বাংলা গালাগাল শব্দটির আপাত ব্যবচ্ছেদ গাল+আগাল মনে হলেও ফরহাদ খানের মতে, এর উৎপত্তি আরবি-ফারসি শব্দ গালি-গলুজ থেকে। গালির মূল ব্যুৎপত্তি গুলু, অর্থ অতিরঞ্জন। গলুজ-গালিজ শব্দের অর্থ কঠোরতা, তীব্রতা, নোংরামি। অর্থাৎ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে, আবেগমথিত হয়ে কঠোর ও নোংরা রকমের যে ভাষা ব্যবহার করে, তাই হল গালাগাল, গালাগালি বা গালি-গালাজ।
‘অপরাধজগতের ভাষা’, ‘অশ্লীল অভিধান’, ‘অপভাষা’, এবং ইংলিশ ‘স্ল্যাং ডিকশনারি (slang dictionary)’ ইত্যাদিতে পরিবেশিত, সন্নিবেশিত শব্দসমূহের ব্যবহার সমাজের সবাই করে, এমন নয়। বরং এগুলোর ব্যবহার হয়ে থাকে নানা রকম শ্রেণিভেদ অনুসারে। আর্থিকভাবে নিচু তথা বস্তি বা গ্রাম্য সমাজে যে শব্দটি (গালিটি) স্বাভাবিক, শ্রোতা বা উদ্দিষ্ট ব্যক্তির মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না; সেটিই আবার তুলনামূলক মধ্যবিত্ত অবস্থানের কোনো মানুষকে তুমুলভাবে নাড়িয়ে-কাঁদিয়ে দিতে পারে। পিতা-মাতা, ভাই-বোনকে জড়িয়ে যৌনতাবোধক শব্দের ব্যবহার গ্রাম্য ও বস্তি সমাজে একেবারেই সাধারণ ব্যাপার। মধ্যবিত্ত সমাজে তা গর্হিত এবং অবশ্যই বর্জনীয়। মধ্যবিত্ত বিশেষত বুদ্ধি ও রুচির চর্চাকারী সমাজটি পরস্পরকে আঘাত করার জন্য যে-সব শব্দ ব্যবহার করে এবং ছুঁড়ে মারে, তা শোনে বস্তি-গ্রাম্য সমাজ হেসে উঠতেই পারে। সেই মধ্যবিত্ত, বিদ্যা-বুদ্ধির কারবারিদের কেউ কেউ অন্যকে নির্বোধ, অসামাজিক ইত্যকার বলেও আহত করতে চায়। তবে যারা নি¤œ ও মধ্য শ্রেণির মাঝামাঝি ঝুলে আছে, একেই বোধহয়, বলা হয় ত্রিশঙ্কু অবস্থা! বেশ করুণ! অবচেতনভাবে, মুখ ফসকে প্রায়ই পুরনো পরিচয় ভেসে ওঠে তাদের। আবার কখনো কখনো নিজেদের আড়াল করার জন্য পশু শ্রেণিকে আপন করে নেয়। মানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে পশু-সংশ্লিষ্ট গালি দিয়ে নিজে যে মানুষ(?), সে প্রমাণ জোড়ালো করতে চায়। এ পর্যায়ের অতি চালাক কেউ কেউ সরাসরি গালাগালের আশ্রয় না নিয়ে পশুদের জড়িয়ে হেঁয়ালিপূর্ণ বাক্যিক কৌশল গ্রহণ করে।
গালাগালের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত মানুষদের জ্ঞান ও মন-মানসিকতা একেবারেই বস্তি-গ্রাম্য সমাজের মতো। এরা সাধারণত এ-সব ব্যবহার করে না। যখন করে, তখন নিচে নামতে দ্বিধা করে না, বলা ভাল, একটু বেশিই নামে এবং পাতাল স্পর্শ করে। এদের মাঝে যারা একটু রুচির অধিকারী, শিক্ষার সংস্পর্শে বিবেকের জাগরণ ঘটেছে, তাদের অবস্থা ভিন্ন। বলা যায়, বুদ্ধি-বিবেকের দৌড় অনুসারেই এদের শব্দ উঠা-নামা করে।
পেশা ও নেশাভিত্তিক সমাজ অনুসারেও গালাগালের বিন্যাস রয়েছে। ভাষাবিদরা একে জারগন (jougon) বলবেন কি-না, তা তাদের ব্যাপার। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, ধর্ম-পরিসরের লোকজনও একে অপরকে ক্ষুব্ধ হয়ে অধার্মিক, লা-মাজহাবি, দেওবন্দি, ওহাবি, মওদুদি, বেরেলি, রেজভি, কাদিয়ানি, ফাসেক, জিন্দিক, নাস্তিক, মুলহিদ ও মুরতাদ ইত্যাদি গাল দিয়ে
