# উল্টো-স্রোতের কুল-ঠিকানা: সর্বগ্রাসী অপ-‘বাদ’ বনাম একজন আরজ আলী ... [০২]
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
কে হবে প্রশ্নকর্তা?
দার্শনিক চিন্তাসূত্র অনুযায়ী জ্ঞান বা জিজ্ঞাসা বিবেচনায় জগতে চিন্তাশীল সত্ত্বা চার ধরনের হতে পারে-
(এক) যে জানে যে, সে সব জানে
(দুই) যে জানে যে, সে কিছুই জানে না
(তিন) যে জানে না যে, সে সব জানে
(চার) যে জানে না যে, সে কিছুই জানে না।
‘যে জানে যে, সে সব জানে’ এমন কাল্পনিক সত্ত্বার অস্তিত্ব আদৌ সম্ভব কি না, নিশ্চিতভাবেই তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। এই অসীম মহাবিশ্ব চরাচরে সংখ্যারহিত পরিমাণে বিশাল থেকে অতিক্ষুদ্র এই অনন্ত সংখ্যক বিষয়-বস্তু-ঘটনাপুঞ্জের সৃষ্টি-স্থিতি-ধ্বংশ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াজনিত কার্য-কারণের দৃশ্যমান-অদৃশ্য সম্ভব-অসম্ভব অনন্ত-অনাদি মহাসমীকরণের কল্পনারহিত প্রতিটি একক যুগ্ম গোষ্ঠী বা সামগ্রিক প্রেক্ষিতের প্রেক্ষাপট ধারণ করার মতো কাল্পনিক সত্ত্বার অস্তিত্ব কল্পনাতেও কি সম্ভব? জানার যেমন কোন সীমা নেই, তেমনি সীমাহীন জানার বিষয়টিও যৌক্তিক কারণেই যুক্তিহীন। তাই বলা যেতে পারে- যে জানে যে সে সব জানে, এমন সত্ত্বার অস্তিত্ব কেবল যুক্তিপরম্পরাহীন দার্শনিক কল্প-ধারণা মাত্র।
‘যে জানে যে, সে কিছুই জানে না’- দর্শনের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এটি। এ ক্ষেত্রে যাঁর কথা সর্বাগ্রে চলে আসে তিনি গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস (৪৭০-৩৯৯ খ্রি. পূ.)। সমগ্র দর্শনের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় ব্যক্তিই তিনি। জীবদ্দশায় একটি বাক্যও লেখেন নি । তারপরেও ইউরোপিয় চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে বড় প্রভাব আর কেউ ফেলতে পারেন নি।
‘আমি কেবল একটা কথাই জানি আর সেটা হলো আমি কিছুই জানি না’- নিজের স্বপক্ষে এ কথাটা বলেই তিনি শুধু প্রশ্ন করে যেতেন, বিশেষ কোনো একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে, যেন তিনি বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যাদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন তাদের তিনি এমন একটা ধারণা দিতেন যে আসলে তিনি তাদের কাছ থেকে শিখতে চাইছেন। প্রশ্নটাই ছিলো তাঁর যুক্তির ধারালো হাতিয়ার। এই হাতিয়ার দিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে তার যুক্তির দুর্বলতা বা অসারতা বুঝিয়ে দিতেন আর তখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায়।
প্রকৃতপক্ষে জানার স্বপক্ষে বাড়িয়ে দেয়া প্রতিটা কার্যকর ধাপে কৌতূহলী ব্যক্তি মূলত নিজের অজ্ঞানতাকেও আরেক ধাপ চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। অর্থাৎ নিত্য নতুন জানার মাধ্যমে নিজের অজ্ঞানতাই খুঁজে বেড়ান তাঁরা। এভাবে নতুন নতুন জ্ঞানে তাঁদের কৌতূহল আরো বেশি করে উৎসাহী হতে থাকে আরো নতুন নতুন জ্ঞানের দিকে। কেননা তিনিই জ্ঞানী যিনি তাঁর অজ্ঞানতাকে আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারই জ্ঞান। জানা-কে আবিষ্কার করেন যত, ততই না-জানা’র বিপুলতা সম্বন্ধে সচকিত ও বিহ্বল হয়ে ওঠেন তাঁরা। তাই, যে জানে যে সে কিছুই জানে না, সে-ই সবচেয়ে জ্ঞানী; জ্ঞান অন্বেষণে জানার অদম্য ইচ্ছাই তাঁকে নিরন্তর প্রশ্নমুখি করে তোলে।
প্রশ্নময় কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সক্রেটিস যে শুধু জ্ঞানী’র সংজ্ঞাটাই নির্ধারণ করে দেন তা-ই নয়, উল্টো, মূর্খামীর মুখোশটাও ছিঁড়ে ফেলেন একই যুক্তিতে- যে জানে না যে সে কিছুই জানে না। আমরা অধিকাংশই তো সেই মূর্খের দলে, যারা ভান করে যে তারা অনেক কিছুই জানে; অথচ নিজের কাণ্ডজ্ঞানটাও ব্যবহার করতে জানে না। তারা যে কিছুই জানে না, সেই বোধটাও তাদের নেই। অথচ দর্শনগত সত্যগুলো প্রত্যেকেই বুঝতে পারে স্রেফ যদি তারা তাদের সহজাত কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে যুক্তিবোধটাকে