০১.
শেষবার যখন বাড়ি থেকে আসি, বাবা আমার হাতটি ধরে বলেছিলেন- দেখ্ বাবা, তুই বাড়ির বড়, আমার বয়েস হয়ে গেছে, অসুস্থ, কখন কী হয়ে যায়, তুই সবাইকে দেখে রাখিস। ভারী চশমার পুরু আতশ কাচের মধ্যে দিয়ে পঁচাশি-উর্ধ্ব বাবার ভেসে থাকা ঘোলা চোখ দুটোর আকুতি বুকের ভেতর খুব করে বাজলেও তখনও কি বুঝেছিলাম বাবার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা ? ডেবে যাওয়া চোঁয়াল আর ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকা তাঁর শরীর দেখে কে বলবে যে জীবন-বিলাসী এ মানুষটি এই সেদিনও ট্র্যাক-স্যুট আর ক্যাডস পরে টুপি মাথায় শহরময় দিব্যি প্রাতভ্রমন সেরে এসে ঘুম ভাঙাতেন বাড়ির সবার ! আজীবন দাপিয়ে বেড়ানো প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী যে মানুষটি শরীরে ঘাতক ক্যান্সার নিয়ে চুরাশি পেরিয়েও কাজকর্ম ছাড়া এক দণ্ড বসে থাকা কাকে বলে জানতেন না, সেই তিনিই কিনা এতো অসহায়ভাবে সংসারের কোনো কাজে না লাগা অথর্ব সন্তানটিকে সংসারের দায় বুঝিয়ে দেবার দুঃসহ কাজটি করে ফেললেন ! কোনো অব্যাখ্যাত কারণে তিনি কি সত্যিই বুঝে ফেলেছিলেন, এই অভাগা সন্তানটির সাথে আর কখনোই দেখা হবে না তাঁর ?
শেষবার যখন বাড়ি থেকে আসি, অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে, তখনো কি বার্ধক্যের ভারসাম্য রাখতে লাঠি ধরেছিলেন ? মনে পড়ে না। সম্ভবত কোন অবলম্বন আঁকড়ে ধরা বড়ই অপছন্দ ছিলো তাঁর। নিজস্ব পা দুটোর উপর আস্থায় এতোটাই অটল ছিলেন যে, দুর্বল শরীরটাকে কেউ ধরে ধরে কোথাও এগিয়ে দিতে চাইলেও নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিতেন, রূঢ়ভাবে। এমনকি তৃতীয়বারের ভারী অপারেশনপূর্ব প্রচণ্ড স্নায়ুচাপে বাদবাকী সবাই যখন অনিশ্চিত আশঙ্কায়-অস্থিরতায় ন্যুব্জপ্রায়, এমন অদম্য মনোবল নিয়ে সবার অলক্ষ্যে কখন কীভাবে যে ক্যাথেটারটি হাতে ঝুলিয়ে গটগট হেঁটে ওটিতে ঢুকে গিয়েছিলেন, তা ভাবতে গেলে এখনো চেতনা স্থবিঢ় হয়ে আসে ! তিনিই আমার বাবা । অথচ পঁচাশির প্রকৃত বয়েসটাকে ঠিকই বাড়াতে বাড়াতে পঁচানব্বই পার করে দিতে একটুও দ্বিধা হয়নি তাঁর। তা কি বার্ধক্যের বিভ্রান্তি, না কি শতায়ু হবার কল্প-বিলাস কে জানে ! আশার নাম মৃগতৃষ্ণিকা। আমরা যে সত্যিই তা উপভোগ করতাম তিনি হয়তো তা বুঝতেন না। আর আমরাও বুঝিনি, ডাল-পাতা শুকিয়ে গেলেও প্রাচীন বৃক্ষের বাৎসল্যের ছায়া কতোটা আশ্রয় আর অভয় দিয়ে জড়িয়ে রাখে সর্বক্ষণ। আকস্মিক সময়-ঝড়ে উপড়ে যাওয়া বটবৃক্ষের শূন্যতা আজ গভীর প্রলাপ হয়ে বুকের ভেতরে শুধু খুঁড়ে খুঁড়ে যায়। আহ্ জানিনা, অযোগ্য সন্তান হিসেবে কতোকাল এই অদৃশ্য যন্ত্রণা বয়ে যেতে হবে আমাকে !
০২.
হাতঘড়ির গোল ডায়ালের ছোট্ট চৌকোণা ঘরটাতে ক্যালেণ্ডার ডেটটা ধবধবে সাদা। মে মাসের ২৪ সংখ্যাটি সরে গেছে কখন, ২৫ তখনো পৌঁছায়নি এসে। আসি আসি করছে। আচমকা মোবাইলটা বেজে ওঠলো। বাড়ি থেকে ছোট ভাইয়ের ফোন- সেজদা, বাবা কথা বলতে পারছেন না আর, আপনাকে দেখতে চাচ্ছেন ! ফোনটা কানে ধরিয়ে দিচ্ছি, কখন আসছেন বলে দেন জোরে।
দড়াম করে বুকের ভেতরে কী যেন বাড়ি খেলো এসে ! একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। গত তিনমাস ধরে পুরোপুরি শয্যাশায়ী বাবাকে দেখবো দেখবো করতে করতেও বাড়ি না গিয়ে যে অমোচ্য অপরাধে অপরাধী হয়ে আছি, তার ভার যে হঠাৎ সমস্ত অজুহাতের উর্ধ্বে উঠে এমন অবহ হয়ে ঝাপিয়ে পড়বে, এর প্রায়শ্চিত্ত কী দিয়ে করবো আমি ! সবাইকে অবাক করে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বাবার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম- তুই আয় তুই আয়। আকস্মিক আর্তনাদে কেবল বলতে পারলাম- বাবা, আমি আসছি, কালই।
দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে ২৫ মে’র যে সকালটা এলো আমার জীবনে, তখনো তো বুঝতে পারি নি যে ১১ জৈষ্ঠ্যের নজরুল জয়ন্তির এই দিনটিই আমার চিরকালের কালো পর্দায় ঢেকে যাবে এভাবে ! সকালে অফিসে পৌঁছেই পরের দিন থেকে ছুটি মঞ্জুর করিয়ে ব্যাংকে ছুটলাম বেতনের টাকা তুলতে। সব প্রস্তুতি সেরে দুপুরেই আগেভাগে বেরোতে যাবো, সেই সর্বনেশে ফোটটি এলো দুটোয়, কনিষ্ঠ ভাইটির নম্বর থেকে। হ্যালো হ্যালো করছি, কোনো জবাব নেই। পৃথিবী জুড়ে শুধু তীব্র বিলাপের স্বর ! মোবাইল ফোনের অদৃশ্য সুড়ঙ্গ বেয়ে বুকভাঙা আর্তনাদে সবকিছু এলোমেলো তখন... !
০৩.
ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র সাত নম্বর বিপদ সংকেত মাথায় নিয়ে চেয়ারকোচ ‘শ্যামলী’ হু হু বাতাস কেটে ছুটে চলেছে সিলেটের দিকে। বুকের চরায় হিমবাহী পাথরটা অসম্ভব জড়তায় স্থির হয়ে আছে। আর এদিকে একটার পর একটা ম্যাসেজ আর রিংটোনে অস্থির হয়ে ওঠছে মোবাইলটা আমার। আশ্চর্য ! অনিচ্ছুক ভ্রান্তিগোলে কাউকেই জানানো হয়নি কিছুই। অথচ দেখা না দেখা, সচল অসচল, বন্ধু সহকর্মী সহযোদ্ধা আর পরিচিতজনের একের পর এক শোক, সাহস আর সান্ত্বনার বাণী অদ্ভুত সহমর্মিতায় কীভাবে যেন ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমাকে ! নুরুজ্জামান মানিক, ইশতিয়াক আহমেদ, প্রভাস দাস, মজিবুর রহমান, নজরুল ইসলাম, ইলতুৎ আলীদ, আহমেদুর রশীদ টুটুল, খালেদুর রহমান জুয়েল, অতন্দ্র প্রহরী, জগলুল হায়দার, গৌতম... আরো কতো কতো মুখ ! ইতোমধ্যেই নাকি নুরুজ্জামান মানিক ভাই সচলায়তনে শোক জানিয়ে অন্তর্জালিক পোস্ট ছেড়ে দিয়েছেন ! ওদিকে আরেকটা পোস্ট ইশতিয়াকের, সামহোয়ারইন-এ ! পৃথিবী জুড়া অসংখ্য ঋণের ভারে আবদ্ধ আমি জানি, বন্ধুত্বের যে অকৃত্রিম উষ্ণতায় পিতৃশোকের দুর্বহ ব্যথা গলিয়ে আমাকে চিরকৃতজ্ঞতায় ভাসিয়ে দিলো এরা, এ ঋণ আর শোধ হবার ! কখনোই শোধ হবার নয় ! অসম্ভব সে চেষ্টা কখনো করবোও না আমি।
