দার্শনিক, না শিশু?
শুকা চতুর্দশীর চাঁদটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ছোট্ট শিশুটি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো- চাঁদটা গোল কেন? আমরা যারা ইতোমধ্যে বড় হয়ে গেছি, প্রশ্ন শুনেই নড়েচড়ে ওঠি। তখন আর ঠিক মনে করতে পারি না- আমরাও কি এমন প্রশ্ন করেছিলাম শৈশবে? সৃষ্টির শুরুতে একান্ত তরল প্রকৃতির মহাজাগতিক একটা বস্তুপিণ্ডের তীব্রগতির ঘুর্ণায়মান অবস্থায় মহাকর্ষের কেন্দ্রাভিগ আর কেন্দ্রাতিগ বলের সম্মিলিত প্রভাবের সাথে অন্যান্য অনুঘটক মিশে বস্তুর আকৃতি প্রকৃতই গোল হয়ে যাবার ধারণাটা যারা প্রশ্ন খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেছেন তাদের কথা আলাদা। একটা শিশুর পক্ষে তা বুঝার বা তাকে বুঝানোর প্রেক্ষিতও এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বটা অন্যত্র। আমরা যারা এই চাঁদটাকে গোল দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, পূর্ণিমার চাঁদ তো গোলই। এখানে বিস্ময়ের কী আছে! বিস্ময়ের কিছুই খুঁজে পাই না আমরা। তাই চাঁদ কেন গোল, এটাও যে একটা কৌতূহলী প্রশ্ন হতে পারে সেই বোধটাই মরে গেছে আমাদের। এমন হাজারো লক্ষ অভ্যস্ততার মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে বিস্ময়হীন কৌতূহলহীন এই আমরা আসলে এক প্রশ্নহীন অন্ধধারণার বশংবদ প্রাণীই এখন; জিজ্ঞাসু মানুষ নই; দার্শনিক তো দূরের কথা। ব্যাখ্যাহীন পূর্ব-সংস্কারের গড্ডালিকায় নিমজ্জিত আমাদের সুসভ্য চেহারার ভেতরে অন্তর্গত উপলব্ধিটা যে কতো অন্ধকার কালোয় ডুবে আছে, সেই বোধটুকুও হারিয়ে বসে আছি অধিকাংশেই। এর ফল যা হবার তাই হয়েছে- কোন অনাচারেই আর আশ্চর্য হই না আমরা। অলৌকিক নামে লৌকিক কৌশলজাত কিছু মিথ্যাচার, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং চিরাচরিত প্রথার কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্য দিয়ে খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি আর ফলন বাড়াচ্ছি এক অথর্ব প্রজাতির। অথচ একটু কাণ্ডজ্ঞান খরচ করলেই প্রত্যেকটা মানুষই হতে পারতো একেক জন সম্ভাব্য লোক-দার্শনিক। কীভাবে?
‘ভালো দার্শনিক হওয়ার জন্যে একমাত্র যে-জিনিসটি আমাদের প্রয়োজন তা হলো বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা।
শিশুদের এই ক্ষমতাটি আছে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাতৃগর্ভে অল্প কটা মাস কাটিয়ে তারা একেবারে নতুন এক বাস্তবতার মধ্যে এসে পড়ে। কিন্তু তারা যখন বড় হয় তখন এই বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাটি যেন নষ্ট হয়ে যায়। কেন এমনটা হয়?...
একটি সদ্যোজাত শিশু যদি কথা বলতে পারত তাহলে হয়ত যে অসাধারণ বিশ্বে সে এসে পড়েছে সেই বিশ্ব সম্পর্কে কিছু কথা জানাতে পারত। কীভাবে সে চারদিকে তাকায় আর যা কিছু দেখে সেদিকেই কীভাবে কৌতূহলের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দেয় সে, তা তো আমরা প্রায়ই দেখে থাকি।...
কিন্তু শিশুটি ভালো করে কথা শেখার অনেক আগেই এবং দার্শনিকভাবে চিন্তা করতে শেখার অনেক আগেই পৃথিবীটা একটা অভ্যাসে পরিণত হবে তার।...
ব্যাপারটা রীতিমত দুঃখজনক... পৃথিবীর ব্যাপারে অতি অভ্যস্ততার কারণে এর সঠিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে যারা অক্ষম হয়ে পড়ে...
মনে হয় যেন বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি চলার সময় আমরা বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাটি হারিয়ে ফেলি। আর তাতে করে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু হারিয়ে ফেলি- আর সেই হারিয়ে ফেলা জিনিসটিই ফের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন দার্শনিকেরা। কারণ, আমাদের ভেতরে কোথাও থেকে কিছু একটা বলে ওঠে যে, জীবন এক বিশাল রহস্য। আর ঠিক এই ব্যাপারটিই আমরা উপলব্ধি করেছিলাম অনেক আগে, যখন এই কথাটি আমরা ভাবতে শিখিনি।
আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে: দার্শনিক প্রশ্নগুলো আমাদের সবাইকেই ভাবিত করলেও আমরা সবাই কিন্তু দার্শনিক হই না। নানান কারণে বেশিরভাগ লোকই প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে এমনই বাঁধা পড়ে যায় যে বিশ্ব সম্পর্কে তাদের বিস্ময় এসবের আড়ালে চলে যায়।
বাচ্চাদের কাছে এই বিশ্ব আর তার সমস্ত কিছুই নতুন; এমন একটা কিছু যা দেখে বিস্ময় জাগে। বড়োদের কাছে ব্যাপারটা সে-রকম নয়। বিশ্বটাকে বড়োরা একটা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নেয়।
ঠিক এই জায়গাটাতেই দার্শনিকেরা এক বিরাট ব্যতিক্রম। একজন দার্শনিক কখনোই এই বিশ্বের ব্যাপারে ঠিক পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েন না। তিনি পুরুষ বা নারী যা-ই হোন না কেন, তাঁর কাছে বিশ্বটা খানিকটা অযৌক্তিক বলে ঠেকতে থাকে- মনে হতে থাকে হতবুদ্ধিকর, এমনকী হেঁয়ালিভরা। দার্শনিক আর ছোট্ট শিশুদের মধ্যে তাই একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় খুব মিল। সারা জীবন একজন দার্শনিক একটা শিশুর মতোই স্পর্শকাতর রয়ে যান।’
(সোফির জগৎ / ইয়স্তেন গার্ডার / অনুবাদ: জী এইচ হাবীব)
তাই দর্শন সম্ভবত শেখার কোন বিষয় নয়; বরং দার্শনিকভাবে চিন্তা করাটাই শেখার বিষয় হতে পারে।
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০০৮ রাত ১১:৩৫