ব্যবহার করে। সহজাত যুক্তি ব্যবহার করার অর্থ হচ্ছে নিজের মনের গভীরে পৌঁছে সেখানে যা আছে তা ব্যবহার করা। নিজে অজ্ঞ সেজে সক্রেটিস লোকজনকে তাদের কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করতে বাধ্য করতেন। কিন্তু কুসংস্কারে ডুবে থাকা সমাজের ক্ষমতাসীন প্রাতিষ্ঠানিক মূর্খতা লোকজনের কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করার সুযোগ দেবে কেন? তাই আড়াই হাজার বছর আগের ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠান যেমন সক্রেটিসকে বাধ্য করেছিলো হেমলকের তীব্র বিষ পান করতে, তেমনি বহুকাল পরে এসেও আমাদের বরিশালের গণ্ডগ্রামে প্রশ্ন করতে জানা স্বশিক্ষিত এক কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকেও প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে এই তখত প্রতিষ্ঠানই ‘পবিত্র হাজতবাসে’ নিক্ষিপ্ত করে। এতে করে কি প্রশ্ন থেমে গেছে? প্রশ্নের প্রাকৃতিক শক্তিই প্রশ্নকে চিরকাল শক্তিশালী করে রাখে।
তৃতীয় পর্যায়ের যে দার্শনিক সত্ত্বা- যে জানে না যে সে সব জানে, এটাও হেঁয়ালিপূর্ণ একটা দার্শনিক বিভেদ মাত্র। যে জানে, অথচ এ বিষয়টাই সে জানে না- এরকম কাঁঠালের আমসত্বের স্বাদ কল্পনাতেই সম্ভব, বাস্তবে নয়।
অতএব, প্রাথমিকভাবে উপস্থাপিত দার্শনিক সত্ত্বার যে চারটি ধারণা উপস্থাপিত হয়েছে, যুক্তি পরম্পরায় এসে চূড়ান্ত ফলাফলে দাঁড়ায়-
এক) যে জানে যে, সে সব জানে > একটা অসম্ভব কল্পনা বা কাল্পনিক অস্তিত্ব
দুই) যে জানে যে, সে কিছুই জানে না > জ্ঞানীর বিজ্ঞতা
তিন) যে জানে না যে, সে সব জানে > অবাস্তব
চার) যে জানে না যে, সে কিছুই জানে না > মূর্খের অজ্ঞতা।
অর্থাৎ এই সৃষ্টিজগতে দু’টো সত্ত্বাই কেবল ক্রিয়াশীল। জ্ঞানী আর মূর্খ। জ্ঞানী মাত্রেই তাঁর মধ্যে একটা বিস্ময়বোধসম্পন্ন দার্শনিক সত্ত্বা ক্রিয়াশীল থাকবে। কার্যকারণ ভিত্তিক যুক্তির তীব্র রশ্মি দিয়ে সব কিছুকেই প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণে উদ্যোগি থাকেন এঁরা; ন্যায় ও অন্যায়কে পার্থক্য করেন। আর যারা কাণ্ডজ্ঞানহীন অজ্ঞান বা মূর্খ, তাদের দুর্ভাগ্য যে, তারা এটাও জানে না যে তারা মূর্খ! ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করবে কোত্থেকে!
চলবে.....
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ভিসা বন্ধ করায় ভারতকে ধন্যবাদ।
ভারত ইদানীং ভিসা দিচ্ছেনা; তারা ভিসা না দিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়! তাদের করদ রাজ্য হাতছাড় হওয়া খুবই নাখোশ, এতোই নাখোশ যে মোদী মিডিয়া দিনরাত বয়ান দিচ্ছে এই দেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতের চিকিৎসা বয়কট এবং
ভারতের এক হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কোন রুগিকে তারা চিকিৎসা দিবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে হাসপাতাল থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ
চামচা পুঁজিবাদ থেকে দেশ চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র করেছে।
সোমবার... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে তবে............
শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বিচারের জন্য ভারতের কাছে ফেরত চাইতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে প্রতিহিংসামূলক বিচারপদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিচারে শেখ হাসিনা যাতে ন্যায় বিচার পান বাংলাদেশকে আগে তা নিশ্চয়তা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারত সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে
শেখ হাসিনা ভারতে বসে ষড়যন্ত্র-অপপ্রচার করছেন। ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশে একটি অশান্তি হোক। কারণ ভারত একটি মসনদ হারিয়েছে। সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রতিদিন একটি সোনার ডিম পেড়ে নরেন্দ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন