একজন মুসলিম কি অমুসলিমের জন্য শান্তি চাইতে পারেন না !
একবার বয়োজ্যষ্ঠ হুজুরগোছের এক ব্যক্তিকে ‘স্লামালিকুম’ সম্ভাষণ করতে গিয়েই বিপত্তি বাঁধলো।
‘আস্ সালাম ওয়ালাইকুম...’। এর বাংলা তরজমাটা আমরা সবাই জানি- আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। কথাটার আক্ষরিক ও ভাবগত অর্থ এতো চমৎকার যে, ‘আদাব’ শব্দটিকে সে তুলনায় অর্থহীনই মনে হয়। যদিও ফারসি ‘আদাব’-কে আমি মোটেও ছোট করে দেখছি না, বরং এর সাথে আমাদের এই উপমহাদেশিয় সভ্যতার ইসলামী শাসন পর্বের রাজসিক সংস্কৃতির কৌলিন্য মিশে আছে। তবু আমি আদাব শব্দটিকে পারতপক্ষে ব্যবহার করিই না। সে তুলনায় চলমান অভ্যস্ততার কারণেই হয়তো ‘আস সালাম ওয়ালাইকুম’ বা এর গতিশীল অপভ্রংশ ‘স্লামালিকুম’ ব্যবহারে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যদিও বাংলার প্রতিই আমার পক্ষপাত সবচেয়ে বেশি। তবে আরবি কায়দায় বললে যেভাবে শান্তি বর্ষিত হয় সম্ভবত বাংলায় বললে বর্ষণটা সেভাবে হয় না।
চাকুরে হওয়ার সুবাদে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন কি ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়ে অবস্থানের বহু সুযোগ ঘটেছে আমার। ভৌগোলিক পরিবেশ ও জলবায়ুগত ভিন্নতা ছাড়াও শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মান আপেক্ষিক হওয়ার কারণে অঞ্চল ভেদে মানুষের চলন বলন চিন্তা চেতনায়ও যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। আর ধর্মীয় উপলব্ধিও যেহেতু এর সাথেই জড়িত, তাই এ ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বৈচিত্র্য দেখা যায়। কিন্তু ধর্মীয় গোড়ামীর ক্ষেত্রে শিক্ষিত অশিক্ষিত আবহাওয়া জলবায়ু নির্বিশেষে অভিন্ন মিলই চোখে পড়েছে বেশি। এর রেশ ধরেই শুরুতেই যে সালাম সম্ভাষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে অনেক বিপত্তির সম্মুখিন হতে হয়েছে আমাকে। শুধু কি জন্মসূত্রে অমুসলিম হওয়ার কারণেই ?
আমার পরিচয় আগে থেকে জানতেন বলেই হয়তো সেই হুজুর সুযোগে আমাকে ধর্মের কিছু জ্ঞান বিতরণ করে দিলেন। একজন মুসলমানই কেবল আরেকজন মুসলমানকে আরবিতে এভাবে সালাম জানানোর অধিকার রাখেন। কে জানে, হবে হয়তো। সীমা লঙ্ঘনের অনৈতিক পন্থায় নাই গেলাম। কিন্তু মনের মধ্যে খুতখুতে রেশটা রয়েই গেলো। আরেকদিন সেই হুজুরকে সামনে পেয়েই ডান হাত কপালের ডান পাশে ঠেকিয়ে সজোরে বললাম- ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ কিন্তু এবারে বিপত্তি বাঁধলো অন্যত্র। তিনি হয়তো ভাবলেন তাঁকে কটাক্ষ করা হয়েছে। যদিও এরকম কোন ইচ্ছা বা অভিরুচি ছিলো না। তারপরেও এতোবড়ো বাক্যটাকে সেরকমই মনে হলো। তিনি অনেকটা ক্ষুন্ন মনে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। হয়তো আমার সম্পর্কে তাঁর স্বনির্মিত ধারণাটাও আপেক্ষিকভাবেই সুখপ্রদ হয় নি।
কিন্তু আমার সমস্যাটা অন্যখানে। ভেতরের যুক্তিবোধ বলছে- পারস্পরিক শান্তি কামনা যদি শুধু মুসলিম-মুসলিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হতে হয়, তাহলে এর বিপরীতে একজন অমুসলিমের জন্য কি শান্তির বিপরীত কিছুই কামনা করা হবে ? ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখলে তাই তো মনে হয়। কেননা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই আমাদেরকে এটা মানতে হবে যে, প্রতিটা ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী বিশ্বাসী ব্যক্তি তার স্বধর্মকেই সঠিক মনে করেন এবং অন্য ধর্মকে বেঠিক বা ভুয়া ভাবেন। যুক্তিবাদী নাস্তিক্য দর্শনে বিশ্বাসীদের কথা বাদই দিলাম, একজন উদারমনা আস্তিকের মনে কি এ প্রশ্নটা আসে না যে, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা যদি একজনই হন তবে তাঁর অনুমোদনে পরস্পরবিরোধী এতগুলো ধর্মের সৃষ্টি কতোটা যুক্তিসঙ্গত ? অথবা তাঁর মহামহিম ক্ষমতা ও ইচ্ছার বাইরে অন্য কোন অননুমোদিত ধর্মের উৎপত্তি কী করে সম্ভব ? যদি বলা হয় একটা ধর্মের কার্যকারিতা হ্রাস বা বন্ধ করে পরবর্তী অগ্রবর্তী ধর্মের উৎপত্তি তাঁর ইচ্ছাতেই ঘটেছে, তা হলেও অনন্ত সময় বা কাল ও স্পেস প্রতীকী অর্থে যাঁর নখদর্পণে, এরকম সর্বব্যাপি সত্ত্বার আয়ত্তে সুষ্ঠু কোন পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় দূরদর্শিতার ভয়ঙ্কর ঘাটতি ও বৈপরিত্য কি আমাদেরকে প্রশ্নমুখি ও পীড়িত করে না ?