প্রবল বৃষ্টি-ঝড়ের মুহুর্মুহু তাণ্ডবে ভেঙে পড়ছে প্রকৃতি। যেন সবকিছু একাকার হয়ে যাবে আজ ! আদৌ কি পৌঁছুতে পারবো ! ছোট ভাইয়ের ফোন আবার- সেজদা, কতোক্ষণ লাগবে আসতে ? আহা ! মানুষের জীবনটা কি সত্যিই এতোটাই ট্র্যাজিক ? নইলে ভাইয়ের এই প্রশ্নটা কেনই বা পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন আর ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিলো আমার কাছে ? এর উত্তর সত্যিই জানা ছিলো না আমার। কতোক্ষণ লাগবে, কতোক্ষণ লাগবে... মাথার ভেতরে হাতুরির আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছি শুধু... ! আশৈশব কত স্মৃতি কত স্বপ্ন কত কথা কত অভিমান আর অস্তিত্বের অপরিহার্যতায় মাখানো বাবার হাতটি ধরে জীবনের পয়তাল্লিশটি বছর নিমেষেই কেটে গেলো ! অথচ ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ, উপকূল ছেড়ে এসে আছড়ে পড়া ‘আইলা’র তীব্র ছোবলে সময়-ঘড়ির মাত্র আট ঘণ্টার রাস্তা এক জীবনে আর ফুরালো না আমার... ! সবকিছু ছেড়েছুড়ে এভাবেই চলে গেলেন বাবা। আমার জন্যে একটুকু অপেক্ষাও করতে পারলেন না ! পিতা হয়ে অধম এ সন্তানের সাথে এতোটা অভিমান করতে পারলেন তিনি ! আমারো তো অভিমান থাকতে পারে ! এই দুঃসহ অভিমান আমি কাকে দেখাবো আজ !!!
০৪.
বাবা আমাকে একটিবার দেখতে চেয়েছিলেন ! চিতার আগুনে পোড়া দেহভস্মও ধোয়ে গেছে তখন। ছাব্বিশ তারিখের রঙহীন বিমর্ষ এক ভাঙাচূরা সকাল বিষাদ-মর্মর সিঁড়িটার গোড়ায় এসে থেমে গেলো শেষে। আদরের ছোট্ট বোনটি আর্তচিৎকারে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে- সেজদাগো...বাবা তো আপনাকে না দেখে যেতে চান নি...শুধু এদিক-ওদিন খুঁজেছেন আপনাকে... কেন এতো দেরি করে ফেললেন...কেন... !
বারান্দায় সেই চেয়ারটি আর নেই। জায়গাটা আজ বীভৎস ফাঁকা ! পট্টবস্ত্র গায়ে উস্কুখুস্কু দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটির পাথর-চোখে এ কোন্ অবোধ্য আগুন্তুক অক্ষরগুলো ঝুলে আছে এলোমেলো, নির্মম ! বড় বেশি অচেনা এসব ! একে তো আর কখনোই অনুবাদ করা হবে না আমার ! যার কোনো অনুবাদ হয় না... কিছুতেই... কখনোই...।
[ইতিপূর্বে অন্য অন্তর্জালে প্রকাশিত]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০০৯ রাত ৩:০৩