আমাদের, মুসলমানদের অবস্থ সেই ৩ বন্ধুর মত।-- ৩ বন্ধু, ১ জন হিন্দু ১জন খ্রিস্টান ও ৩য় জন মুসলিম, গ্রামে বেড়াতে গেছে। পথের পাশে পাকা আখ দেখে মজা করে খাওয়ার জন্য তারা আখ কিনলো। গ্রামের ১ ঠগ তাদের কাছে এসে ৩ বন্ধুর মধ্যে ১জন খ্রিস্টান জানতে পেরে বলল, "আমার দেশি ভাইদের সাথে বিজাতী খ্রিস্টান কেন!" এই বলে সে খ্রিস্টান বন্ধুটির কাছ থেকে আখ কেরে নিয়ে তাকে তারিয়ে দিল। বাকি ২ জনের সাথে আরও ২/১ টা কথা বলার পর বলল, " হিন্দুদের ঈমান নাই, তারা মুলসমানদের সাথে থাকতে পারে না!" এই বলে হিন্দু জনের আখও কেরে নিয়ে তাকেও তারিয়ে দিল। হিন্দু জন চলে যাওয়ার পর মুসলমান ছেলেটার হাত থেকে আখ কেরে নিয়ে ঐ আখ দিয়েই তাকে কয়েক ঘা বারি দিয়ে বলল "তোর আখ খাওয়া লাগবে না, যা বাড়ি যা!" কাদতে কাদতে মুসলমান জন বাড়ি ফিরে বন্ধুদের কাছে গেল। বাকি ২ বন্ধু তখন তাকে আচ্ছামত মার দিয়ে তারিয়ে দিল।
আমরা মুসলমানরা ঐ ৩ বন্ধুর মত নিজেদের একতা না রেখে দলাদলি করছি আর মার খাচ্ছি। আমরা নিজের ধর্ম সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি। অনেকে মনেকরি নামাজ-রোজাই সব! অনেকে তো নিজেকে মুসলমান বললেই বেহেস্ত পাওয়া যাবে মনে করি। ইসলামের মূল চাওয়া জানার চেষ্টাও করি না।
মুসলিম জীবনে সংগঠিত থাকার গুরুত্ব এত বেশি যে, প্রাজ্ঞ নেতার অধিনে সংঘবদ্ধ থাকাকে ইসলাম ধর্মে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: মেষ পাল থেকে বিচ্ছিন্ন মেষকে যেমন নেকড়ে বাঘ ধরে নিয়ে যায় তেমনি শয়তান সংঘ থেকে বিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে নিজের খপ্পরে নিয়ে নেয়।
নবী করীম (সঃ)-এর সময়ে শুধু তারাই মুসলিম বলে গন্য হতেন যারা নবীর জামায়াতে শরীক হয়ে নবীর নিকট বা তাঁর প্রতিনিধির নিকট বাইয়াত হতেন। ঐ জামায়াতের বাইরে থাকলে মুসলিম বলে গন্যই হতো না। ঐ জাময়াতই দ্বীনের একমাত্র জামায়াত বা আল-জামায়াত বলে স্বীকৃত ছিল।
(সূরা আন নিসা-আয়াত ৫৯) : ‘হে ঈমানদার লোকেরা! আনুগত্য করো আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের আর সেইসব লোকদেরও, যারা তোমাদের মধ্যে সামগ্রিক দায়িত্বশীল। অতপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়, তখন ব্যাপারটা আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাকো। এটাই সঠিক কর্মনীতি আর পরিণতির দিক থেকেও এটাই উত্তম।’
রসূলে আকরাম (সা.) বলেছেন: “যে আমার আনুগত্য করলো সে আল্লাহর আনুগত্য করলো। যে আমার হুকুম অমান্য করলো, সে মূলত আল্লাহর হুকুম অমান্য করলো। যে আমীরের আনুগত্য করলো, সে আমার আনুগত্য করলো। আর যে আমীরকে অমান্য করলো সে আমাকে অমান্য করলো। নেতা হলো ঢালস্বরূপ। তার সংগে থেকে যুদ্ধ করা হয় এবং (বিপদ থেকে) রক্ষা পাওয়া যায়।” -সহীহ বুখারি ও মুসলিম।
রসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন: “নেতার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া ব্যক্তি কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর সাথে মিলিত হবে, তখন আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার মতো কোনো যুক্তি-প্রমাণ তার থাকবেনা। আর সংগঠন ও ইমামতের নিকট বাইয়াত ছাড়া যে ব্যক্তির মৃত্যু হলো, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো। ” -সহীহ মুসলিম।
অপর একটি হাদিসে আছে: “মুমিন ব্যক্তির জন্যে (আমীরের) কথা শুনা ও মানা অপরিহার্য, যেসব কথা পছন্দ হয় সেগুলোও, আর যেসব কথা পছন্দ হয়না সেগুলোও, যতোক্ষণ তিনি আল্লাহ ও রসূলের বিধানের খেলাফ কোনো হুকুম না দেবেন। অবশ্য যখনই তিনি আল্লাহ ও রসূলের বিধানের খেলাফ কোনো হুকুম দেবেন, তা শুনাও যাবেনা, মানাও যাবেনা।” -সহীহ বুখারি ও মুসলিম।
ইসলামে নেতা নির্বাচন পদ্ধতি:: প্রথম ৪ খলিফার কেউই নিজ ইচ্ছায় ক্ষমতায় আসেন নাই। বরং কোন না কোন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথম চার খলিফা নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা থেকে আমরা ইসলামের নেতা নির্বাচন পদ্ধতি জানতে পারি।
১। রাসুল (স.) এর মৃত্যুর পর মদিনার জনগণ সাকীফা বনী সায়েদা নামক স্থানে সমবেত হয়। তারা দীর্ঘ্য আলোচনার পর প্রায় সকলের সম্মতিতে আবু বকর (রা.) হাতে বাইয়াত নেন।
