somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় গল্প: দাগ অথবা কাজল (কিস্তি — ৬ষ্ঠ)

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১২

ক্লাস শেষ করে মাঠ বরাবর হাঁটছিল। কাঠবাদাম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সোজা উত্তর দিকে তাকাল। এই দুপুর পেরিয়ে যাওয়া বেলায়, সবাই ব্যস্ত— ঘরে ফিরতে। নীলার সঙ্গে এত সময় কণা ছিল, তাড়া আছে বলে কেটে পড়েছে। গুমোট দুপুরটায় মানুষেরাও বেশি বেশি গম্ভীর— শুকনো বেজার-মুখে এদিক ওদিক হাঁটছে, আর কিছু ভাবছে— মাথা নিচু করে। হয়ত তার নিজের বা আত্মীয়-রোগীর কথা— যার বাঁচার সম্ভাবনা ... কেউবা আপন মনে চলেছে কিন্তু মন ঢুকে আছে পকেটে— চলবে কি না, স্ত্রীর সামনে দায়সারা কেনাকাটা করে কাঁচুমাচু হয়ে কী মূর্তি দেখবে ... তার শহর ... কেবল দালাল, বাটপাড় যত— হুড়মুড় হাঁটে, মাথা নাড়ে, আর একে ওকে লম্বা করে ডাক দেয়।

সুমি ভাবিকে ফোন করে নীলা।
‘ভাবি কেমন আছেন? আমি নীলা ... দু-দিন আগে দিপু ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম, আপনি ...’
ওপাশ থেকে একটি কণ্ঠ খেঁকিয়ে ওঠে, ‘এই কুত্তী ... বেহায়া-মাগি কোথাকার, এই এই— দিপু তোর কে রে-? তোর ভাতা-র?’
‘ভাবি আমি ...’
কিছু বলার চেষ্টা করল নীলা। কিন্তু সুমি কান না দিয়ে বলে চলল। রিনরিনে কণ্ঠটি, ভাটার জলে খসে পড়া পালকের মতো ভেসে গেল।
‘এত দরদ ... আহা-হা-য়া লজ্জা নেই ... অন্যের স্বামীর সাথে লটর-পটর... আবার সাধুগিরি ... মনে করিস কিছু জানি না? হারামজাদি, তুই কবে কোথায় যাস, কী করিস সব জানি, সব ... ফের যদি ওদিকে পা বাড়াস, তোর মাজা ভেঙ্গে গুঁড়ো করে দেব— মাজায় খুব জোর হয়েছে, না? পুলিশ দিয়ে তোকে ... খানকি ...’
নীলা ভাষা হারিয়ে নিশ্বাস ভুলে— মাটির পুতুল। কপাল, নাকের দু-পাশে মুক্তোচূর্ণ— আলোক-রশ্মির ঝলক। ফোন ধরা-হাত ঝুলে রইল, ভিখিরির মতো। নীলা মাঠ বরাবর ফাঁকা দৃষ্টি মেলে কিছুই দেখছিল না। কানের মধ্যে ঝিঁঝিঁ-পোকা বাসা তৈরি করল। চিবুকে ঘামের ঝর্না— তবু রুমাল শুকনোই থাকল।

বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকল— সময় পেরিয়ে গেল সময়ের মতো। নীলা ছড়িয়ে গেল নীল আকাশে।
ফোন বেজে ওঠায়, একটু ঘাড় ঘোরাল— ধরল না, দেখলও না; কে?
‘কি রে মা, ভাত খাবি না?’
ধীরে, খুব ধীরে— গণধোলাই খাওয়া পকেট-মারের মতো, পা টেনে বাথরুমে ঢুকল। ট্যাংক ভর্তিই ছিল, তবু পানি পড়ল অনেক দেরিতে। তাই ভাত খেতে নীলার দেরি হয়ে গেল।

চা খেতে খেতে তিনজন গল্প করছিল। পিন্টু টিচারের কাছে পড়ছে। নীলাকে চুপচাপ থাকতে দেখে, মা কিছু একাটা ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘তুই আর দিপুর ওখানে যাসনে।’
‘কেন মা!’ নীলার উৎকণ্ঠিত উচ্চারণ— এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। মা চোখ ঘুরিয়ে নিলেন।
‘না তেমন কিছু নয়। সোহেলের মা বলল— সুমি নাকি খোঁজ-খবর নিচ্ছে— তুই কবে, কখন ওখানে যাচ্ছিস ... এই সব।’
‘অদ্ভুত ব্যাপার! ভাবি কীভাবে জানলেন?... আর তিনিই-বা কেন অসুস্থ স্বামীর খোঁজ না নিয়ে, আমার খোঁজ নিচ্ছেন! আমার তো মনে হয় মা, তোমাদের ঐ সোহেলের মা-ই ভাবিকে উল্টা-পাল্টা বুঝিয়েছে।’ ক্ষোভ ঝরে পড়ল নীলার কণ্ঠে।
‘সে যাই হোক — মা তুই আর ওদিকে যাবি না, কেউ তো কারও ভাল দেখতে পারে না।’ মিনতিভরা মুখে তাকালেন মেয়ের মুখে— জবাবের অপেক্ষায়।
‘কেমন কথা বলছ মা— সমালোচনার ভয়ে আমরা গর্তে সেঁধিয়ে থাকব!? বিপদে-আপদে কারও খোঁজ-খবর করব না?’
‘আমাদের সমাজটা এমন-ই রে মা, সমাজের কথাও তো ভাবতে হয়; অবজ্ঞা করা চলে না।’
‘বাবা তুমি না আমাকে সবসময় বলো— পেশা হিসাবে যখন চিকিৎসাকে নিতে যাচ্ছি, আমার লক্ষ্যটাই যেন হয়, মানব-কল্যাণ। আর সেই তুমি! ...’
‘তুই তো এখনও ডাক্তার হোসনি, সময় হলে না হয় ...’
‘এটা তোমাদের গোঁজামিলের কথা। তোমরা মুখে বলো এক, অন্তরে আরেক ...’
কিছু না বলে শফিক সাহেব চা-য়ে চুমুক দেন, লা-জবাব অবস্থাকে ঢাকার চেষ্টা। এক মুহূর্ত কেউ কোনও কথা খুঁজে পায় না, অস্বস্তিভাব সকলের মুখে। যার যার মতো ভাবছে, এবার কী বলা যায়।
নীলা ঠোঁটে একটা কামড় দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘কয়দিন আগে একটা বই পড়েছি বাবা।’
বাবা-মা দু-জনেই তাদের মেয়ের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। একটু সময় নিয়ে, কাপের তলানি দেখা যাচ্ছে না, এমন ভঙ্গিতে চা-য়ের কাপ ক-বার কাত করে, সেদিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘লেখকটি নিজেকে যথেষ্ট প্রগতিশীল আর উদারমনা ভাবত। তো নিজেকে যাচাই করে দেখার জন্য একদিন করল কী— এক মেথর-পট্টির দোকানের বয়ম থেকে চানাচুর কিনল। খেতে নিয়ে বুঝতে পারল, তার ধারণা কতটা ভ্রান্ত! চানাচুর খেতে তার অস্বস্তি লাগছে। যদিও ঐ দোকানি ময়লা পরিষ্কার করে না। এই ঘটনা থেকে লেখকটি সিদ্ধান্তে এল— “মানুষ নিজেকে যত বড় মনে করে, আসলে সে তা নয়— অনেকটাই তার ভণ্ডামি।”
‘তুই কি আমাকে ভণ্ড বলতে চাচ্ছিস!’
বাবার বিব্রত কণ্ঠ কেঁপে উঠল। মা তাকালেন বড় বড় চোখে।
‘না বাবা— বলছি, তোমরা যা বলো, তার অনেকখানিই বিশ্বাস কর না।’
‘নীলা তোর ঐ লেখকের সিদ্ধান্ত ঠিক নয়, বরং বিপরীতটাই সত্য। মানুষ নিজেকে যা মনে করে, তার চেয়ে সে অনেক বড়।’
‘হয়ত-বা। কিন্তু তা কেবল সম্ভাব্য— সত্যি সত্যি বড় হতে গেলে, তাকে অবিরাম সংগ্রাম করে যেতেই হবে— যা তোমরা করতে দিতে চাও না।
বাবা তোমার কথা মেনে নিলেও, বলতে পারি— আমরা আসলে নিজে নিজেকেই আবিষ্কার করে চলেছি। ঠিক আছে বাবা, আমি আর ওখানে যাব না।’

রাতে ভাল ঘুম হয়নি, বলতে গেলে সারারাত গেছে আধা-জাগ্রত অবস্থায়। কখনও দুঃস্বপ্নের ঘোর, কখনও ভাবনায়, অথবা চোখের জল ফেলে।

মনমরা ভাব দেখে অনেকেই জানতে চেয়েছে, কিন্তু এড়িয়ে গেছে নীলা। শুধু কণার কাছে স্বীকার করেছে সব। ওকে অবাক করে জানিয়েছে, ও দিপুকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। কণা বোঝাবার চেষ্টা করেছে, ‘জেদের বশে কিছু করতে যাসনে। এক সময় জেদ চলে যাবে, কিন্তু জীবনটা তো আর পাল্টাতে পারবি না।’
‘শুধু জেদ নয় রে, আত্ম-সম্মানের সঙ্গে যখন ব্যাপারটা জড়িয়েই গেল ... আর আমি বোধ হয়, তাঁর প্রতি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছি।
আমাকে যত বাধা দিচ্ছিস, সমালোচনা করছিস, তত-ই যেন, আমি ওঁর দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে— ওঁর পক্ষে কেউ নেই, সবাই ওঁর শত্রু, ওঁকে সবাই অবহেলা করে ... সেই জন্যই আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে ...’
নীলা ফুঁপিয়ে উঠে মুখে রুমাল চেপে ধরল। কণা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নীলার মাথায় হাত রাখল। কণা আর কথা বাড়ায়নি, শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে বন্ধুকে দেখেছে। নীলা একটু স্বাভাবিকে ফিরে এলে, কণা রসিকতা করে বলল, ‘আমারও খুব লোভ হচ্ছে, দিপু ভাইকে দেখতে। লোকটির মধ্যে এমন কী পেলি, যার জন্য ঘর ছাড়তে রাজি...’
‘কিছু পাইনি-তো ... পেলে হয়ত ভালবাসাটাই গড়ে উঠত না। আমার ভাললাগাগুলো খুঁজে যাব, তার মধ্যে, অনন্তকাল। তুই দেখিস আমরা খুব সুখী হব।’ নীলা শিশুর মতো সরল একটা হাসি দিল।
‘দিপু ভাই যদি রাজি না হয়?’
‘তিনি অপেক্ষায় আছেন এতকাল, এর-ই ...’ নীলার চোখে দুষ্টুমি।
‘যাহ্ এটা বাড়াবাড়ি ... তুই কী করে বুঝলি?’
‘আমায় সে ধরণের কিছু আভাস দেননি। কিন্তু আমার মন বলছে। আমি তাঁকে ভালবেসে ফেলেছি, অমন সুন্দর করে বললেন, “যদি হাত না ছাড়ি ...” আমি ছাড়া ওঁর নাকি কেউ নেই।’
নীলা হাসল, সেই স্বপ্নের কথা, কণাকে বলে লাল হল।

