রাজনীতির মাঠে এখন যে খেলা চরমে পৌঁছেছে, তা অসাধারণ। বাংলাদেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ সর্বদিক থেকেই এগিয়ে। দেশের অভ্যন্তরে তাদের অবস্থান স্থূল রকমের নেতিবাচক হলেও, ভবিষ্যতকে শঙ্কিত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় নি। কারণ, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ‘এখন-তখন’ অবস্থা শুরু হয়ে গেছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আরো কয়েকবার জেলে ঢুকালেও বিএনপির কিছুই করার থাকবে না, এমন কি বিএনপির সভানেত্রী খালেদাকে জেলে পুরলেও তেমন শঙ্কটজনক কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। যে-ভাবেই হোক, দেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ প্রশাসন, রাজনীতির মাঠ, মিডিয়াজগত, সাংস্কৃতিক জগত সবই দখল করে আছে। একে জবর দখল বললে ভুল হবে। আওয়ামী লীগের গুণের বা আদর্শের কারণেই এগুলো তাদের কব্জায় থাকে। এসব জগৎ সবসময় আওয়ামী লীগের শুভার্থী হতেই পছন্দ করে।
দেশের বাইরেও আওয়ামী লীগের অবস্থান মোটামুটি ভাল। দেশের বাইরের অবস্থান ধরে রাখার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোনো কৃতিত্ব না থাকলেও এর মূল ফলটা তাদের ঘরেই যাচ্ছে, যাবেও। ড. ইউনুসকে নিয়ে যে খেলা বা প্রেমের খেলা আমেরিকা খেলতে চেয়েছিল, তা সফল হয় নি। আর হবেও না। এতে অবশ্য ব্যক্তি ইউনুসের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগেরও কোনো ক্ষতি হবে না। আর তাই আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ব্যাপারে ন্যূনতম ছাড় দিতে অসম্মত।
প্রশ্ন হল, বিএনপি এখন যে অবস্থায় উপনীত, তাতে শেষ পর্যন্ত এর অস্তিত্ব থাকবে তো? এ প্রশ্নের প্রধান কারণ বিএনপির ভেতরকার অগোছালো অবস্থা। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের সকল দেশেই রাজনীতি নামক ব্যবসাটা চলে স্বার্থের অনুপাতে। এটা এদেশের আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। দেশের জন্য, মানুষের জন্য এবং আদর্শের লক্ষ্যে এখন কারোই রাজনীতি নেই, শুধুই নিজের আখের গোছানোই মূল উদ্দেশ্য। এ উচ্চাভিলাষ নিয়েই এ ব্যবসায় নিয়োজিত হয় সবাই। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্লাস-পয়েন্ট হল তুলনামূলকভাবে দলে দালালের সংখ্যা কম, দলছুটের সংখ্যা অনুল্লেখ্য। অথচ বিএনপিতে আবার দালালের সংখ্যা প্রচুর, দলছুটের সংখ্যাও অগণিত। এক খালেদা ছাড়া আর এখন কে যে খাঁটি বিএনপি, তা বলা মুশকিল। এ জন্যই সরকার-বিরোধী আন্দোলনে দলটি সুবিধা করতে পারছে না। নিস্তেজ-নিরোত্তাপ আন্দোলন করতে করতে দলটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে!
সরকারের যে মতিগতি, তাতে স্পষ্ট, এরা নির্বাচনের আগে আর কোনো অন্দোলনের সুযোগ বা ছাড় দেবে না। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক জাতীয় কোনো সরকারও আর হচ্ছে না। যেহেতু আওয়ামী লীগের পাতানো বা সাজানো নির্বাচনই হবে, তখন বিএনপি হয়ত (নির্বাচনে গেলে বা ততদিন দলটি টিকে থাকলে) গুটিকয় আসনে জিতবে। কারণ দেশের বাইরে বৈধতার একটা প্রশ্ন আছে! আবার দালাল-মার্কা বিএনপি-জাতীয় কোনো ধামাধরা পার্টি গঠন করা গেলে তো কথাই নেই, আওয়ামী লীগের বিরোধী সাপও (?) মরবে অথচ লাঠিটা অক্ষত রবে। ততদিনে একমাত্র বিএনপির নিবেদিতপ্রাণ খালেদার জীবনপ্রদীপ নিবে আসবে হয়ত। তারেক-কোকো দেশের বাইরেই অবস্থান নিশ্চিত করে নেবে। কারণ, তাদের ব্যাপারে গোপন কী এমন অলঙ্ঘ্য চুক্তি হয়েছিল, যার কারণে তাদের দু-ভাইকেই ফখরুদ্দিনের আমলে দেশের বাইরে যেতে হল, তা এখনো অজানা। দেশের সাংবাদিকরাও এ ব্যাপারে কিছু বলছেন না। আর তাই এভাবেই বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু তারপর কী হবে? আওয়ামী লীগ থাকবে। একে বিলীন করার মতো আর কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। তখন প্রধান বিরোধী দল বা মোটামুটি দ্বিতীয় পর্যায়ের পার্টি হিসাবে কোনটি থাকবে? জাতীয় পার্টি? মনে হয় না। এরশাদের নেতিবাচক কৌশল, দীর্ঘদিনের ক্ষমতাহীনতা এবং পার্টির অভ্যন্তরীণ হাজার ভাঙন একে সে পর্যায়ে কখনো আর নেবে না। আসল কথা হল, তখন সর্বগ্রাসী আওয়ামী লীগ অন্য কোনো দলকে সামান্যতম সুযোগ দিতে প্রস্তুত থাকবে না। তাই বিএনপি বা জাতীয় পার্টি দাঁড়াবার সুযোগ পাবে না। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জামায়াতকে যতভাবেই নিপীড়ন করা হোক, ধর্মীয় নেশায় স্ব-নামে না হলেও বে-নামে বা ছদ্মনামে এদের রাজনীতি ও তৎপরতা থাকবে। আমার যে আশঙ্কা তা হল, তখন প্রধান বিরোধী দল হিসাবে জামায়াত বা জামায়াত-ঘরানার কোনো পার্টিই থাকবে! কিন্তু প্রশ্ন হল, এটা দেশের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে?
যে বন্ধু হতে পারে না, শত্র“ হবার মতো যোগ্যতা রাখে কি? শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার ধর্মকেন্দ্রিক কোনো ভড়ং নেই, মানে তাত্ত্বিক ভড়ং। সহজেই মানুষ তাই এদের পাল্টা ভেংচি দিতে পারে। কিন্তু ধর্মের আবরণে যে রাজনীতি তখন আসবে বা ধর্মীয় ফল্গুধারা নিয়ে যে রাজনীতি মাঠ গরম করবে, তাতে সাধারণ মানুষজনের শ্বাস ফেলার সুযোগ থাকবে তো? ‘ভিশন-২০২১’ হলেও শেখ হাসিনা যে-ভাবে বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছেন, তার পরবর্তী কেউ কি ততটা দক্ষতার সঙ্গে চালাতে সক্ষম হবেন বা যোগ্যতা রাখেন? তখন যদি বিকল্প হিসাবে জামায়াত বা জামায়াতি মানসিকতার কোনো দল ক্ষমতায় আসে, তখন কেমন হবে? না, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই জামায়াত-বিরোধী মানসিকতাও তখন কোন দিকে মোড় নেয়, তা বলা মুশকিল। আজকের মিশর বা তিউনিসিয়া তো তাই বলে! আর হ্যাঁ, এজন্যই বলছি, সুশীল সমাজের সকল সদস্য, মিডিয়া জগতের নানা ব্যক্তিত্ব তখন কীভাবে দিন যাপন করবেন? ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছি আর মনে মনে কামনা করছি, বিএনপিকে যত দ্রুত সম্ভব বিলীন করে দেওয়া হোক। আমিন।