থাকেন। সম্প্রতি একজন আলেমের লেখায় অপরকে জারজ হিসাবে অভিহিত করার মতো ইঙ্গিতও দেখা গেছে! এটা বোধহয় পূর্ব পরিবেশের প্রভাব! বৈশ্বিক মতাদর্শগতভাবে পুঁজিবাদী, কমিউনিস্ট, সামন্তবাদী, মৌলবাদী ইত্যাদি শব্দও গালি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর পরিসরটা আবার একান্ত রাজনৈতিক।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনে মির জাফর বিশ্বাসঘাতক হিসাবে কাজ করায় ‘মির জাফর’ শব্দটি একটি গালিতে পরিণত হয়, একাত্তরের পর যেমন ‘রাজাকার’ শব্দটি। এই শেষোক্ত শব্দটি ফারসি ব্যুৎপত্তির মূল সীমানা-চৌহদ্দি থেকে এতটাই দূরে সরে গেছে যে, এ নিয়ে আলোচনা করতেও সংকোচ হয়। শাহবাগ আন্দোলনের পর যেমন ‘ছাগু’ শব্দটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে। আবার বিপরীত পক্ষে কেউ কেউ আওয়ামি শব্দটাকেও অমানবিকতার প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহারের প্রয়াস পায়, তবে এদের অধিকাংশই জামায়াত বা বিএনপি-মনা। এদের মুখ থেকেই বোধহয় শোনা: তুই মানুষ না আওয়ামী লীগ! এটা বোধহয় ১৯৯৯-২০০০ সালের কথা। বিএনপির (?) কবি আবদুল হাই শিকদার তো ‘আওয়ামী জাহেলিয়াত’ নামে একটি কবিতাও লিখেছেন!
বুদ্ধি-মার্গে অবস্থান যাদের শীর্ষে, তারা আবার অন্যকে অশালীন ও অরুচিকর শব্দে বিদ্ধ করেন না। যেমন কওমি ঘরানার মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ, আওয়ামী ঘরানার জাফর ইকবাল, বাম ঘরানার ফরহাদ মজহার। অতীত মনীষীদের মাঝে সক্রেটিস, ইবনে তাইমিয়া, শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং কার্ল মার্কসের লেখায় এমন কিছু চোখে পড়ে নি। এঁরা কি এ-সব শব্দ ব্যবহার করেন নি, না আমাদের পর্যন্ত পৌঁছয় নি, তা সম্পূর্ণ অজানা।
আদর্শের (ধর্মের বা অধর্মের) প্রচারকামী কেউ কেউ ভাষার আশ্রয়ে নিজের আদর্শ প্রচার করতে চায়। তারা অনেক সময় ভুলে যায় যে, আদর্শ মানে ভাষার মারপ্যাঁচ নয়। আদর্শ হলো এক ধরনের প্রশান্তি ও মানসিক নিরাপত্তা। তাই আদর্শপুজারীর কাজ হবে আদর্শের বিষয়ে উদ্দিষ্ট্য মানুষকে (পাঠক-দর্শক-শ্রোতাকে) আশ্বস্ত করা; কোনোভাবেই উত্যক্ত করা নয়। কখনোই কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে আঘাত করা নয়, ঘায়েল করা নয়। বরং আদর্শের মাঝে যে প্রত্যাশিত নিরাপত্তা ও প্রশান্তি রয়েছে, তা সার্বিক পদ্ধতিতেই নিশ্চিত করা। হ্যাঁ, আদর্শ যেহেতু চিন্তাগত ব্যাপার, তাই এর নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকতে পারে। ভিন্ন রকম ব্যাখ্যা নিয়ে যদি কেউ দাঁড়ায়, সঠিক জবাবটা না দিয়ে তাকে অসহিষ্ণুভাবে আক্রমণ করলে বা তাড়িয়ে দিলে কোনোই লাভ হবে না। এতে বরং আদর্শকর্মীর দুর্বলতা প্রকাশ পায়। মানুষকে যত সহজে সাবলীল ভাষায় তুষ্ট করা যায়, তাই মঙ্গল। বিপরীত পক্ষের বা আদর্শের বিরোধীরাও আক্রমণ করতে পারে, টিটকারি দিতে পারে। তখন এর জবাব দিতে গিয়ে, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে ধারনকৃত/পুজ্য আদর্শ যেন কোনোভাবে আহত না হয়, তা লক্ষ্য রাখার দরকার হলেও অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না। আর তখনই বিপত্তিটা বাড়ে।
এসব বিষয়ে ইসলামের শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ সা.-এর জীবনধারা অতুলনীয়। প্রতিপক্ষকে তিনি আপত্তিমূলক অরুচিকর শব্দে-বাক্যে কখনো আহত করেন নি। গালাগালের তো প্রশ্নই আসে না। তাঁর সাহাবাদের মাঝে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি ও বিবাদ ছিল, কিন্তু মন্তব্য করার ক্ষেত্রে প্রায় সবারই যে সতর্কতা ও সচেতনতার পরিচয় মেলে, ইতিহাস এর স্বাক্ষী, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
এর পরবর্তীতে ইসলামের নামে নানা দল-উপদল (শিয়া-সুন্ন্,ি খারেজি-রাফেজি, সালাফি-জেহাদি, দেওবন্দি-ওহাবি, রেজভি-বেরেলি, লা-মাজহাবি-ইখওয়ানি, কাদিয়ানি-বাহায়ি) পরস্পরকে যেমন নানা আপত্তিকর শব্দে বিদ্ধ করে, তেমনই বিরোধীদের বেলায় কঠোর শব্দপ্রয়োগ করেই যেন নিজের সততা ও সত্যতার খুঁটি দাঁড় করাতে চায়। এ সব গোষ্ঠী ফেসবুকে-ব্লগে আদর্শবাদী যুদ্ধ-জিহাদে, আত্মপ্রচারের নেশায়, আবেগমথিত হয়ে কল্পিত ও বাস্তব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যে-সব শব্দ ব্যবহার করে, তা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না। তবুও এগুলো চোখে পড়ে এবং অন্তর্জালে এদের দাপট ও প্রতিপত্তিই বেশি! অথচ এটা তো জানা কথা যে, নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি ও সক্ষমতার ওপর যখন মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখনই মানুষ অশালীনতার আশ্রয় নেয়। অক্ষমের সকল ক্ষমতা হলো জিব ও কলমের ডগায়। মুখ ও কলমের নিবকে ডাস্টবিন বানিয়ে ওরা ভাবে, যাক, কাউকে তো কালিমালিপ্ত করা গেল!
দ্য ভিঞ্চি কোড- উপন্যাস প্রকাশ হলে কাউকে বুঝতে না দিলেও খ্রিস্টান জগত প্রচ- রকম আলোড়িত হয়েছিল। এর ফিল্মিরূপ প্রকাশিত হলে এশিয়ার ফিলিপাইনে তো লঙ্কা কা- ঘটে যায়! কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা জগতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ (ফাদার/সিস্টার/নান) যে কর্মকুশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা সচেতন অনেকেরই জানা। তাদের সেই সব প্রতিক্রিয়ায় শালীনতা, শুভ্রতা ও পরিমিতির যে পরিচয় ছিল, তা এই সময়ে বিরল! যিশুর অনুসারীরা যা করতে পারে, যিশুর পরবর্তী ও শেষ নবির অনুসারীরা তা করতে পারে না কেন? প্রশ্নটি রেখেই ইতি টানছি।
১. ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৯ ০
হে হে
বড় সত্য কথা বলছেন।