২। প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা. আন্তিম সময়ে পরবর্তী খলীফা নির্বাচন করে যাওয়াই ভাল মনে করেন। মদিনার উচ্চপর্যায়ের সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে হযরত উমর রা. কে খলীফা নির্বাচিত করেন।
৩। হযরত উমর (রা.) মৃত্যু শয্যায় থেকে একটি বোর্ড গঠন করে ছয় জন সাহাবীর মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করার আদেশ দেন। বোর্ডের সকলেই আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বোর্ড হযরত উসমান রা. কে খলীফা নির্বাচিত করে। পরে জনগণ বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খলীফার কাছে বাইয়াত নেন।
৪। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রা. নিহত হওয়ার পর মদিনার মুসলমানগন হযরত তালহা, যুবায়ের ও আলী রা. কে খিলাফতের দায়িত্ব নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। পরে মুসলমানগণ সম্মিলিতভাবে হযরত আলী রা. কে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য করেন।
(সূরা আল ইমরান-আয়াত ১০৩)- ‘তোমরা সবাই মিলে শক্ত করে আল্লাহর রশি ধরো, দলাদলিতে লিপ্ত হয়ে পড়োনা। আল্লাহর সেই অনুগ্রহকে স্মরণ রেখো, যা তিনি তোমাদের প্রতি করেছেন। তোমরা ছিলে পরস্পরের দুশমন। তিনি তোমাদের মনকে মিলিয়ে দিয়েছেন। আর তাঁরই কৃপায় তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেছো। তোমরা আগুনে ভরা এক গভীর গর্তের কিনারে দাঁড়িয়েছিলে আর আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের সামনে তাঁর নিদর্শন সমূহ স্পষ্ট করে ধরেন, যাতে করে তোমরা তোমাদের কল্যাণের পথ লাভ করতে পারো’।
রসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “আমি তোমাদের পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। স্বয়ং আল্লাহই সেগুলোর নির্দেশ আমাকে দিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন : ১. জামাতবদ্ধ থাকার, ২. নেতার কথা শুনার, ৩. নেতার আনুগত্য করার, ৪. হিজরত করার (অর্থাৎ আল্লাহর অপছন্দনীয় বিষয় ত্যাগ করার এবং ৫. আল্লাহর পথে জিহাদ করার। আর জেনে রাখো, যে ব্যক্তি জামাত থেকে এক বিঘত পরিমাণও বের হয়ে গেলো, সে নিজের গলা থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেললো- যতোক্ষণ না সে পুনরায় এসে জামাতে শামিল হয়েছে। আর যে ব্যক্তি মানুষকে কোনো জাহেলি আচার ও মতবাদের দিকে আহবান জানায়, সে হবে জাহান্নামের জ্বালানি, যদিও সে রোযা রাখে, নামায পড়ে এবং নিজেকে মুসলিম বলে ধারণা করে”। -----সূত্র আহমদ, তিরমিযি। বর্ণনা : হারিছ আল আশ’আরি।
উল্লেখিত আয়াত এবং হাদিসটি থেকে পরিষ্কার :
১। যুদ্ধ আর জঙ্গীবাদ ভিন্ন জিনিস, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ইসলাম ধর্ম পরিপন্থী। সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদীরা মুসলমান নয়।
২। সংগঠন ও নেতৃত্বের আনুগত্যবিহীন জীবন সত্যিকার ইসলামি জীবন নয়।
৩। কোনো অবস্থাতেই কোনো মুসলিম সংগঠন থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। সংগঠন থেকে মুক্ত হওয়া মানেই ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া।
৪। নেতৃত্বের আনুগত্য করতে হবে।
৫। দলাদলি, বিশৃংখলা ও বিচ্ছিন্নতা মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ।
ইসলাম ধর্ম কোন ভাবেই জঙ্গীবাদ বা চোরা-গুপ্তা আত্মঘাতী হামলা সমর্থন করে না। তাই বলে কিল খেয়ে হজম করতেও বলে নাই, বরং কিল প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে। তবে এই প্রতিরোধ হতে হবে সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে। কেউ ১জন আল্লাহু-আকবর বলে লাফিয়ে পরলেই হবে না।
বর্তমানে বিচ্ছিন্ন কোন জামায়াত ইসলামের আল-জামাত-এর মর্যাদা পেতে পারে না। রাসূলের আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত সকল স্থানীয় জনসংগঠনই ১টি চেইন মেইনটেন করবে, এবং বিশ্বব্যপি ১টিই মুসলিম অথরিটির আনুগত্য করবে। এই মুসলিম অথরিটিই আল-জামায়াত বলে গন্য হবে। খ্রিষ্টানদের পোপ/ভেটিকান সিটির মত ১জন নেতা থাকতে হবে, এবং সকল মুসলমান তার নির্দেশ মেনে চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ২:৩৫