রোদ, বৃষ্টি, মেঘ ও একটি তুষারকন্যার গল্প - ১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
রোদ, বৃষ্টি, মেঘ ও একটি তুষারকন্যার গল্প - ১
--------------------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ
আটই মার্চ, বিশ্ব নারী দিবস। এদেশে এই দিনটি ঘটা করে পালন করা হয়। থাকে সরকারী ছুটি। ইউক্রেনের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এটা বসন্ত কাল। পহেলা মার্চ থেকেই বসন্ত শুরু হয়। তবে ক্যালেন্ডার বলে এক কথা, আর বাস্তব বলে আরেক কথা। যেখানে সমীরণের উষ্ণতা নেই, ফুলের সমারোহ নেই, নেই কোকিলের ডাক তাকে কি বসন্ত কাল বলা যায়? বরং এই সব কিছুর বদলে গত কয়েকদিন যাবত যা হয়েছে তা হলো অবিরাম তুষারপাত। আর তার ফল হিসাবে খারকভ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় আর তার অনতিদূরে অবস্থিত আতাকারা ইয়ারোশা স্টুডেন্টস টাউন যোজনব্যাপী তুষারশুভ্রতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পপলার তরুবিথীতে ছাওয়া সেই তুষার ঝরা পথ দিয়ে হাতে একতোড়া টিউলিপ ফুল নিয়ে চুপচাপ হেটে যাচ্ছে একটি মেয়ে। শুভ্র ফারকোট গায়ে ওর নীরবে পথ চলা দেখে যে কারোরই মনে হবে, একটি তুষার কন্যা হেটে যাচ্ছে যেন। রাস্তার এপাশ থেকে একটু মনযোগ দিয়ে দেখে বুঝলাম, ওকে আমি চিনি। মেয়েটির নাম লেনা। আমার সাথেই পড়ে। গত ছয়মাস যাবৎ দেখছি ওর আস্চর্য্য নীল চোখের অদ্ভুত প্রশান্তি। মেয়েটিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। তবে তাকে তা জানানো হয়নি, নিজের কথা নিজের মনের রেখেছি। আর মনে মনে ওর নাম দিয়েছি তুষারকন্যা।
পূর্ব ইউরোপের একটি ছিমছাম দেশ ইউক্রেন। অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই দেশটিতে এসেছি সাত মাস হয়। এখানকার প্রকৃতি বাংলাদেশের সাথে তুলনীয় হবে এমন কথা বলা যাবেনা। বরং একেবারেই ভিন্ন ধরনের। তবে প্রকৃতি এখানে যে সৌন্দর্য্য নিয়ে আছে তার রূপও কম নয়। আামাদের রুশ ভাষার শিক্ষিকা লুবোভ আলেক্সিয়েভনাকে, একবার বলেছিলাম একথা। তিনি খুব সুন্দর উত্তর দিলেন, "প্রকৃতি এখানে হয়তো সুন্দর কিন্তু তার চাইতেও সঠিক বলা হবে যদি বলি আপনার দৃষ্টি সুন্দর। ঐ সুন্দর দৃষ্টি দিয়েই আপনি চারপাশের জগৎটাকে সুন্দর দেখছেন।" বাহ্ সাহিত্যের শিক্ষিকার কি চমৎকার বর্ননা। তারপর তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, "তুষার, আপনি এদেশে কয়েক মাস যাবৎ আছেন, আপনার কি এখানে কোন মেয়েকে ভালো লেগেছে?" এরকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন, সরাসরি করতে দেখে আমি কিছুটা বিব্রত হলাম। তিনি আমার মনের কথাস বুঝতে পারলেন। তারপর আমাকে বললেন, "আমি জানি তোমরা বাংলাদেশীরা এই ধরনের প্রশ্নে লজ্জা পাও, বিব্রত হও।" আমি একটু অবাক হয়ে উনাকে প্রশ্ন করলাম, "আপনি জানলেন কি করে?"
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ কি আশ্চর্য্য! আমি আপনার প্রায় মায়ের বয়সী। আমি তো আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ক্লাস নিচ্ছিনা। আমার বহু বছরের অভিজ্ঞতা। কত দেশের ছেলেমেয়েদেরই তো পড়িয়েছি।
আমিঃ থাক আর বলতে হবেনা, আমি বুঝতে পেরেছি?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আপনার চোখ বলছে, কোন একটি মেয়ের চোখ আপনার চোখের সরোবরে তলিয়ে গেছে।
আমিঃ না, মানে।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আমি কি ঠিক ধরেছি?
আমিঃ সাহিত্যের পাশাপাশি আপনি কি কিছু কিছু সাইকোলজিও জানেন?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ তা জানি। তবে সাইকোলজি পড়ে নয়।
আমিঃ তাহলে কি করে জানলেন?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ঐ যে বললাম, আমার অনেক বছরের অভিজ্ঞতা। যেটুকু মনোবিদ্যা শিখেছি তা জীবন থেকে শিখেছি।
আমিঃ আসলে আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না। মেয়েটিকে আমার ভালো লাগে। কিন্তু এটা সত্যিই ভালো লাগা কি না?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ মেয়েটি কি সুন্দরী?
আমিঃ হ্যাঁ, খুব, খুউব সুন্দরী। জানেন ........ (হরহর করে অনেক কথা বলতে গিয়ে সংযত হয়ে গেলাম)
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আসলে কি জানেন? ঐ মেয়েটি যেমনই হোক না কেন, আপনার চোখে সে ভীষণ সুন্দরী। ঐ যে বললাম বস্তু যতনা সুন্দর আপনার দৃষ্টি তার চাইতেও বেশী সুন্দর।
বুঝলাম উনি কি বলতে চাইছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা আছে,
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে ।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পূবে পশ্চিমে ।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম সুন্দর,
সুন্দর হল সে।
লেনাকে আমি প্রথম দেখেছি গত বছরের অক্টোবর মাসে। এদেশে যত সমস্যাই হোক না কেন। প্রকৃতি যতই বিরূপ হোক না কেন। রাজনীতির আকাশে যতই কালো মেঘ আনাগোনা করুক না কেন, যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই হোক না কেন, এ্যাকাডেমিক ইয়ারের ক্লাস ঠিকই পহেলা সেপ্টেম্বরে শুরু হবে। তাই যথা নিয়মে পহেলা সেপ্টেম্বরে গেলাম ইউনিভার্সিটিতে। আমাকে বলা হয়েছিলো বেলা দশটায় ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়ামে একটা নবীন বরণ অনুষ্ঠান হবে। অডিটোরিয়াম খুঁজতে গিয়ে আমি খারকোভ স্টেট ইউনিভার্সিটির বিশাল অট্টালিকায় নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। তখন রুশ ভাষাও অত ভালো রপ্ত করতে পারিনি। মাত্র এক বছরের ল্যংগুয়েজ কোর্সে একটা ভিনদেশী ভাষা রপ্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়। বহু কষ্টে এর-ওর কাছে জিজ্ঞেস করে তিনতলায় খুঁজে পেলাম বিশাল অডিটোরিয়ামটি। ভিতরে ঢুকে দেখলাম রাজকীয় অনুষ্ঠান। অপেরা টাইপের নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে। নতুন ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপকদের উপস্থিতিতে বেশ সুন্দর একটি নবীন বরণ হলো। এতো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেশে কখনো দেখিনি। নিজেকে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। নবীন বরণ অনুষ্ঠানে সব ফ্যাকাল্টির ছাত্র-ছাত্রীরাই উপস্থিত ছিলো। এরপর কেবল আমাদের ফ্যাকাল্টির ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা একটা মিটিং হলো। সেখানে ডীন কিছু বললেন। অন্যান্য অধ্যাপকরাও কিছু বললেন। এতো চোস্ত রুশ ভাষার সবটা ধরতে পারলাম না। তবে মনে হলো তিনি ইউক্রেণীয় ছাত্র-ছাত্রীদের পৃথকভাবে কিছু বলছিলেন।
পরদিন রুটিন অনুযায়ী যথাসময়ে ক্লাসে উপস্থিত হলাম। ক্লাসে ঢুকে আমিতো হতবাক। এতো কম স্টুডেন্ট কেনো? তাছাড়া যারা ক্লাসে আছে সবাই বিদেশী। প্রথম ক্লাসটি ছিলো ক্লাসিকাল মেকানিক্স-এর উপর। তামারা নিকোলায়েভনা নামে একজন বয়স্ক অধ্যাপিকা ক্লাস নিচ্ছিলেন। পরে জেনেছিলাম উনাকে সবাই দাদী তামারা বলে। এই ক্লাস শেষ হওয়ার পর ছিলো রুশ ভাষার ক্লাস। শুধু বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীরাই এই ক্লাসটি করে। সেখানেই প্রথম রুশ সাহিত্যের শিক্ষিকা লুবোভ আলেক্সিয়েভনার সাথে পরিচয় হয়। তিনি খুব সুন্দর করে আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। চোস্ত রুশ নয় বরং খুব সহজ সহজ শব্দ ব্যবহার করে আমাদের বোধগম্য করে সব কথা বলছিলেন। উনার কাছে জানতে চাইলাম, আজ সকালের মেকানিক্স ক্লাসে ইউক্রেণীয় ছাত্র-ছাত্রীরা অনুপস্থিত ছিলো কেন?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ জানেন না? ইউক্রেণীয় ছাত্র-ছাত্রীরাতো একমাস অনুপস্থিত থাকবে।
আমিঃ কেন?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আমাদের এখানে নিয়ম আছে। ক্ষেতে ফসল ওঠার পর, ছাত্র-ছাত্রীরা সেই ফসল তুলতে যায়।
আমিঃ ফসল তো তুলবে কৃষকরা।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ সে আপনাদের দেশে হয়। আমাদের দেশে না।
আমিঃ বুঝলাম না, কৃষকের কাজ কৃষক করবে না, ছাত্ররা করবে?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ব্যপারটা সেরকম না। আপনাদের দেশে বেশীর ভাগ লোকই থাকে গ্রামে, আর কম ভাগ থাকে শহরে। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো, শতকরা নব্বই ভাগ থাকে শহরে এবং শতকরা দশ ভাগ থাকে গ্রামে। তাই কৃষিক্ষেত্রে আমাদের পর্যাপ্ত কর্মী নেই। কোনরকমে যন্ত্রপাতি ব্যবহার ফসল ফলানোর কাজ করা গেলেও, ফসল তোলার মানুষ পাওয়া যায়না।
আমিঃ তাই বুঝি ছাত্র-ছাত্রীদের যেতে হয়?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ হ্যাঁ সরকার এরকমই নিয়ম করে দিয়েছে।
আমিঃ এতক্ষণে বুঝলাম।
বিষয়টাতো বুঝলাম কিন্তু আমার মন ভালো লাগছিলো না। সেই ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখছি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবো। সেখানে কাটবে আমার গর্বিত রঙিন দিনগুলো। তা বিছমিল্লায়েই গলদ! ক্লাস শুরু হলো আধাআধি। ফুল ফ্লেজড্ ক্লাস করার জন্য এখনো একমাস অপেক্ষা করতে হবে!
পরবর্তি একমাস আসলে তেমন কোন ক্লাস হলোনা। আমরা জনা পনের বিদেশী টুকটাক কিছু ক্লাস করলাম। তার বেশীরভাগই ছিলো পূণঃপাঠ। বেশী এনজয় করতাম লুবোভ আলেক্সিয়েভনার রুশ ভাষার ক্লাস। তিনি সাহিত্যের শিক্ষিকা, আমারও সাহিত্যে আগ্রহ প্রচুর। তাই উনার সাথে সাহিত্য আলোচনা বেশ উপভোগ করতাম। রুশ সাহিত্য বিশ্বসেরা। সেই ছোটবেলা থেকেই লেভ তলস্তয়, দস্তয়ভ্স্কি, পুশকিন, গোর্কী, চেখভের সাথে পরিচিত। লুবোভ আলেক্সিয়েভনার সংস্পর্শে এসে সেই আনন্দময় জগৎকে আরো গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে থাকলাম।
দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল। সাজানো-গোছানো বিশাল খারকোভ শহরের ঘন গাছের পাতাগুলো সবুজ রঙ হারাতে হারাতে একসময় লাল, হলুদ, মেরুন ইত্যাদি নানা রঙ ধারন করলো। বন-বনানী জুড়ে ঠিকরে দিলো অপূর্ব বর্ণচ্ছটা। এই ঋতুটাকে ওরা বলে ওসিন (দন্ত স-এর উচ্চারণটা ইংরেজী s-এর মত হবে), ইংরেজীতে বলে ফল, আর আমরা বলি হেমন্ত। রিক্তের ঋতু। রিক্ততাই বলতে হবে। ঝাঁকড়া চুলওয়ালা একটি তরতাজা তরুণ যখন ধীরে ধীরে মাথার চুল হারিয়ে টেকো হয়ে যায়। তখন রিক্ত মস্তকে তাকে কি শ্রীহীন দেখায় না? এখানকার গাছগুলোর অবস্থাও তাই। ঝাঁকড়া সবুজ পাতাওয়ালা গাছগুলো প্রথমে রঙ পাল্টে বর্ণচ্ছটা তুললেও, একটি-দুটি করে পাতা ঝরতে ঝরতে এক সময় ঝাকে ঝাকে পাতা ঝরে চলার পথে পল্লবপ্রিতীর স্তুপ সৃষ্টি করলেও, গাছগুলোতে নিয়ে আসে একেবারেই শূণ্যতা। পত্রপল্লবহীন ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্ত গাছগুলোর জন্য তখন খুব মায়া হয়।
অক্টোবরের তিন তারিখে অবশেষে এলো বহু প্রতিক্ষিত সময়। ইউক্রেণীয় আর বিদেশী সব ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে পূর্ণাঙ্গ ক্লাসরুমে ক্লাস করবো। সকালে বাসে উঠতে গিয়ে একটু ঝামেলায়ই পড়ে গেলাম। প্রচুর লোকজন। প্রথম বাসটায় উঠতে পারলাম না। দ্বিতীয় বাসটায় উঠলাম। ডরমিটরি থেকে চার কিলোমিটার দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবনে যখন গেলাম, তখন দশ মিনিট দেরী করে ফেলেছি। প্রাসাদোপম বিশাল ভবনটির মধ্যে দিয়ে গিয়ে লিফটে চড়ে যখন সাত তলায় ক্লাসরুমে পৌঁছলাম পনের-বিশ মিনিট দেরী করে ফেলেছি। শিক্ষক ইতিমধ্যে ক্লাস শুরু করে দিয়েছেন। আমি দরজায় দাঁড়াতো তিনি চোখের ইশারায় ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দিলেন। ভিতরে ঢুকে দেখলাম ক্লাস গমগম করছে। ইউক্রেণীয় বিদেশী মিলে জনা পচিশেক ছাত্র-ছাত্রী। সবাই মনযোগ দিয়ে ক্লাস করছে। ক্লাস করার ফাকে ফাকে আমি ইতিউঁতি তাকাচ্ছিলাম। ইউক্রেণীয় ছাত্র-ছাত্রীরা কেমন, কারা আমার সহপাঠি-সহপাঠিনী ইত্যাদি দেখছিলাম। ওরাও ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলো। পরে জেনেছিলাম, ওদের সকলেই খারকোভ বা তার মত বড় শহরের না। অনেকেই ছোট শহর এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেরও রয়েছে, যারা ইতিপূর্বে বিদেশী দেখেনি তাই ওদের আগ্রহও কম ছিলো না।
আমি আস্তে আস্তে সবার দিকে তাকাতে থাকলাম। যে জনা পচিশেক স্টুডেন্ট আমাদের গ্রুপে রয়েছে তার মধ্যে আমরা তিনজন বিদেশী ছেলে রয়েছি। তার মধ্যে এতদিন আমরা যে পনের জন ক্লাশ করেছি তাদের সবাইকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য ঠিকই আছে, আমাকে ডীন অফিসে আগে থেকেই বলেছিলো এই কথা। বাকীরা সবাই ইউক্রেণীয় অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য কোন ইউরোপীয়ান রিপাবলিকের হবে। সবাই শ্বেতাঙ্গ বলে আলাদাভাবে বোঝার উপায় নেই কে কোন রিপাবলিকের। যাহোক এক কথায় এদেরকে স্লাভিয়ান বলা হয়। ওদের মধ্যে বেশীরভাগই মেয়ে। এটা এই দেশে স্বাভাবিক, এই দেশে মেয়েদের সংখ্যা বেশী। এদেশে ছেলেরা বেশ দীর্ঘকায় হয়। মেয়েরাও কম যায়না, ওরাও বেশ লম্বা-চওড়া। যেসব মেয়েদের এখানে শর্ট ধরা হয় ওদের এভারেজ হাইটও পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির কম নয়। খুব অল্প মেয়েই পাওয়া যায় এর নীচের হাইটে। প্রতিটি মেয়েই চোখ ধাঁধানো সুন্দরী।
ছেলে মানুষ আমি প্রকৃতির নিয়মেই মেয়েদের দিকে চোখ যায় বেশী। প্রতিটি মেয়েই সুন্দর সত্যি, তবে কারো দিকেই আমার চোখ আটকালো না। এদিকে ক্লাস শেষ হ্য়ে যাওয়ার পর কয়েকজন আমার দিকে এগিয়ে গেলো। পরিচিত হওয়ার জন্য নিজেদের নাম বলে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। মেয়েদের মধ্যে থেকে দুজন এগিয়ে এলো একজনার নাম নাতাশা অপরজনার নাম তানিয়া। জানতে চাইলো আমি কোন দেশের।
তানিয়া বললো, "এর পরের ক্লাসটা বারো তলায় লেকচার থিয়েটারে হবে তুমি জানোতো?"
আমিঃ লেকচার থিয়েটারে হবে রুটিনে দেখেছি, কিন্তু এটা যে কোথায় আমি জানিনা।
নাতাশাঃ আমরাও সঠিক জানিনা, চলো জিজ্ঞেস করে জেনে নেই।
ক্লাশরূম থেকে বেরিয়ে আমরা ছয়তলায় ডীন অফিসের দিকে গেলাম। ওখানে জিজ্ঞেস করে লেকচার থিয়েটারের এক্সাক্ট লোকেশনটা জানতে পারলাম। তারপর লিফট বেয়ে উঠে গেলাম বারো তলায়। ভিতরে ঢুকে রীতিমতো অবাক হলাম আমি। এযে বিশাল বড় অডিটোরিয়াম! তিন তলার সমান উঁচু গ্যালারী বা থিয়েটারে চার-পাঁচশ লোকের সহজেই বসার ব্যবস্থা হয়। সামনে বিশাল বোর্ড তার উপরে সিনেমার পর্দা, আবার দুপাশে টেলিভিশনের ব্যবস্থাও আছে। অর্থাৎ প্রয়োজনবোধে এখানে টেলিভিশনে ভিডিওতে অথবা বড় প্রজেক্টরে ফিল্ম দেখানোর ব্যবস্থা আছে। এতো অত্যাধুনিক পড়ার অডিটোরিয়াম আমি আগে কখনো দেখিনাই। পরে জেনেছিলাম, এই অডিটোরিয়ামটির নাম 'আউদিতোরিয়া সিনিলিকোভা'। সিনিলিকোভ নামের এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানীর নামে এটার নাম দেয়া হয়েছে। এরকম অডিটোরিয়াম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো কয়েকটা আছে। 'আউদিতোরিয়া সিনিলিকোভা' মুলতঃ ফিজিক্স ফ্যাকাল্টির জন্য বরাদ্ধকৃত।
আমি গিয়ে মাঝামাঝি একটা যায়গায় বসে পড়লাম। তানিয়া আর নাতাশা আমার পাশেই বসলো। আমি ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম,
আমিঃ এতো বড় অডিটোরিয়ামে হঠাৎ বসার ব্যবস্থা হলো কেন? আমরা তো মাত্র পচিশ জন?
তানিয়াঃ ওমা তুমি জানোনা? এখানে তো মাত্র পচিশ জন বসবো না। এখানে আমাদের সংখ্যা হবে দুইশো জনের মতো।
আমিঃ বুঝলাম না। দুইশো জন আবার এলো কোথা থেকে?
নাতাশাঃ আসেনি কোথাও থেকে। আমরা দুইশো জনই।
আমিঃ বুঝিয়ে বলো।
তানিয়াঃ আমরা এই বছর ফিজিক্স ফ্যকালটিতে ভর্তি হয়েছি দুইশো জন। সেই দুইশো জনকে আবার বেশ কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। আবার এ্যস্ট্রোনমারদের আলাদা একটা গ্রুপ।
আমিঃ তারপর?
নাতাশাঃ তারপর লেকচার ক্লাসগুলো হবে সবাই মিলে এই অডিটোরিয়ামে। সাধারনত সিনিয়ার প্রফেসররা লেকচার ক্লাসগুলো নেন। আর সেমিনার ক্লাসগুলো ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে বিভিন্ন ক্লাসরূমে হবে। সেখানে ক্লাস নিবেন জুনিয়র টিচাররা।
আমিঃ এরকমকরার কারণ কি?
তানিয়াঃ আগে তুমি লেকচার শুনবে। বিষয়টি সম্বন্ধে ধারনা পাবে। তারপর তার উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন প্রবলেম সলিউশন, কেস স্টাডি ইত্যাদি হবে সেমিনার ক্লাসে। অর্থাৎ যেটা লেকচার ক্লাসে তুমি থিওরেটিকালি জানছো, সেটাই আবার হাতে কলমে শেখানো হবে সেমিনার ক্লাসগুলোতে।
বাহ্ বেশ ভালো সিস্টেম তো! মনে মনে ভাবলাম।
লেকচার দিতে ঢুকলেন একজন বয়স্ক শিক্ষক। ফুল প্রফেসার ডি,এস,সি, ডিগ্রীধারি এই গুনি শিক্ষকের নাম ইরমালয়েভ। তিনি আমাদের ক্লাসিকাল মেকানিক্স পড়াতে শুরু করলেন। ক্লাসিকাল মেকানিক্স আমার প্রিয় সাবজেক্ট। মনযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ শোনার পর আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। কারণ ভাষাগত সমস্যার কারণে, কিছু বুঝতে পারছিলাম আর কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ফিজিক্সের এই জটিল বিষয়গুলো হানড্রেড পারসেন্ট না বুঝলে ভালো লাগে না।
অমনোযোগী ছাত্রের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। হ্যাঁ এখানে শ'দুয়েক স্টুডেন্টই জমা হয়েছে। আমাদের গ্রুপের ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন যায়গায় বসে লেকচার শুনছে। আমার সাথের বাকী বিদেশী স্টুডেন্টদেরও দেখলাম। অনতিদূরে বসে থাকা মেক্সিকান মারিয়া তেরেসা মেয়েটি আমাকে দেখে হাসলো। এখানেও মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চাইতে বেশী। দুশো জনের মধ্যে একশো বিশ জন মেয়ে হবে।
ইতি-উঁতি তাকাতে তাকাতে হঠাৎ আমার বাঁ দিকে নীচে একটি আসনে গিয়ে আমার চোখ আটকে গেল। ও বাবা! এদেশের মেয়েরা সব চোখ ধাধানো সুন্দরী হয় জানি। ওদেরকে পরী বললে ভুল হবেনা কিছু। কিন্তু ওখানে বসে থাকা মেয়েটিতো সবাইকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতো সুন্দরী মেয়ে হয়! এযে সাক্ষাৎ বেহেশতী হুর! ইউক্রেণীয় মেয়ে যেহেতু রঙতো সাদাই তবে ওর সাদা রঙের সাথে একটা গোলাপী আভা আছে। ঐ আভা ওর মধ্যে বিকেলের রক্তিম আকাশের সৌন্দর্য্য এনে দিয়েছে। অদ্ভুত নীল চোখের দীপ্তি ওকে একটি রক্তনীলায় পরিনত করেছে। মেয়েদের ঠোটের দিকে সাধারনতঃ আমি তাকাই না, তবে ওর ঠোটের দিকে দৃষ্টি চলে গেল, বসরাই গোলাপের দুটো পাঁপড়ি বললে ভুল হবেনা। স্কুলজীবনে পড়া একটি কবিতা মনে পড়ে গেলো, There is a garden in her face, where roses and white lilies grow. এমন রূপে মর্তের মানুষ মুগ্ধ ও সম্মোহিত না হয়ে পারেই না।
আমি ঠিক এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তারপরেও এটা ঘটে গেলো। মেয়েটিকে আমার প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গেলো। একে কি লাভ এ্যট ফার্স্ট সাইট বলবো? জানিনা। লাভ হয়তো না কিন্তু ভালো যে লেগেছে একথা অস্বীকার করতে পারবো না। মেয়েটার দিকে অনেকটা এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ মেয়েটা ঘুরে আমার দিকে তাকালো। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। নাহ্ কাজটা ভালো হয়নি। ওরকম হা করে তাকিয়ে থাকা ঠিক হয়নি। মেয়েটা এখন কি ভাববে? আমি অনেকটা জড়োসড়ো হয়ে গেলাম। প্রফেসর ইরমালয়েভ-এর মেকানিক্স ক্লাসটা ঐদিন ঠিকমতো করাই হলোনা। চোখের সামনে ও মনের মাঝে সারাক্ষণ ঐ মেয়েটির ছবি। কে ঐ মেয়েটি?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনার মূল দায়িত্ব যদিও আমাদের রুশ ভাষায় দক্ষ করে দেয়া, কিন্তু সাহিত্যের শিক্ষিকা বলে তিনি মাঝে মাঝে আমাদের পড়ে শোনাতেন খ্যাতিমান কবি আলেকজান্ডার পুশকিন ও লেরমন্তভ্ ও অন্যান্য রুশ কবিদের কবিতা। আমার সাহিত্য রসে আগ্রহ আছে বলে, তার ক্লাসে আনন্দ পেতাম। একদিন প্রশ্ন করলাম, "আপনি তো কেবল রুশ কবি সাহিত্যিকদের লেখা পড়ে শোনান, আমরা তো বসবাস করছি ইউক্রেণে, আপনি নিজেও জাতিবিচারে ইউক্রেণীয়, এখন যেভাবে জাতীয়তাবাদের জয়গান চলছে, খুব শীগগীরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেতে পারে। তা আপনাদের ইউক্রেণীয় কিছু কবি-টবি আছে কি?" আমার ঠেস দেয়া টাইপ প্রশ্নে তিনি মোটেও বিচলিত হলেন না। এটা ম্যাচিউরিটির গুন। বললেন,
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আসলে আমি জাতিবিচারে ইউক্রেণীয় হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি রুশ সাহিত্য নিয়ে। আর আপনাদেরও তো পড়াচ্ছি রুশ ভাষা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এখানে রুশ লেখক-কবিদের কথা আসবে। তাছাড়া দস্তয়ভ্স্কি, পুশকিনতো পৃথিবী জোড়াই খ্যাতিমান। আপনি নিজেও তো বলেছেন যে, দেশে থাকতেই আপনি উনাদের অনেক লেখা পড়েছেন। আপনাদের রবীন্দ্রনাথ-কেও তো আপনারা বিশ্বকবি বলেন। কবি-সাহিত্যিকদের কি জাতিভেদের বেড়াজালে আটকে রাখা উচিৎ?
অত গভীর কথা বোঝার মত ম্যাচিউরিটি আমার তখনো হয়নি। তারপরেও একটু লজ্জাই লাগলো। বললাম
আমিঃ না, মানে, জাস্ট জানতে চাচ্ছিলাম ইউক্রেণীয় বড় মাপের কোন কবি আছে কিনা?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আমাদের এই অঞ্চলে রুশ ভাষার প্রভাবই ছিলো সব চাইতে বেশী। তাই ঐ ভাষার সাহিত্যই বেশী বিকশিত হয়েছে। তারপরেও আমাদের ইউক্রেণীয় কবিদের মধ্যে সবচাইতে খ্যতিমান হলেন শিভ্চেনকো।
আমিঃ ও হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। আমাদের ইউনিভার্সিটির অনতিদূরেই রয়েছে শিভ্চেনকো পার্ক। সেখানে অপূর্ব একটি ভাষ্কর্য্য রয়েছে। যার মূল মুর্তিটি কবি শিভ্চেনকো-র।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ঐ ভাষ্কর্য্যটিকে বিশ্বের সুন্দরতম ভাষ্কর্য্যগুলোর একটি ধরা হয়।
আমিঃ তাই? তাতো জানতাম না। হওয়াটা স্বাভাবিক, খুব সুন্দর ভাষ্কর্য্যটি।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ তোমাদের সাহিত্যের ইতিহাস কেমন?
আমিঃ আমাদের সাহিত্যতো অনেক পুরাতন!
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ জানি। তোমাদের সভ্যতা গ্রীক সভ্যতার চাইতেও পুরাতন। সুতরাং তোমাদের সাহিত্য পুরাতন হবে এটাই স্বাভাবিক।
আমিঃ আমাদের প্রাচীনতম লিখিত সাহিত্য চর্যাপদ, মিনিমাম এক হাজার বছরের পুরাতন।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ বৌদ্ধদের কিছু?
আমিঃ (একটু অবাক হয়ে) হ্যাঁ, আপনি জানলেন কি করে?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আমি জানি, আপনাদের ওখানে বৌদ্ধ দর্শন খুব সম্মৃদ্ধ ছিলো। আসলে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানতো বাংলাদেশ থেকে স্টোন থ্রো ডিসটেন্সে। গ্রেটার বেঙ্গলের ভিতরেই। আর বুদ্ধের ভাষা তো বাঙলার আদিরূপই। খুব সম্ভবতঃ সেই ভাষার নাম 'পালি'।
আমিঃ ওরে বাব্বা! আপনি তো অনেক কিছু জানেন! আমাদের ভাষা সম্পর্কে এতো কিছু জানলেন কি করে?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ (নির্মল হেসে বললেন) বারে আমি ভাষাতত্বের শিক্ষিকা, সাহিত্যের শিক্ষিকা, আমি জানবো না? আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ফিলোসফি তো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ি। আপনারাও পড়বেন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলে।
আমিঃ ও।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আপনাদের কাব্য সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলুন।
আমিঃ মধ্যযুগের বাঙলা কাব্যসাহিত্যের সূচনা, পুষ্টি আর লালন শুরু হয় সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্-এর শাসনামলে ও তার পরবর্তি সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় তা বিকশিত হয়। এটা না হলে বাঙলা কাব্য এমন স্বতস্ফুর্ত বিস্ময়কর প্রকাশ ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমানের পূর্ণ প্রস্ফুটিত সুষমাময় রূপের সাক্ষাৎ লাভ করতো না।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ মুসলিমদের কিছু?
আমিঃ (আবারও বিস্মিত হয়ে) আপনি জানলেন কেমন করে?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ঠিক একই সময়ে, তেমনি করেই মুসলিম আমীরদের উৎসাহে ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনে স্প্যনিশ কাব্যের স্বচ্ছন্দ উৎসরণ ও উজ্জিবন শুরু হয়। শুধু স্পেন নয়, গোটা আন্দালুজিয়ায় মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জাগরণ এবং সাহিত্যিক তথা সর্বাত্মক মন-মনিষার প্রসার এবং পুষ্টি লাভ পশ্চিম ইউরোপের উমাইয়া খেলাফতের (৭১২ থেকে ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) প্রত্যক্ষ শাসন সংযোগের একটি অনিবার্য ফলশ্রুতি স্বরূপ।
আমিঃ তাই? আমিতো এর কিছুই জানতাম না।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ শুধু তাই না। ইউরোপের অন্ধকার যুগে মুসলমান সুলতান ও মনিষীগণ জ্ঞানের বার্তা এবং বর্তিকা প্রসারিত ও প্রজ্জ্বলিত রেখেছিলেন বলেই মধ্যযুগের প্রান্তভাগে ইউরোপে রেঁনেসা বা মনন-প্রজ্বলন সম্ভবপর হয়। এ সবই ইতিহাসের কথা।
আমার ভিনজাতি ও ভিনধর্মী শিক্ষিকার জ্ঞানের গভীরতা ও নিরপেক্ষতা দেখে উনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেলো।
তারপর হঠাৎ লুবোভ আলেক্সিয়েভনা আমার দিকে তাঁকিয়ে, চোখে কৌতুক নাচিয়ে বললেন।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ তা কবি তুষার (একবার উনাকে আমার লেখা একটা কবিতা উপহার দিয়েছিলাম, সেই থেকে উনি মাঝে মাঝে আমাকে কবি বলে ডাকেন। বিব্রত হই, আবার ভালোও লাগে), আপনার কবিতার নায়িকার কি খবর?
আমি চুপ করে রইলাম।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ নায়িকা খুঁজে পেয়েছেন জানি। তা নায়িকা কি তার নায়কের মনের কথা জানে?
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ এখনো বলেননি তাকে আপনার মনের কথা?
আমি আবারো না সূচক মাথা নাড়লাম।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আপনার মধ্যে বাঙালী জড়তা রয়ে গেছে। এটা ইউরোপে অচল। তাকে আপনার মনের কথা বলতে হবে।
আমিঃ লজ্ঝা পাই, ভয় হয়।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ওটাকে লজ্জ্বা না বলে জড়তা বলাই ভালো। সেই জড়তা কাটিয়ে ওঠার কথাই বলছি। আর ভয়! কিসের ভয়? সে যদি রিফিউজ করে?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
এটা একটা কমোন ব্যপার
আমিঃ ধরুন মেয়েটা রিফিউজ করলো। আবার দশজনে তা জেনেও গেলো, তখন খুব লজ্জ্বার ব্যাপার হবে।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ এ ব্যপারে বারট্রান্ড রাসেলের লেখা একটা প্রবন্ধ আছে, ‘জনমত ভীতি (Fear of Public Opinion)’, পড়ে নিয়েন।
আমিঃ আচ্ছা পড়ব।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আসলে এটা সাহসের ব্যাপার। আপনি খুব দূরে একটা রেখা দেখেন, যেখানে আকাশ আর মাটি মিশে গিয়েছে। ঐ রেখাটার নাম কি?
আমিঃ রুশ ভাষায় গরিজোন, ইংরেজীতে হরাইজোন আর বাংলায় দিগন্ত।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ গুড। ওটাকে ধরা যায়?
আমিঃ নাতো। কি করে ধরবো? আমি ওটার দিকে যতই অগ্রসর হবো, ওটা আমার কাছ থেকে ততই দূরে সরে যাবে।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ সাহস করে এগিয়ে যান না, দেখুন না ধরতে পারেন কিনা।
আমি মনে মনে ভাবলাম, এগিয়ে যাবে সে সাহস ক'জনার আছে?
(চলবে)
♫♪আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি
আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি।
বাজে কিনিকিনি রিনিঝিনি
তোমারে যে চিনি চিনি
মনে মনে কত ছবি এঁকেছি।।
ছিলো ভাবে ভরা দুটি আঁখি চঞ্চল
তুমি বাতাসে উড়ালে ভীরু অঞ্চল।
ওই রূপের মাধবী মোর সংশয়ে রেখেছি।।
(যেন) কস্তুরী মৃগ তুমি
আপন গন্ধ ঢেলে
এ হৃদয় ছুঁয়ে গেলে
সে মায়ায় আপনারে ঢেকেছি।
ওই কপোলে দেখেছি লাল পদ্ম
যেন দল মেলে ফুটেছে সে সদ্য।
আমি ভ্রমরের গুঞ্জনে তোমারেই দেখেছি।।♫♪
--------------------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ
আটই মার্চ, বিশ্ব নারী দিবস। এদেশে এই দিনটি ঘটা করে পালন করা হয়। থাকে সরকারী ছুটি। ইউক্রেনের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এটা বসন্ত কাল। পহেলা মার্চ থেকেই বসন্ত শুরু হয়। তবে ক্যালেন্ডার বলে এক কথা, আর বাস্তব বলে আরেক কথা। যেখানে সমীরণের উষ্ণতা নেই, ফুলের সমারোহ নেই, নেই কোকিলের ডাক তাকে কি বসন্ত কাল বলা যায়? বরং এই সব কিছুর বদলে গত কয়েকদিন যাবত যা হয়েছে তা হলো অবিরাম তুষারপাত। আর তার ফল হিসাবে খারকভ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় আর তার অনতিদূরে অবস্থিত আতাকারা ইয়ারোশা স্টুডেন্টস টাউন যোজনব্যাপী তুষারশুভ্রতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পপলার তরুবিথীতে ছাওয়া সেই তুষার ঝরা পথ দিয়ে হাতে একতোড়া টিউলিপ ফুল নিয়ে চুপচাপ হেটে যাচ্ছে একটি মেয়ে। শুভ্র ফারকোট গায়ে ওর নীরবে পথ চলা দেখে যে কারোরই মনে হবে, একটি তুষার কন্যা হেটে যাচ্ছে যেন। রাস্তার এপাশ থেকে একটু মনযোগ দিয়ে দেখে বুঝলাম, ওকে আমি চিনি। মেয়েটির নাম লেনা। আমার সাথেই পড়ে। গত ছয়মাস যাবৎ দেখছি ওর আস্চর্য্য নীল চোখের অদ্ভুত প্রশান্তি। মেয়েটিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। তবে তাকে তা জানানো হয়নি, নিজের কথা নিজের মনের রেখেছি। আর মনে মনে ওর নাম দিয়েছি তুষারকন্যা।
পূর্ব ইউরোপের একটি ছিমছাম দেশ ইউক্রেন। অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই দেশটিতে এসেছি সাত মাস হয়। এখানকার প্রকৃতি বাংলাদেশের সাথে তুলনীয় হবে এমন কথা বলা যাবেনা। বরং একেবারেই ভিন্ন ধরনের। তবে প্রকৃতি এখানে যে সৌন্দর্য্য নিয়ে আছে তার রূপও কম নয়। আামাদের রুশ ভাষার শিক্ষিকা লুবোভ আলেক্সিয়েভনাকে, একবার বলেছিলাম একথা। তিনি খুব সুন্দর উত্তর দিলেন, "প্রকৃতি এখানে হয়তো সুন্দর কিন্তু তার চাইতেও সঠিক বলা হবে যদি বলি আপনার দৃষ্টি সুন্দর। ঐ সুন্দর দৃষ্টি দিয়েই আপনি চারপাশের জগৎটাকে সুন্দর দেখছেন।" বাহ্ সাহিত্যের শিক্ষিকার কি চমৎকার বর্ননা। তারপর তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, "তুষার, আপনি এদেশে কয়েক মাস যাবৎ আছেন, আপনার কি এখানে কোন মেয়েকে ভালো লেগেছে?" এরকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন, সরাসরি করতে দেখে আমি কিছুটা বিব্রত হলাম। তিনি আমার মনের কথাস বুঝতে পারলেন। তারপর আমাকে বললেন, "আমি জানি তোমরা বাংলাদেশীরা এই ধরনের প্রশ্নে লজ্জা পাও, বিব্রত হও।" আমি একটু অবাক হয়ে উনাকে প্রশ্ন করলাম, "আপনি জানলেন কি করে?"
