somewhere in... blog

দাড়ির ভূগোল, ভূগোলের দাড়ি

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দাড়ি রাখা নবি-রাসুলদের রীতি। দাড়ির পরিমাণ-প্রকৃতিও তাই ফিকহি গ্রন্থের আলোচনার বিষয়। কিন্তু এই দাড়ি-বিষয়ক নানা প্রবণতার নিরিখে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা রকমের অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে। দাড়ি রাখা-না-রাখা নিয়ে ভূগোলভেদে ধর্মীয় ভাববোধেও পার্থক্য তৈরি হয়। দেখা যাক তাহলে তা কী রকমের:

মিশরের ব্রাদারহুড-এর নেতা হাসান আল-বান্নার দাড়ি শুধু গালেই জড়িয়ে ছিল, প্রচারিত নানা ছবিতে তা-ই চোখে পড়ে। তা বুক পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল, এমন ছবি চোখে পড়ে না। সাইয়েদ কুতুব, ‘শহিদ’ বলে যাকে প্রায় সবাই অভিহিত করে থাকেন, তার ব্রাশকাটিং/ ফ্রেন্সকাটিং দাড়ির ছবি আছে। যেমন আছে শুধু হিটলারি গোঁফ সমেত ছবি। এ-বিষয়ে উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটির এক বাঙালি শিক্ষার্থীর স্মৃতিকথন উল্লেখ করার মতো।

সেই শিক্ষার্থী পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সাইয়েদ কুতুব সম্পর্কে অবগত হয়। সাইয়েদকে নিয়ে তখন আরব-বিশ্বের ধর্মীয় মহলে একেবারে তোলপাড় চলছে। তিনি তখন জীবিত। তার লিখিত যে বইগুলো বাজারে পাওয়া যায়, তাও কিনে পড়া হয়েছে। সাইয়েদ সম্পর্কে তার মনে অগাধ ভক্তি। হঠৎ শুনতে পায়, তারই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইয়েদের আগমন হবে। বাঙালি শিক্ষার্থী বেশ উদ্বুদ্ধ হয়। যাক, তাহলে চর্মচক্ষে একজন বিশিষ্ট আলেমে-দীন ও বুজুর্গকে দেখা যাবে! নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে সাইয়েদের আগমন ঘটে। কিন্তু তার মুখমণ্ডল দেখে সে হতাশ হয়। বাংলাদেশ বা ভারত উপমহাদেশের রীতি-মেতাবেক তার কোনো ধর্মীয় বেশভূষা নেই। না, এ জন্য সে শিক্ষার্থী অবশ্য তাকে ধর্মের আওতা থেকে খারিজ করে দেয় নি। ইসলামের দায়ী হিসাবে তাকে আজও গণ্য করে, শ্রদ্ধা করে। এ বাঙালি শিক্ষার্থীর আবার জীবনের শুরু থেকেই লম্বা দাড়ি!

এখানে সুদানি এক শায়খের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কুরআনের সাত কেরাতের ব্যাপারে তার প্রায় আঠার বছরের সাধনা। বাংলাদেশে তিনি কিছুদিন ছিলেন বিভিন্ন এনজিও কর্তৃক পরিচালিত নানা মাদরাসায়। তাকে মোটা অঙ্কের বেতনে এনজিও’র প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ দিতে চাইলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। যখন তাকে কুরআনের পাঠদান থেকে সম্পূর্ণভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তিনি দেশত্যাগ করেন। তিনি আবার মিশরের কারী আবদুল বাসেতের ভক্ত। সেই সুদানি কিছুটা বাংলাও বলতে পারতেন, ইংলিশ তো অবশ্যই। একবার তিনি ঢাকার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় একা-একাই যাচ্ছেন। গাড়িতে বাংলাদেশি এক ভদ্রলোক তাকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেন। এক পর্যায়ে আবদুল বাসেতের কথা আসে। ঐ বাংলাদেশি লোক আবার কারী আবদুল বাসেতের ভক্ত। সুদানি শায়খ বলেন, তার কাছে কারী সাহেবের ছবি আছে। বাংলাদেশির এ বিষয়ে বেশ কৌতূহলী। কিন্তু ছবি দেখে তিনি বেশ মর্মাহত হন! তার মন্তব্য, “তাহলে তার দাড়ি ছিল না? এ আবার কেমন কারী!” এ গল্পশেষে সুদানি শায়খর মন্তব্য করেন, “সারা জীবনের কুরআনের খেদমত তোমাদের দেশে দাড়ির জন্য শূন্য হয়ে গেল!” সুদানি শাইখের আবার লম্বা দাড়ি!

তিউনিসিয়ায় এখন ‘ইসলামি দল’ ক্ষমতায়। প্রচ্যে-প্রতীচ্যের সকল মিডিয়ায় এভাবেই বলা হয়। কিন্তু সেই ‘ইসলামি পার্টি’র প্রধান রাশেদ গান্নুশির দাড়ি তো কদম ফুলের রোঁয়ার মতো একেবারে ছোট ছোট। জানা যায়, ধর্ম সম্পর্কে তার জানাশোনা ব্যাপক। চমৎকার, চমৎকার বই লিখেছেন তিনি, যা পড়ে ইসলামের দুশমনরাও কুপোকাত! তার অন্যান্য অনুসারীদের কথা এখানে নাই-বা বলা হল। কিন্তু ইসলামের জন্য তাদের কুরবানির আলেখ্য, ইসলামের কথিত শত্রু পশ্চিমা মিডিয়ায়ও প্রচারিত। এই কুরবানির তীব্রতম সময়টি প্রায় দুই-যুগের সমান।

বাংলাদেশি বা পশ্চিমা মিডিয়ায় কামাল আতাতুর্কের দেশ তুরস্কের ব্যাপারেও বলা হয়ে থাকে, সেখানে ‘ইসলামি ভাবাপন্ন দল’ ক্ষমতায়। তাদের কেরদানি আছে বেশ। তিনতিন বার লাগাতার নির্বাচিত হয়ে ইউরোপে এবং ইসলাম-চর্চিত দেশসমূহে বিষ্ময়ের সৃষ্টি করেছে। তাদের প্রেসিডেন্ট এরদোগান তো মনে হয় সকাল-সন্ধ্যায় দুবার দাড়ি চাঁছেন। তা না হলে তার ছবিতে এতো মসৃণতা চোখে পড়ার কথা না। তার দলের অন্যান্য নেতাদের মুখেও এর কোনো পরশ চোখে পড়ে নি। তারপরেও কেন এদেরকে ইসলামি দলের আওতাভুক্ত করা করা হয়, সে এক প্রশ্ন বটে!

তবে ইন্দোনেশিয়া, চিন এবং থাইল্যান্ডের মুসলিমদের মনে হয় দাড়িই ওঠে না। ওদের কারো মুখেই এর কোনো চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় না। ধর্মীয় পণ্ডিত (আলেম-ওলামা)-দের শীর্ষ সংগঠন ‘নাহদাতুল উলামা’র সদস্যদের মুখেও তা নেই! সেদিক থেকে যারা দাড়ি রাখতে আগ্রহী, তারা এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত। আর যারা অনাগ্রহী, তারা প্রতিদিন ক্ষুর চালানোর কসরত থেকে মুক্ত।

আরববিশ্বে সফর-রত মাওলানা আবুল হাসান আলি নদভি যখন দাড়িহীন তরুণ-যুবাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে দেওবন্দি মাওলানা মানাজির আহসান গিলানিকে চিঠি লিখেন, তিনি অবাক হন। তাদের চেঠাচিঠির এক পর্যায়ে মাওলানা গিলানি স্বীকারও করেন যে, দাড়িহীনতার জন্য ধর্মবিষয়ে তাদের অবদান ও কুরবানি অবমূল্যায়ন করা উচিত হবে না।

জাহিদ আল-কাওসারি হানাফি মাজহাবের বিশিষ্ট আলেম। শুধু তাই নয়, লা-মাজহাবি উৎপাতের বিরুদ্ধে পরীক্ষিত শক্তিমান এক সেনাপতি। তার ব্যাপারে সালাফিদের বেশ আপত্তি আছে। কিন্তু মাজহাবি-ঘারানায় তার মজবুত অবস্থান। ইসলামি ফিকহে তার গভীর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ জীবনের অন্তিম সময়ে আল-আজহারে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তাকে। ঘটনাচক্রে তিনি যেতে পারেন নি। কিন্তু বক্তব্যের লিখিত রূপ তিনি আজহারে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে আজহারি ওলামাদের নানা উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, “যারা ধর্মের কারবারি, দাড়ি সম্পর্কে তাদের অবহেলা বেমানান।” এই কি তাহলে শেষ! আর যারা সরাসরি গরু-ছাগল ও জমিজমার করবারি, তাদের বুঝি তা বেমানান দেখায় না? সেটা তার সেই লেখায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশি এক শাইখুল হাদিসের একটি কাহিনি আছে, তা এখানে উল্লেখ করছি এবং অবশ্যই উপসংহার হিসাবে।

এ শাইখুল এখনো জীবিত। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। বাঙালি প্রবণতার নানা বিতর্কের স্রোত থেকে এখনো নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রতি বছর সম্ভব হলে হজ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে তার গুণমুগ্ধ লোকজনও আছেন। তার মুখের বর্ণনায় ঘটনাটি হল: একবার হজ করতে গিয়ে জান্নাতুল বাকিতে দাঁড়িয়ে তিনি দোয়া করছেন। কাছেই, তার শরীর ঘেঁষে, দেখতে পান জুব্বা পরিহিত এক ব্যক্তি তার চেয়েও সুন্দর করে দোয়া করছেন। প্রথমে রাসুল সা.-এর নাম ধরে, তারপর চার খলিফার নাম ধরে, তারপরে আশারায়ে মুবাশ্শারার নাম ধরে, তার পরে বদরি সাহাবা সকলের নাম ধরে তাদের পূণ্যের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন। আরো যে-সমস্ত সাহাবা সম্পর্কে বেহেশতের সুসংবাদ আছে, তাদের নামও নিচ্ছেন, আর কাঁদছেন। দোয়ার এই প্রকৃতিটা বাঙালি শাইখুল হাদিসের ভাল লেগে যায়। তিনি নিজ দোয়া ত্যাগ করে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আমিন আমিন বলতে থাকেন। দোয়া শেষ হলে তিনি চলে আসেন। পরে দু-বার হজে গিয়েও তিনি কাকতালীয়ভাবে সেই জুব্বা পরিহিত লোকের সাক্ষাত পান। তিনি ঠিক আগের মতোই বিনয়ের সঙ্গে সেই একই পদ্ধতিতে দোয়া করছেন, শাইখুল হাদিস পেছনে দাঁড়িয়ে আমিন আমিন বলছেন। শাইখুল হাদিসের মন্তব্য হল, এমন নিবেদিতপ্রাণ দোয়া তিনি আর দ্বিতীয়টি দেখেন নি। তৃতীয়বার বাঙালি শাইখ নিজের কৌতূহল সংবরণ করতে পারেন নি। তার পরিচয় জানার জন্য প্রশ্ন করে বসেন। উত্তরে যা বলেন, তার সারমর্ম হল: তিনি সামান্য কৃষকমাত্র। মিশরের বাসিন্দা। নাজাতপ্রাপ্তির লক্ষে তিনি প্রতিবছর হজ করার চেষ্টা করেন! কিন্তু সেই জুব্বাপরা লোকটির মুখে সামান্যতম দাড়ি নেই। একেবারে চাঁছাছোলা!
৪৫৬ বার পঠিত
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দৃষ্টি আকর্ষণঃ সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্লগ কমিউনিটি গঠনের আহ্বান।

লিখেছেন সামহোয়্যারইন ব্লগ টিম, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:২৫

সম্মানিত ব্লগারগণ,

আপনাদের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। সামহোয়্যারইন ব্লগ টিমের পক্ষ থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যা আমাদের এই কমিউনিটির পরিবেশকে আরও সুন্দর, সমৃদ্ধ এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধ’ তাহলে আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি আবারো প্রমাণ হলো!

লিখেছেন এ আর ১৫, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ ভোর ৫:৪১

মুক্তিযুদ্ধ’ তাহলে আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি আবারো প্রমাণ হলো!
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগ ব্যবসা করেছে মিথ্যা নয়। ডান/বামদের দাবী মুক্তিযুদ্ধের ‘আওয়ামী ন্যারিটিভ’ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের দলীয় ইতিহাস বানিয়ে ফেলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিরাট ব্যাপার-স্যাপার | রম্য =p~

লিখেছেন জটিল ভাই, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নিজের মোবাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাই সরাসরি দুইস্তর বিশিস্ট প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন: নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার

লিখেছেন বিদ্রোহী ভৃগু, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৪

ভূমিকাঃ

ছাত্র-জনতার সফল জুলাই বিপ্লবের পর আজ বাংলাদেশ গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন ও প্রকৃত উন্নয়নের এক নতুন পথে যাত্র শুরু করেছে। নোবেল লরিয়েট ড। ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সুপার সানডে : সংঘর্ষ ও নৈরাজ্যের পথে বাংলাদেশ!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪৭


আজকের দিনটি বাংলাদেশের সচেতন মানুষের দীর্ঘদিন মনে থাকবে। এত সংঘর্ষ ও মারামারি অনেকদিন পর ঢাকাবাসী প্রত্যক্ষ করলো। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মানুষ আগে থেকেই উদ্বিগ্ন তার উপর বিভিন্ন অবরোধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×