এই সব পরস্পরবিরোধী ধর্মের ভীড়ে আমি তো অমুসলিম হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষকেই সম্ভাষণ জানাতে উদ্যোগি হয়েছিলাম। ’নমস্কার’ শব্দটাও তো একটা ধর্মীয় পরিচয় বহন করে। মানুষের মধ্যে ভাব বিনিময়ে ভাষিক পরিচয়টাই তার প্রথম ও প্রধান পরিচিতি। সে ক্ষেত্রে আমি আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা তো ব্যবহার করতেই পারি। তাছাড়া কোনো ভাষা তো কোনো ধর্মের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। তথাকথিত ধর্মের সর্বগ্রাসী অপক্রিয়া কি আমাদের নিজস্ব অস্তিত্বকেও গ্রাস করে ফেলবে !
এই সব ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা কি মানুষের পরিচয়ে একজন মানুষের শান্তি কামনা করতে পারবো না !? #
একজন মুসলিম কি অমুসলিমের জন্য শান্তি চাইতে পারেন না !
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর


আলোচিত ব্লগ
শুধু হিংস্র, আগ্রাসী নয় ভারত লুটেরা, লোভী এবং সাম্রাজ্যবাদীও বটে.....
শুধু হিংস্র, আগ্রাসী নয় ভারত লুটেরা এবং লোভীও....
জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের হিংস্র ও আগ্রাসী। পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে চাওয়া এবং স্বাধীন থাকতে চাওয়া কিছু অঞ্চল যেমন হায়দ্রাবাদ, ত্রিবাংকুর, ভূপাল, যোধপুর, জুম্ম-কাশ্মীর,... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গলা-বুক জ্বালা দেখে অম্বলের ওষুধ দিয়েছিলেন চিকিৎসক, চ্যাটজিপিটি ধরল ক্যানসার
ক্যানসার ধরল চ্যাটজিপিটি! চিকিৎসকেরা ভুল ওষুধ দিয়েছিলেন। তাতে অবস্থা আরও খারাপ হয় মহিলার। চ্যাটজিপিটিই বলে দেয়, কী রোগ বাসা বেঁধেছে তলে তলে। চিকিৎসকেরা ধরতেই পারেননি। কিন্তু চ্যাটজিপিটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
২০০৮- ২০২৪, হাসিনা ভারতের জনম জনমের ঋণের কিছুটা শোধ করেছেন মাত্র
২০০৮- ২০২৪, হাসিনা ভারতের জনম জনমের ঋণের কিছুটা শোধ করেছেন মাত্র
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন
শিক্ষকদের দ্বৈত চরিত্র এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশা!
বাংলাদেশে শিক্ষার মান নিয়ে সবার মুখে নানা রকম কথা শোনা যায় । কেউ কেউ বলছেন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতি হচ্ছে , কেউ বলে দিন দিন তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। এপিআই প্ল্যান্ট
ওষুধে দুটো উপাদান থাকে। ওষুধের যে রাসায়নিক উপাদানটি মূলত রোগ সাড়ানোর কাজ করে, সেটিকে বলে এপিআই। দ্বিতীয় উপাদানটিকে সহকারি উপাদান বলে, যেমন— স্টার্চ, রং বা ফ্লেভার।
এপিআইয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন