পেল মর্জিনা।
‘ভাই কোন দিকে চললেন! বাস-স্ট্যান্ড তো মনে হয় পেছনে...?’
‘হ, ছাড়াইছি। সামনে থেইকা তুইলা দেব। আগে আগে পৌঁছাইবেন।’
মর্জিনা বাবার সঙ্গে আসার সময় দেখেছিল ড্রাইভার বাস-স্ট্যান্ডে কীভাবে বসে থাকে আর প্যাঁ পুঁ করে। যুক্তি খুঁজে পেয়ে খুশি হয়ে উঠল।
‘ঠিকই বলেছেন আজাইরা বসে থাকতে ভাল লাগে না।’ কিন্তু বলল না ‘আপনার সাথে আরও একটু সময় থাকা গেল।’
‘আপা আপনার নাম কী?’
কী বলবে ভেবে পেল না। আসল নাম বলবে কি বলবে না চিন্তা করছিল। সবাইকে বলতে শুনেছে অপরিচিত কাউকে আসল পরিচয় দিতে নেই। কে ভাল আর কে খারাপ বোঝা খুব কঠিন। টেলিভিশনেই কতবার দেখেছে যাদের বিশ্বাস করেছে, সে-ই এক সময় সর্বনাশ করে ছেড়েছে। দুনিয়াটা বড়ই কঠিন জায়গা।
‘আপত্তি থাকলে বইলেন না।’
‘না না আপত্তি কীসের? নাম জানাতে দোষ কি—সখিনা।’
জগা জোরে একটা টান দিয়ে গান ধরল ‘ও সখিনা গেছোস কি না ভুইলা আমারে? আমি এহন ভ্যান চালাই ঢাহা শহরে... ওহ হো ঢাহা শহরে না...’
মর্জিনার খিল খিল হাসির শব্দে জগা ঘার ঘুরিয়ে একটা হাসি দিল। মর্জিনা কামিজ টান টান করে কোলে বিছিয়ে তাতে আয়েস করে দু হাত রাখল। আর তখনই জগা ভ্যান মূল রাস্তা ছেড়ে একটা গলিতে ঢুকিয়ে দিল।