নীলার দরজায় টোকা দিতেই— ‘কে?’ প্রশ্ন করল নীলা।
‘চা খেয়ে যা।’
‘আসছি মা।’
কিছুসময় পরে হাত-মুখ ধুয়ে নীলা একটা চেয়ার টেনে বসল। টেবিলে বাম হাতের কনুইতে ভর করে আঙ্গুলে ঠোঁট ঢেকে, ডান হাতের তর্জনী দিয়ে চা-এর কাপ-পিরিচে ছোট ছোট টোকা দিতে লাগল। মা পেঁয়াজ, আদা, ব্লেন্ডারে বাটার কাজটা সারছিলেন। একটা বাটিতে টম্যাটোর পেস্ট থেকে মৃদু গন্ধ বেরোচ্ছে। কিন্তু পেঁয়াজের ঝাঁজ, হঠাৎ সব কিছুকে ঢেকে ফেলল। শফিক সাহেব কিছুক্ষণ ধরে মেয়েকে লক্ষ করছেন, আর টেবিলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চা খাচ্ছেন।
‘মা তোর কি কিছু হয়েছে?’
‘হ্যাঁ বাবা!’
‘কী করেছিস তুই!’ নীলার মায়ের উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন।
‘আঃ চুপ করো তো!’
‘বল বল কী করেছিস তুই?’
‘বাবা, মা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, হয়ত তোমাদের মেনে নিতে কষ্ট হবে; কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলাব না।’
‘কী বলছিস তুই, সব খুলে বল। নিশ্চয়ই এমন কিছু করবি না, যাতে আমরা তোকে বাধা দেই। মা তুই বল, কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, বল মা বল।’ শফিক সাহেব নীলার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘বাবা আমি ঠিক করেছি ... ঠিক করেছি, আমি ... দিপু ভাইকে বিয়ে করব।’
‘কী-কী- ই! ... কক্ষনও না! হতেই পারে না!’
নীলার মা চিৎকার করে উঠলেন। বাবা যেন থতমত খেয়ে চায়ের মগটা হাত থেকে ছেঁড়ে দিলেন। চা-এর মগ গিয়ে পড়ল, টম্যাটোর বাটির এক ধারে। বাটি হতে এক ঝটকায় ছিটকে টম্যাটো-পেস্ট নীলার মুখ, গলায় ছড়িয়ে পড়ল। আঙ্গুল গলায় ছোঁয়াল— আঙ্গুলের মাথায় টম্যাটো-পেস্ট দেখে নীলা খিলখিল করে হেসে উঠল— ‘দেখছ মা, তুমি তো আমার বিয়েতে রাজি নও; বাবা কিন্তু রাজি। শুধু তোমার ভয়ে— গায়ে হলুদ দিতে সাহস পাচ্ছে না। তাই গায়ে টম্যাটো দিয়ে দিল ... হি হি হি ...’

‘তা হয় না মা, তোর একটা ভবিষ্যৎ আছে-না!’
‘আমি তো অবৈধ কিছু করছি না।’
‘আমি বেঁচে থাকতে কিছুতেই এ-বিয়ে হবে না, একজন বিবাহিত লোকের সাথে ... আর তোর বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি! তুই কি আমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছিস! ওদিকে সুমি কি তোকে ছেড়ে দেবে?’
‘দিপু ভাইকে বলব— তালাক দিয়ে দিতে।’
‘তুই একজনের সংসার নষ্ট করবি!’
‘কিসের নষ্ট! যে মহিলা অসুস্থ স্বামীর খোঁজ নেয় না, তার আবার সংসার!’
‘তাতে তোর কী? ওরা জাহান্নামে যাক!’
‘অনেক কিছু মা— ভাবি আমাকে যাচ্ছে তা-ই গালাগালি করেছে। অথচ আমি কোনও অন্যায় করিনি। কিছু না করেই যখন গালি খেলাম, আমিও দেখে নেব।’
‘মা— জেদ করে কিছু করলে ভাল হয় না।’
‘তুই শান্ত হ। দেখ মা, তোকে নিয়ে আমাদের কত আশা, এখন যদি এমন একটা কাজ করে বসিস! তোর জীবনে যদি, একটা দাগ লেগে যায়, আমরা কীভাবে সহ্য করব!’
‘বাবা! কাজল জামায় লাগলে বিশ্রী দেখায়, কিন্তু চোখে পরলে? বাবা তুমি কি তোমার নীলার, কাজল-পরা–চোখ অপছন্দ কর?’ নীলা হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ফেলল।
‘কক্ষনও না, কক্ষনও না, কাজল-পরা আমার মায়ের চোখ, পৃথিবীর সেরা দু-টি চোখ।’ বাবা-মেয়ে দু-জন দু-জনকে ধরে কাঁদতে লাগল।
‘বাবা ভাবি আমাকে গালাগাল দিল কেন?’
‘মন খারাপ করিস না।’
পিন্টু শব্দ পেয়ে একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেছে, কিন্তু দেরি করেনি।

মা লেগে গেলেন মেয়েকে বোঝাতে— ‘দেখ মা, একাজ তুই করতে যাসনে। তোর সামনে সারা জীবন পড়ে আছে, আজ তুই বুঝতে পারছিস না, কিন্তু কী ভুল আজ করতে যাচ্ছিস, একদিন ঠিকই বুঝবি।’
নীলা খাটের দক্ষিণ-পূর্বের স্ট্যান্ডে ঠেস দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে মাকে শুনে যাচ্ছে। শফিক সাহেব নীলার পড়ার চেয়ারে বসে, নীলার বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন, আর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, মেয়েকে একাজ হতে নিষেধ করতে কথাটা কীভাবে বললে, ভাল এবং কার্যকরী হবে। এবার মুখ খুললেন, ‘তোর মা ঠিকই বলেছে রে মা, জেদের বশে কিছু করতে নেই, তাতে কোনও মঙ্গল নেই।’
‘না বাবা, আমি জেদের জন্য কিছু করছি না, তখন কথার কথা বলেছি মাত্র।’
‘তা হলে তো হলই, ঝোঁকের মাথায় কিছু করিস না। দেখ মা, জীবনটা তোর, কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সেটাকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না।’
‘বাবা, আমি জীবনটা নষ্ট করছি কোথায় দেখলে? একজন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো কি ভুল? নানা জন, যখন নানা কথা বলবে, তখন এটাই কি ভাল নয় ? আর তোমরা আমার যে জীবনের কথা বলছ— তার কতখানি আমার নিজের। আমার জীবনটা কি আমি নিজের ইচ্ছায় পেয়েছি? তোমরা যদি আমাকে, আনার ইচ্ছে না করতে— আমি কি এই সুন্দর পৃথিবীর মুখটা দেখতে পারতাম? আমার এই বেঁচে থাকা— সেটা কি কেবল আমার ওপর নির্ভর করে? গ্রামের সেই কৃষকগুলো যদি আমার জন্য খাদ্য উৎপাদন না করত, আমি বেঁচে থাকতে পারতাম না। আমার যত অর্জন— শিক্ষা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা কোনটাই-বা আমার একার, কোনটিই না। হাজার বছরের হাজার মানুষের অর্জিত বিষয়গুলোকেই, আমরা একখানে জড়ো করি মাত্র। আমাদের প্রত্যেকের, মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে, সমগ্র মানব সমাজেরই অবদান আছে, একক মানুষরূপে চিন্তা করাটা এক রকম স্বার্থপরতা, ভুল সিদ্ধান্ত। পিচ্ছিল পথ চলতে, কেউ যদি হাত বাড়িয়ে দেয়, তবে ধরতে বারণ কেন?’
‘কিন্তু সেই হাতটা বাড়াতে হবে তোকেই!’ এক মুঠ অন্য মুঠে অনবরত কচলাতে কচলাতে মা প্রশ্ন করলেন।
‘আমি হলে অসুবিধা কোথায়? আমি মনে করছি, এটা আমার জন্য এক পরীক্ষা ! ব্যক্তি-মানুষ মানবজাতির একখণ্ড সম্পদ বিশেষ। সেই সম্পদ ব্যবহৃত হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণেই, শুধু নিজের ভাল চিন্তা করে নয়।’
‘শোন মা, আবেগ দিয়ে গড়া কোন সম্পর্ক টেকে না, সম্পর্ক গড়তে পরস্পরের ভালবাসা থাকাটা জরুরি।’
‘বাবা অনেক ভেবেছি— এইটুকু বুঝেছি, ওঁর পাশে আমাকে দাঁড়ানো উচিত, না হলে আমি ভাল থাকব না— এটা ভালবাসা নয়?’
‘নীলার মা, বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই, ও একটা ঘোরের মধ্যে আছে।’
গজ-গজ করতে করতে মা বললেন, ‘ওই ছাতা-নাতা বই-সব আমি পুড়িয়ে ফেলব, ওই-ই নষ্টের গোড়া।’
‘মা— বই পোড়াতে চাচ্ছ, মেয়েকে পোড়াতে চাচ্ছ না। মেয়ে বলে মায়া হচ্ছে? মায়ের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসে।
‘তার আগে আমাকে পোড়াও, সত্যি সত্যি বইটি পড়ার পর, আমি আগাগোড়া পাল্টে গেছি।’
মা রাগে, অভিমানে কাঁপতে কাঁপতে, আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললেন।

পরদিন বিকেলে নীলারা সবাই ওর মামার বাসায় গেল বেড়াতে। বুদ্ধিটা শফিক সাহেবের— নীলার মনকে ঘুরিয়ে দেয়া। নানা গল্প-গুজবে সন্ধ্যা শেষ হল। রাতের খাবারের জন্য মামা-মামির পীড়াপীড়ি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল।
মামা বললেন, ‘আপন মামা হলে নীলা এমন করতে না!’
নীলা ক্ষমা চেয়ে বলল, ‘তা ভাবলে আসতাম না— আষাঢ়ের তিন তারিখে আসব, নিজেই দাওয়াত নিয়ে নিলাম। আম পাকা ধরবে তখন।’
হাসতে হাসতে জানালা দিয়ে আমগাছগুলোর দিকে তাকাল নীলা।
মামা-মামি খুব খুশি হলেন— ‘সেই ভাল—সারাদিনের জন্য, সকালেই তোমরা চলে আসবে।’
‘তুমি না হয় ছুটি নিয়ে নিও।’ স্বামীর দিকে মুখ ফিরে বললেন।
‘না মামি, সেদিন ছুটি আছে।’
‘তা হলে তো ঠিকই আছে, আর এর মধ্যে তোরা একদিন আয় সময় করে।’
‘না বুবু আগে তোমরা এসো, যদি আবার ফাঁকি দাও।’
সবাই একত্রে হেসে ওঠে।

নীলার ভয় ছিল, ওখানে হয়ত ওকে সাত-পাঁচ বহু কিছু বোঝানো হবে; তাই আসতে প্রথমে আপত্তি করেছিল। অবশ্য সেসবের কিছুই ঘটেনি। একে একে বিদায় নিয়ে বাড়িমুখো হয়।

‘ভাবি দিপুর অবস্থা এখন কেমন?’
বাড়ির সামনে এক প্রতিবেশীর প্রশ্ন। ভাবির মুখে সমস্ত রক্ত এসে জমা হল যেন। আর নীলার নাক, চোয়াল প্রস্তর-মূর্তির মতো শক্ত হয়ে গেল। কসাই তার ছুরি নীলার চোয়ালে দু-ঘষা দিলেই শানিয়ে উঠত। কেউ কোনও জবাব না দিয়ে বাসায় ঢুকল। শুধু পিন্টু একবার কিছু বলতে গিয়েও কথা শেষ করল না।

‘এখন বোঝো! সবার কাছে আমরা রসিকতার পাত্র! পাড়ার লোকেরা মজা করার একটা বিষয় পেয়েছে। কী দরকার ছিল, মেয়েকে এত পড়াবার। ডাক্তার হয়ে বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করবে, এবার মুখ উজ্জ্বল হল তো! তার চেয়ে দেখেশুনে বিয়ে দিয়ে দিলেই হত। মেয়ে মানুষের এত লেখাপড়া করার দরকারটা কী? বিদ্বান হবে!...’
নীলার মা রান্না-ঘরে থালাবাটির সাথে মারামারি করতে করতে গজগজ করছিলেন।
বাবা বললেন, ‘আস্তে আস্তে করো, ট্যাপসা হয়ে যাবে তো...’
বাম হাতে বাটি, ডান হাতে কাঁটা চামচ উঁচু করে, চোখ দুটো গোল করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।
‘ওভাবে তাকিও না, ভয় হচ্ছে— মনে হচ্ছে, কাঁটা চামচ দিয়ে আমার চোখ তুলে বাটিতে করে...’
‘যেমন মেয়ে! তেমন তার বাপ!’ চামচ-বাটি ছুঁড়ে দিয়ে হন হন করে শোবার ঘরে চলে গেলেন।
আজ মেয়ের পড়ালেখার বিপক্ষে এত বলছেন, অথচ সর্বদা তিনিই কিন্তু মেয়েকে উৎসাহ যুগিয়েছেন, মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। মানুষের স্বভাবটাই হয়ত এমন— সুযোগ বুঝে সবাই ভোল পাল্টায়, তাৎক্ষণিক জয় পাবার জন্য, নিজের অবস্থানের বিপক্ষে যেতে কুণ্ঠিত হয় না।

নীলা ধীর পায়ে ঘর হতে বেরিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল। মা নীলার ছায়া দেখেই, না তাকিয়ে চালের হাঁড়িতে জোরে ট্যাপ ছেঁড়ে দিলেন— তার সব ক্ষোভ ট্যাপের মুখ দিয়ে বের হচ্ছে।
‘তোমাদের আর কোনও কথা শুনতে হবে না।’
মার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। চালের হাঁড়িতে হাত ঘোরাতে লাগলেন।
‘বাবাকে বলো মসজিদের হুজুরকে ডেকে আনতে; আর তুমি একটা তোমার ভাল শাড়ি দাও।’
মা হতভম্বের মতো নীলার মুখে অপলক তাকিয়ে রইলেন। হাঁড়ি উপচে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল, ঘোলা-রঙ ফ্যাকাসে হতে হতে উধাও হয়ে পরিষ্কার জল, টলমল করতে লাগল। মার হাত থেকে টপটপ করে ফোঁটা, মেঝেয় পড়তে লাগল। আড়-চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকল নীলা। মা-মেয়ের নির্বাক মুহূর্ত দেখে ট্যাপের জলধারা নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতে লাগল।
‘নীলা তুই এসব কী বলছিস! তুই কি পাগল হয়ে গেলি!’ বাবা বললেন।
‘আমি ঠিক আছি, হুজুর ডাক বাস...’
পিন্টু কিছু বুঝতে না পেরে, একটা চেয়ার ধরে আছে, আর সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
‘এটা কি ছেলে খেলা!...’
‘আমি খেলার কথা বলছি না বাবা! পিন্টুকে দিয়ে হুজুরকে ডাকিয়ে আনাও, এত রাতে কাজী পাওয়া যাবে না।’
‘চুপ কর!...’
‘বাবা, এ বাড়িতে হুজুর আসবে বিয়ে পড়াতে, নয়ত জানাজা পড়াতে, ভেবে দেখো তোমরা কোনটা চাও...’ এই বলে নীলা তার ঘরে চলে গেল।

কিস্তি - ৫ম

কিস্তি - ৭ম
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৪০
২৬৯ বার পঠিত
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিকল্প জীবন......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪

বিকল্প জীবন .....

এমন একটা জীবনের কথা আমরা কী ভাবতে পারি না- যে জীবনটা হবে খুব সহজ, সরল আর সাধারণ। যে জীবনে প্রয়োজনের বেশি লোভ লালসা, চাওয়া পাওয়া আর হার জিতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়’

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১১:৩৯


মাস্টারমাইন্ড গভর্নর আতিউর


বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন ডলার লুটের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার ‘মাস্টারমাইন্ড’ তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তার নির্দেশনায় রিজার্ভ থেকে ওই অর্থ সরানোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ফুলের মৌসুমে ফুলের ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:২৩

০১। ফুলের মৌসুমে ফুলের ছবি দিলাম। এগুলো বিভিন্ন সময়ে তুলেছিলাম। অনেক অনেক ছবি এখনো গুগল ফটোতে জমা আছে। ভাবছি আস্তে আস্তে সব ব্লগে রেখে দেব। নইলে জায়গা খালি পাবো না।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ডায়েরী- ১৪৪

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৩:০৭

ছবিঃ আমার তোলা।

চলছে শীতকাল।
চলছে বাংলা 'মাঘ' মাস। তারিখ হচ্ছে নয়। এ বছর আমি শীতের জামা পড়ি নাই। প্রতিদিন ভোরে বাসা থেকে বের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে ইসলাম ও বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২



সব জাতির মানুষ লজিক্যালী ভাবতে পারে না; লজিক্যালী যারা ভাবতে পারে না, তারা ছাত্র অবস্হায় ক্লাশে অংক পারে না। যেই জাতিতে শিক্ষার মান কম, সেই জাতির ছেলেমেয়েরা ক্লাশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×