কবি রুদ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সক্রিয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। ডাকসু'র ইলেকশান করে হেরে গিয়েছিলেন নিজেরই বন্ধুর কাছে। চূড়ান্ত বাউন্ডুলে এই কবির বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা তাঁর নিজেরও অজানা ছিল। তিনি ছিলেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। আর এই আন্দোলনের খাতিরেই তিনি গড়ে তোলেন 'সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট'। কবি এরশাদ ও তার ভাড়াটে কবিরা তাদের বাহাদুরি দেখাতে ঢাকায় যখন করেন 'এশীয় কবিতা উত্সব' তখন তার বিপরীতে রুদ্র দাঁড়িয়ে যান 'জাতীয় কবিতা উত্সব' নিয়ে।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ'র জন্ম তাঁর পিতার কর্মস্থল বরিশাল জেলায়। তাঁর মূল বাড়ি বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে। তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ৩৫ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং 'ভালো আছি ভালো থেকো' সহ অর্ধ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে তিনি এসএসসি পাশ করেন এবং ১৯৭৫ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাশ করেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দেশে যতোগুলো আন্দোলন হয়েছে তার সবগুলোতে কবি রুদ্র'র সশরীর অংশগ্রহণ ছিল। কবিতা, গল্প, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ, গান যেখানেই শিল্প সাহিত্য সেখানেই ছিলেন কবি রুদ্র। কণ্ঠে কবিতা আর রক্তে ছিল বিদ্রোহ। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই 'উপদ্রুত উপকূলে'। প্রথম বইয়ের 'বাতাসে লাশের গন্ধ' কবিতা সকলের মনোযোগ কেড়ে নেয়। সেই সঙ্গে শুরু হয় কবিশত্রু। রুদ্র'র দ্বিতীয় বই 'ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম' প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় 'মানুষের মানচিত্র' (১৯৮৪), 'ছোবল' (১৯৮৬), 'গল্প' (১৯৮৭), 'দিয়েছিলে সকল আকাশ' (১৯৮৮), 'মৌলিক মুখোশ' (১৯৯০)। মোট ৭টি কবিতার বই। এছাড়া প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ 'সোনালি শিশির'। আর আর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় নাট্যকাব্য 'বিষ বিরিক্ষের বীজ'।
'ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো'র মতো অসম্ভব সুন্দর আর জনপ্রিয় গান লিখেছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। 'অন্তর বাজাও' নামে একটি গানের দল গড়েছিলেন। এছাড়া শেষ জীবনে ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু তাঁর সবকিছু ঠেকিয়ে দিল। বড় ভীষণ এক খামখেয়ালীর জীবন ছিল তাঁর। পারিবারিক স্বচ্ছলতা থাকা স্বত্বেও সেপথে যাননি কবি। চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিজেকে বাঁধেননি কখনো। নিজের কয়েকটা রিক্সা ছিল, তা থেকে যা আয় হতো তাতেই বেশ চলতেন। এছাড়া ঠিকাদারী করেছেন। চিঙড়ির খামার করেছেন। আর দু'হাতে টাকা উড়িয়েছেন। পাঞ্জাবী আর জিন্সের যুগলবন্দী পোষাকে তখন বোধহয় তিনি একাই ছিলেন। পরে জেমস এটা জনপ্রিয় করেন। ঋত্বিক কুমার ঘটকের মতোই রুদ্র'র ছিল ভারী মদ্যপ্রীতি। প্রতিসন্ধ্যায় হাটখোলার নন্দের দোকানে হাজিরা দিতেই হতো তাঁকে। জল বিনা তাঁর যে চলে না দিন। হুইস্কির তিনি বাংলাকরণ করেছিলেন 'সোনালী শিশির'। এই নামে পরে একটা গল্পগ্রন্থও লিখেছিলেন। শেষদিকে কাগজে কলমে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে মানবধর্ম গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। উকিলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তার আগেই মৃত্যু তাঁকে ডেকে নিয়ে গেল গভীর এক ঘুমের দেশে।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তসলিমা নাসরিনকে। তখনো তসলিমা নাসরিন নামে খ্যাতি পাননি। সে বিয়ে অবশ্য ৫ বছরের বেশি টেকেনি। অবশ্য ৯০’র শেষদিকে তসলিমার সঙ্গে আবারো প্রেম শুরু হয়েছিল রুদ্র'র। কিন্তু সেটা ছিলো তসলিমার দ্বিতীয় বিবাহ থেকে তৃতীয় বিবাহে উত্তরণের মধ্যবর্তী সময়ে। ফলে সে প্রেমও টিকলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্যামা তরুণী শিমুলের সঙ্গে রুদ্র'র প্রেম হল। কিন্তু শিমুলের অভিভাবক রাজী হল না। সে সম্পর্কও চুকে বুকে গেল। সেই থেকে রুদ্র আরো বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে লাগলেন। ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যেতে লাগলেন। ক্ষয়ে যেতে লাগলেন। শেষ হতে লাগলেন। অতিরিক্ত অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার ফলে আলসারে পেয়ে বসেছিল তাঁকে। পায়ের আঙ্গুলে রোগ বাসা বেধেছিল। ডাক্তার বলেছিলো পা বাঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। তিনি পা ছেড়ে দিয়ে সিগারেট নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যার কারণে রুদ্র;র নতুন ঠিকানা হল হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ২৩১ নম্বর কেবিনে। ১৯৯১ সালের ২০ জুন ভালো হয়ে পশ্চিম রাজাবাজারের বাড়িতেও ফিরে গেলেন রুদ্র। কিন্তু ২১ জুন ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাংলা ভাষায় অসামান্য এই কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।
মাত্র ৩৫ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং ‘ভালো আছি ভালো থেকো’সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। মাটি ও মানুষের প্রতি আমূল দায়বদ্ধ এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাঁকে দিয়েছে সত্তর দশকের অন্যতম কবি-স্বীকৃতি। অকালপ্রয়াত এই কবি তাঁর কাব্যযাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’—এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি ততোধিক স্পর্ধায় তিনি উচ্চারণ করেছেন—‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাঁকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীকে'। একই সঙ্গে তাঁর কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা। অমর এই কবির কাব্য প্রতিভার কাছে আজ নতজানু হয়ে নতুন করে পড়া যেতে পারে চির সবুজের কবিতা – রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ'র কবিতা।
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম,
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে।
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক,
খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে।
ভালো আছি, ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি,
বাউলের এই মনটা রে।
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
বাতাসে লাশের গন্ধ
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর,
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম ?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?
জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।
বাতাশে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ-
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুণ্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমুতে পারিনা…
রক্তের কাফনে মোড়া– কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার – স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-
স্বাধীনতা– আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
কথা ছিলো সুবিনয়
কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত,
রাখালেরা পুনর্বার বাঁশিতে আঙুল রেখে
রাখালিয়া বাজাবে বিশদ।
কথা ছিলো বৃক্ষের সমাজে কেউ কাঠের বিপনি খুলে বোসবে না,
চিত্রার তরুণ হরিণেরা সহসাই হয়ে উঠবে না
রপ্তানিযোগ্য চামড়ার প্যাকেট।
কথা ছিলো , শিশু হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পদের নাম।
নদীর চুলের রেখা ধরে হেঁটে হেঁটে যাবে এক মগ্ন ভগীরথ,
কথা ছিলো, কথা ছিলো আঙুর ছোঁবো না কোনোদিন।
অথচ দ্রাক্ষার রসে নিমজ্জিত আজ দেখি আরশিমহল,
রাখালের হাত দুটি বড় বেশি শীর্ণ আর ক্ষীণ,
বাঁশি কেনা জানি তার কখনোই হয়ে উঠে নাই
কথা ছিলো, চিল-ডাকা নদীর কিনারে একদিন ফিরে যাবো।
একদিন বট বিরিক্ষির ছায়ার নিচে জড়ো হবে
সহজিয়া বাউলেরা,
তাদের মায়াবী আঙুরের টোকা ঢেউ তুলবে একতারায়-
একদিন সুবিনয় এসে জড়িয়ে ধরে বোলবে- উদ্ধার পেয়েছি।
কথা ছিলো, ভাষার কসম খেয়ে আমরা দাঁড়াবো ঘিরে
আমাদের মাতৃভূমি, জল, অরণ্য, জমিন, আমাদের
পাহাড় ও সমুদ্রের আদিগন্ত উপকূল-
আজন্ম এ-জলাভূমি খুঁজে পাবে প্রকৃত সীমানা তার।
কথা ছিলো, আর্য বা মোঘল নয়, এ-জমিন অনার্যের হবে।
অথচ এখনো আদিবাসী পিতাদের শৃঙ্খলিত জীবনের ধারাবাহিকতা
কৃষকের রন্ধ্রে রক্তে বুনে যায় বন্দিত্বের বীজ।
মাতৃভূমি-খন্ডিত দেহের পরে তার থাবা বসিয়েছে
আর্য বণিকের হাত।
আর কী অবাক! ইতিহাসে দেখি সব
লুটেরা দস্যুর জয়গানে ঠাঁসা,
প্রশস্তি, বহিরাগত তস্করের নামে নানারঙা পতাকা ওড়ায়।
কথা ছিলো ’আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন’,
আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ।
অথচ পাণ্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু
অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে।
জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি,
আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ:
কাব্যগ্রন্থ:
'উপদ্রুত উপকূল' (১৯৭৯)
'ফিরে পাই স্বর্ণগ্রাম' ১৯৮২
'মানুষের মানচিত্র' (১৯৮৪)
'ছোবল' (১৯৮৬)
'গল্প' (১৯৮৭)
'দিয়েছিলে সকল আকাশ' (১৯৮৮)
'মৌলিক মুখোশ' (১৯৯০)
ছোটগল্প:
'সোনালি শিশির'
নাট্যকাব্য:
'বিষ বিরিক্ষের বীজ'
পুরস্কার:
'মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার' (১৯৮০)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৩ বিকাল ৪:২৮