নয় বছর বয়সে বাবার সঙ্গে এনেছিল শাহেদের বাসায়। প্রথম প্রথম তো কোনও কাজই করতে পারত না। কাকি কথায় কথায় চড়-থাপ্পড় দিত, চুল ধরে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিত। কাকা একদিন দেখে বললেন ‘দেখো মিনু এত খারাপ ব্যবহার কোরো না। কাজের লোক পাওয়া খুব কঠিন। যদিও পাও বিশ্বস্ত হবে না। দুদিন পর দেখবে চুরি-চামারি করে ভেগেছে। ছোট মেয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে নাও, দেখবে তোমার মনের মত হয়ে উঠবে।’
‘এই ছোট জাতেরা কোনও দিনও ঠিক হবে না। আদর দিলে এরা মাথায় চড়ে বসে।’
‘তুমি করবে আদর! অত আদরের দরকার নেই বাবা—অন্তত মারধোর কোরো না। বোঝোই তো এলাকার মেয়ে। এক সময় জানাজানি হয়ে যাবে। তখন মুখ দেখাব কেমন করে?’
‘যে আমার এলাকা! অসভ্য লোকের বাস—ওখানে মুখ দেখাতে যাওয়ার দরকারটাই-বা কী? শোনো আমার ঘর কীভাবে সামলাব, আমার ব্যাপার...’
অন্য কোন কারণে বা তাকে নিয়ে নিজেরা ঝগড়া করে কথা বন্ধ করত। সেই সময়গুলো হতো মর্জিনার কাছে দুঃস্বপ্নের মত। নিজে খেত না, ছেলেদেরও খাওয়াত না, মর্জিনাকেই সব করতে হত। এই নরকের মধ্যেও মর্জিনা ভাবত অনেক ভাল আছে। মাংস বা মাছের ঝোল মেখে তবু পেট পুরে ভাত খেতে পারে। তরকারি দিক না দিক ভাত কোনও দিন কম দিয়েছে মর্জিনার মনে পড়ে না। সৎ মার কাছে ভাত চাইলে খেতে না দিয়ে ঘার ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলত ‘তোর মরা মায়ের কাছে যায়া ভাত চা... বইসা বইসা খালি ভাত গেলা।’
একদিন বিকেলে বৃষ্টি হচ্ছিল। কাকা অফিস থেকে ফেরেনি। কাকি ছেলেদের নিয়ে দুপুরের পর ঘুমিয়েছিল। বারান্দার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগল। মনে পড়ে গেল—রেখাদের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছে। উঠোনে সবাই বসে ভাপা পিঠা খাচ্ছে। মর্জিনাকে দেখে রেখা বলে উঠল ‘তুই পুতুল নিয়া আমতলায় যা। আমি পিঠা খাইয়া আইতাছি।’
খেলা শেষে বাড়ি ফিরে মাকে বলেছিল ‘মা—রেখারা আজ পিঠা খাইল। এই দিনে কি কেউ পিঠা খায়।’
মা কোটাকুটিতে ব্যস্ত। মর্জিনা একটা কাঁঠালের বিচি নিয়ে কুতকুত খেলতে লাগল।
বিকেলে ছোট্ট খাদাটায় কোলা থেকে ধান নিয়ে আমেনা দাদিদের ঢেঁকিতে গুঁড়ো কুটে পিঠা তৈরি করে দিয়েছিল। একে একে মনে পড়ল, রোজ বিকেলে চুল আঁচরে মাথায় ঝুটি বেঁধে দিত মা, মায়ের সঙ্গে পুকুর ঘাটে যাওয়া—সন্ধ্যায় রান্নার সময় হেঁসেলের লাল আলো এসে পড়ত মায়ের মুখে। হালকা আঁধারে মায়ের মুখটা দেখাত টিয়া পাখির ঠোঁটের মত। চোখের সামনে ভেসে উঠল সব— যেন বাড়ি গেলে মাকে দেখতে পাবে, উঠোনে কলাই বা শর্ষে ঝাড়ছে অথবা বাতাসে ধুলো-ময়লা ওড়াচ্ছে। শস্য-খোসা-কুটো ওড়ানোর সময় বাতাস কমে গেলে মা বলত ‘বাতাস তো গেল রে মা, ডাক, ডাক।’
সে সঙ্গে সঙ্গে সুর ধরত
‘আয় আয় পবন।
খুদ খাইলে বাটি নিয়া আয়।
বাটি ধইরা দিলাম টান।
কলকলানি বাতাস আন।’
বৃষ্টির সঙ্গে মর্জিনার দু চোখ তখন পাল্লা দিয়েছে। কাকি ঘুম থেকে উঠে ডাক দিল। মুখ ফেরাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল।
‘হারামজাদির চোখে পানি—এ্যাঁ? বাসায় ফেরার সময় হয়েছে... কাকাকে দেখাবি... আমি অত্যাচার করি...’
গালে চটাচট থাপ্পড় বসিয়ে দিল।
‘খাওয়ায় কষ্ট দেই? গাল দেই, দেখানোর জন্য... বেশি সেয়ানা হয়েছ, হারামজাদি...’
‘না কাকি আমার মা...মা...কথা...’
‘চুপ! ছোট লোকের বাচ্চা! ঢ-য়-ঙ? ঢঙ করা এক্কেরে পিছন দিয়া ঢুকায়া দিমু...যা-আ- মুখ ধুইয়া আয়’
ঘার ধরে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিল।

‘কোন দিকে আনলেন?’ মর্জিনার কণ্ঠে আতঙ্ক।
‘ভয়ের কিছু নাই—গ্যারেজে ভ্যান থুয়াইতাছি।’
‘কেন কোনও সমস্যা?’
‘সমস্যা কিছু না—আপনার সাথে আমিও যামু।’
মর্জিনা হা হয়ে গেল—কোনও মতলব আছে না কি! সে জানে কাকির গয়নার ব্যাগের কথা। কিন্তু লোকটা টের পেল কেমনে! তার গলা শুকিয়ে গেল, ঘেমে উঠল শরীর।

‘কি হইল আপনে নামেন না কেন? ভ্যান গ্যারেজে ঢুকামু।’ লোকটার কণ্ঠে কেমন ধমকের সুর। আরও ঘাবড়ে গেল মর্জিনা।
‘না আমি নামব না। আপনি আমায় বাস-স্ট্যান্ডে নিয়ে চলেন। এখানে আনলেন কেন?’ আর একটু হলে কেঁদে ফেলত। সামলাল নিজেকে, নয়ত আরও পেয়ে বসবে।
‘আরে কইলাম তো আমি আপনারে নিয়া যামু। বাসা থেইকা জামা-কাপড় বদলায়ে নেই। আপনে মনে হয় ভয় পাইছেন?’
‘আপনি ফাঁকি দিয়ে এখানে আনলেন কেন?’
‘ফাঁকি আমি দেই নাই। আপনিই আমারে ফাঁকি দিছেন। আগে বুঝি নাই, যখন যাইতাছেন-গা তখন বুঝলাম! আমি আপনারে একা ছাড়মু না। বিপদ হইতে কতক্ষণ?’
‘হলে হবে আপনার কী?
‘আমার কী তা জানি না। আপনারে একলা ছাইড়া চিন্তায় থাকমু। কেউ যদি ক্ষতি করার চেষ্টা করে?’
‘করলে করবে সে আমি বুঝব...’
‘তারে খুন কইরা ফালামু-না!’
মর্জিনা কী বলবে হাতরে পায় না। যতটুকু দেখেছে ছেলেটাকে নিরীহ বলেই মনে হয়েছে। বাসার সামনে দোকানে গেলে প্রায়ই দেখা হত। ওর সঙ্গে দেখা হলে একটা ভাললাগার অনুভূতি জাগত। আসলে বাসা থেকে বের হবার সময়ই মনে মনে চাইত তার সাথে যেন দেখা হয়। চলে যাবে বলে আর দেখা হবে না ভেবে, মন কেমন কেমন করছিল। মনে মনে প্রার্থনা করছিল যদি যাবার আগে দেখা হয় বলবে ‘অনেক ঠাট্টা করেছি, কষ্ট পেলে মাপ করে দেবেন।’ কথাগুলো যে কতবার গুছিয়েছে। কথাগুলো সাজাতে গোছাতেও খুব ভাল লাগত। মর্জিনার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল।

রুমের মধ্যে ঢোকেনি মর্জিনা। গেটের কাছে সব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে প্যান্ট-টিশার্ট পরে একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে জগা এসে সামনে দাঁড়াল।
‘চলেন। ভাত খাইতে চাইছিলাম—ঘরেই তো ঢুকলেন না। খাড়া করায়া কেমনে খাই...’

রিক্সার পথটুকুতে একটা কথাও বলল না মর্জিনা। জগা দুইবার বলেছে জিনিসগুলা ভাল মত খেয়াল করতে। জগা যথেষ্ট চেপে বসলেও মর্জিনা রিক্সার এক পাশে একেবারে সেঁটে রইল।

এদিকে গয়নার ব্যাগ হারিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে শাহেদের গাড়িতে। মিনুর কাছে বুদ্ধুরাম, হাঁদা, মফিজ ইত্যাদি উপাধি পেতে লাগল। সে বার বার বলতে লাগল সম্ভবত মর্জিনার বস্তাতেই আছে। এবং যেহেতু সে জানে না কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু ট্রাকে যদি দেয়া হয় তবে খোয়াও যেতে পারে। কারণ ছোট ছেঁড়া ব্যাগ বলে তেমন গুরুত্ব নাও দিতে পারে আর এমন ছোট-খাট জিনিস প্রত্যেকবারই দু-চারটি হারায়। মিনু বলল ট্রাকে ফোন করে খবর জানতে। শাহেদ জবাব দিল তাতে ওরাই সেটা গায়েব করে বলবে দেখেনি। সেটা বরং বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কী করবে কারও মাথায় আসছে না, তবে গালাগাল আসছে সমানে।
‘মর্জিনাকে পুরনো ফোনটা দেয় উচিত ছিল। তাহলে জানা যেত।’
‘কত কিছুই তো করা যেত, তুমি করলে না কেন? এখন যত বাহাস...’
‘তোমার কী! ওগুলো তো আমার বাবার দেয়া... তোমার তাতে কী, থাকলেই কী আর হারালেই কী?’
‘ফালতু প্যাঁচাল বন্ধ করবে? তাহলে আমার গুলো কাকে দিয়েছ? সব তোমার বাপের দেয়া, না?’
‘হে আল্লাহ চুরি করলে যেন তোমার গুলাই করে...’
ফজলু বাস-স্ট্যান্ড থেকে জানাল মর্জিনাকে পায়নি। হয়ত বাসে উঠে পড়েছে।
‘তুমি তাড়াতাড়ি কাউন্টার থেকে ফোন করাও যে এমন কোনও মেয়েকে বাসে পেলে যেন আটকে রাখে... বুঝলে?’
একটার পর একটা ফোন করতে লাগল শাহেদ। পুলিশ, দোকানদার, ড্রাইভার, দারোয়ান... মর্জিনার বাবাকে ফোনে হুমকি ধামকি দিয়ে ত্রস্ত করে ফেলল।

মর্জিনা গোঁ ধরল তিন সিট নিতে হবে। বাসের হেল্পার জগা যতই বোঝায় ছাদে দিলে অসুবিধা নেই—ছাদে লোক আছে। কিন্তু সে মানল না। শেষে তিন সিট নিয়ে মাঝে বালতি আর পায়ের কাছে বস্তাটা রাখল। মর্জিনা জানালার ধারে বসেছে। বাস ছেড়ে দিল—বাতাসে তার চুল উড়তে লাগল।

ঘণ্টা খানেক চলার পরই মর্জিনার গা গোলাতে শুরু করল।
‘খারাপ লাগে কি?’
মাথা ঝাঁকাল মর্জিনা।
‘সুপারভাইজার ভাই—পলিথিন দেন।’
জগা একটা মর্জিনার হাতে দিয়ে অন্যটা প্যান্টের পকেটে রাখল। এক বোতল পানি আর চুইং-জিনজার কিনেছে এক ফাঁকে। এদিকে মর্জিনার কাহিল অবস্থা। জগা বোতল খুলে সামনে ধরে আছে।
‘কুলি কইরা মুখটা ধোন। আদাগুলা মুখে দেন আর বমি হইব না।’
সত্যি সত্যিই এরপর মর্জিনার আর তেমন খারাপ লাগল না। তবু ক্লান্তিটা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পর জগা কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘এখন কি একটু ভাল ঠেকে?’
মর্জিনা ঘার কাত করে—জগার নাকে-মুখে চুলের বাড়ি লাগে। হালকা মিষ্টি গন্ধে কেমন নেশা ধরাতে চায়। আমড়াওয়ালাকে দেখে বলল ‘দুইটা আমড়া নেন।’
‘খালি পেটে আমড়া খাইবেন?’ জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকায় মর্জিনার চোখে।
মর্জিনা কেঁপে ওঠে ‘না থাক।’ মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর জগা জিজ্ঞেস করে ‘রাগ করলেন?’
‘রাগ করে তো নিজের মানুষের সাথে। আপনার সাথে রাগ করব কেন?’ অন্যদিকে তাকিয়ে বলে।
‘হইতে কতক্ষণ?’
হেসে ফেলল মর্জিনা, আবারও বাইরে তাকাল—খোঁপা করে নিল চুল।


ভাড়া নিয়ে চলে গেলে জগা মর্জিনার দিকে তাকাতেই সে ঘার ঘুরিয়ে কান পাতল। যেন সে জানেই তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে এখন।
‘আপা, মনে হয় এই ব্যাগে দামি কিছু আছে?’
মর্জিনার চোখ বড় হয়ে গেল।
‘অসুবিধা নাই, আমি আছি—ঘুমাইতে পারেন।’
মর্জিনার ভেতরে ওলট পালট হতে শুরু করল। মানুষটা বুঝল কেমনে! দেখে তো খারাপ লোক মনে হয় না। চোর-চোট্টারা নাকি মানুষের চেহারা দেখেই বুঝে যায় কার কাছে কী আছে। এও কি তেমনি? না হতে পারে না। আবার যদি হয়? আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।


ক্যান্ডি দেখে ইশারা করল কিনে দিতে। ‘লোকটাকে কিছু করে দিতে বলতে এত সুখ কিসের ? আমি কি তাকে ভালবাসি?’
দশটি ক্যান্ডি হাতে দিল মর্জিনার। সে দুটি জগাকে দিতে নিলে একটি নিল। মর্জিনা দাঁতে কামড়ে খুলতে নিয়ে পারল না।
‘দেন এই রকম কইরা টান দেওয়া লাগে।’ হাত থেকে ফসকে গেল।
‘উঁহু এক্কেরে পিছলা বানায়া ফালাইছেন।’
অবশেষে মর্জিনার কামড়ানো জায়গায় জগা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলল খোসাটা। সেটা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল সে। পরেরটা আর চেষ্টা করল না, সরাসরি জগার হাতে দিল ‘খুলে দেন।’
জগা ছিঁড়ে যখন হাতে দেবে মর্জিনা চোখে দুষ্টুমি ছড়িয়ে বলল ‘অর্ধেক খান লোভ রাখা ভাল না।’
জগার মুখ লাল হয়ে উঠল। মর্জিনা হাসতে লাগল। একটু সাহসী হয়ে উঠল জগা। খানিক চেটেপুটে ক্যান্ডিটা মর্জিনার হাতে দিল।
‘আমি কি চাটতে বলেছি না কি—অর্ধেক ভেঙ্গে খেতে বলেছি—সুযোগ সন্ধানী...’
পট করে মুখে পুরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসতে লাগল।
‘আচ্ছা শোধ দিয়েন।’
বগুড়া পর্যন্ত ওদের এই খেলা চলতে থাকল। সারা রাস্তায় মর্জিনার আর বমি হল না—কেউ ঘুমল না।


যখন নামল বিকেল গড়িয়েছে। জগা বলল চলো আগে ভাত খেয়ে নেই। মর্জিনা ঘার কাত করল। মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়াল জগা, শেষে আবার মাটির গ্লাসের দই খাওয়াল। দইটা ভাল লাগল মর্জিনার।
‘আরেকটা খাওয়াও-না।’
‘ঠিক আছে কিনে নিয়ে যাই। রাস্তার মধ্যে বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। ভাগ্নেদের জন্যও নেই।’
‘তোমার বোনের কয় ছেলে-মেয়ে?’
‘দুই ছেলে—জমক।’ হাসল জগা।
‘বাহ! দারুণ তো!’
‘তুমি চাও নাকি? তাই যেন হয়...’
জগা মর্জিনার সাথে খানিকটা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতে লাগল। এক অদৃশ্য সুতোর টান তাকে চালাতে লাগল যেন—কেমন করে সখিনা আর তার মধ্যকার যত দূরত্ব আছে, জটিলতা, সন্দেহ, ভয়— সব, সব, যদি পারে এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয়। এই তো নর-নারীর মহা সঙ্গম মুহূর্ত, এই তো বেঁচে থাকা, এরই নাম প্রেম—যখন মানুষ বড় ওঠে অনেক।


জয়পুরহাটের বাসে উঠল ওরা।
‘রাতে বোনের বাড়িতে থাকি, কাল দিনাজপুর তোমায় নিয়ে যাব-নে।’
‘হারামজাদি গয়নার শোকে এতক্ষণে মনে হয়...’ চিন্তা করে উল্লসিত হয়ে উঠল মর্জিনা।


লক্কড়-ঝক্কড় বাসটি কোঁতাতে কোঁতাতে শহরে পৌঁছল সন্ধ্যে পেরিয়ে।
‘আসো একটু চা খাই তারপর...’
‘আর কতদূর?’
‘লোকাল একটা বাসে উঠব তারপর বাড়ি।’
‘আবার?’
হেসে ফেলল জগা ‘চা নাও।’


ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় বাসটি চলতে চলতে সদ্য প্রেমে পড়া জুটিকে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ করে দিচ্ছিল একটু পর পর। ধীরে ধীরে বাসটি ফাঁকা হয়ে আসছে। আকাশের পেট থেকে নেমে আসছে নিস্তব্ধতা—মন্থর-শান্ত, অলসভাবে—গাছের মাথায়, কুমড়ো ফুলে, পথে, বিস্তৃত প্রান্তরে। মর্জিনার মনে হল সব ব্যস্ততা, হৈচৈ, তীব্র আলোগুলোকে অনেক পেছনে ফেলে এনেছে। যারা কখনই আর তাকে নাগাল পাবে না। মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত ঝিরঝিরে হাওয়া ঢলে পড়ল শরীরে। জগার কাঁধে মাথা রাখল আলগোছে। কিসের আবেগে যেন চোখ মুদে এল মর্জিনার। একটা কিছুর অনুভব—কিন্তু পুরোটা ধরা দেই দেই করে দিচ্ছে না, কেবল মাতাল করে দিচ্ছে বারবার।

বাকিটুকু পড়তে চাইলে এখানে টোকা দিন
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:৫১
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাথা ঠান্ডা করুন, ভাবুন, যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করুন।

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৩

মাথা ঠান্ডা করুন, ভাবুন, যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করুন।

নিজের মতকে যে একমাত্র সত্য, সঠিক ভাবে সে নিঃসন্দেহে ফ্যাসিস্ট। সাইকোপ্যাথ সে যে উন্মাদের মতো খিস্তি খেউর করে, নিজের ভয়াবহ পিশাচ আইডিয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিন্দু - সনাতন - ইসকন কোনটা কী?

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৪


হিন্দু আমার ভাই, হিন্দু আমার প্রতিবেশী। আমার প্রতিবেশীর সাথে আমাদের কোন ঝামেলা নাই, ৩৬শেও হয়নি। আমরা একসাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিজয় মিছিল দেখেছি, কেউ তাদের দিকে তাকায়নি, সবাই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসকন আর হিন্দু এক না; হিন্দুরা কেন ইসকনকে সমর্থন করছে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:২৪



সকল ধর্ম-বর্ণে শিশু বলাৎকার হলো নিষিদ্ধ।তারপরও ইসকন নেতা চিন্ময় প্রায় সময় শিশুদের সাথে বলাৎকার ও নারীদের সঙ্গে যৌন কাজে লিপ্ত থাকে।এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি এই কাজে লিপ্ত।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিন্দুরা কেন সংখ্যালঘু

লিখেছেন পবন সরকার, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৫



১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকে হিন্দুরা এই দেশকে নিজেদের দেশ হিসাবে ধরে নিতে পারে নাই। কারণ ধর্মের কারণে বাংলা দুই ভাগ হয়েছিল। তবে দেশভাগে মুসলিম নেতারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শহীদের সেলুন

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:০৩

আমাদের এলাকায় দুইটা সেলুন ছিল। চুল কাটার জন্য দুইটা সেলুনই বিখ্যাত আমাদের এলাকায়। মুন্নার সেলুন আর শহীদের সেলুন। শহীদের মামা ছিলেন ইব্রাহিম বিহারি, উনি ওই সময় সেলুনে চুল কেটে টাকা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×