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ কি আশ্চর্য্য! আমি আপনার প্রায় মায়ের বয়সী। আমি তো আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ক্লাস নিচ্ছিনা। আমার বহু বছরের অভিজ্ঞতা। কত দেশের ছেলেমেয়েদেরই তো পড়িয়েছি।
আমিঃ থাক আর বলতে হবেনা, আমি বুঝতে পেরেছি?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আপনার চোখ বলছে, কোন একটি মেয়ের চোখ আপনার চোখের সরোবরে তলিয়ে গেছে।
আমিঃ না, মানে।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আমি কি ঠিক ধরেছি?
আমিঃ সাহিত্যের পাশাপাশি আপনি কি কিছু কিছু সাইকোলজিও জানেন?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ তা জানি। তবে সাইকোলজি পড়ে নয়।
আমিঃ তাহলে কি করে জানলেন?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ঐ যে বললাম, আমার অনেক বছরের অভিজ্ঞতা। যেটুকু মনোবিদ্যা শিখেছি তা জীবন থেকে শিখেছি।
আমিঃ আসলে আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না। মেয়েটিকে আমার ভালো লাগে। কিন্তু এটা সত্যিই ভালো লাগা কি না?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ মেয়েটি কি সুন্দরী?
আমিঃ হ্যাঁ, খুব, খুউব সুন্দরী। জানেন ........ (হরহর করে অনেক কথা বলতে গিয়ে সংযত হয়ে গেলাম)
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আসলে কি জানেন? ঐ মেয়েটি যেমনই হোক না কেন, আপনার চোখে সে ভীষণ সুন্দরী। ঐ যে বললাম বস্তু যতনা সুন্দর আপনার দৃষ্টি তার চাইতেও বেশী সুন্দর।
বুঝলাম উনি কি বলতে চাইছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা আছে,
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে ।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পূবে পশ্চিমে ।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম সুন্দর,
সুন্দর হল সে।
লেনাকে আমি প্রথম দেখেছি গত বছরের অক্টোবর মাসে। এদেশে যত সমস্যাই হোক না কেন। প্রকৃতি যতই বিরূপ হোক না কেন। রাজনীতির আকাশে যতই কালো মেঘ আনাগোনা করুক না কেন, যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই হোক না কেন, এ্যাকাডেমিক ইয়ারের ক্লাস ঠিকই পহেলা সেপ্টেম্বরে শুরু হবে। তাই যথা নিয়মে পহেলা সেপ্টেম্বরে গেলাম ইউনিভার্সিটিতে। আমাকে বলা হয়েছিলো বেলা দশটায় ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়ামে একটা নবীন বরণ অনুষ্ঠান হবে। অডিটোরিয়াম খুঁজতে গিয়ে আমি খারকোভ স্টেট ইউনিভার্সিটির বিশাল অট্টালিকায় নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। তখন রুশ ভাষাও অত ভালো রপ্ত করতে পারিনি। মাত্র এক বছরের ল্যংগুয়েজ কোর্সে একটা ভিনদেশী ভাষা রপ্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়। বহু কষ্টে এর-ওর কাছে জিজ্ঞেস করে তিনতলায় খুঁজে পেলাম বিশাল অডিটোরিয়ামটি। ভিতরে ঢুকে দেখলাম রাজকীয় অনুষ্ঠান। অপেরা টাইপের নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে। নতুন ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপকদের উপস্থিতিতে বেশ সুন্দর একটি নবীন বরণ হলো। এতো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেশে কখনো দেখিনি। নিজেকে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। নবীন বরণ অনুষ্ঠানে সব ফ্যাকাল্টির ছাত্র-ছাত্রীরাই উপস্থিত ছিলো। এরপর কেবল আমাদের ফ্যাকাল্টির ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা একটা মিটিং হলো। সেখানে ডীন কিছু বললেন। অন্যান্য অধ্যাপকরাও কিছু বললেন। এতো চোস্ত রুশ ভাষার সবটা ধরতে পারলাম না। তবে মনে হলো তিনি ইউক্রেণীয় ছাত্র-ছাত্রীদের পৃথকভাবে কিছু বলছিলেন।
পরদিন রুটিন অনুযায়ী যথাসময়ে ক্লাসে উপস্থিত হলাম। ক্লাসে ঢুকে আমিতো হতবাক। এতো কম স্টুডেন্ট কেনো? তাছাড়া যারা ক্লাসে আছে সবাই বিদেশী। প্রথম ক্লাসটি ছিলো ক্লাসিকাল মেকানিক্স-এর উপর। তামারা নিকোলায়েভনা নামে একজন বয়স্ক অধ্যাপিকা ক্লাস নিচ্ছিলেন। পরে জেনেছিলাম উনাকে সবাই দাদী তামারা বলে। এই ক্লাস শেষ হওয়ার পর ছিলো রুশ ভাষার ক্লাস। শুধু বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীরাই এই ক্লাসটি করে। সেখানেই প্রথম রুশ সাহিত্যের শিক্ষিকা লুবোভ আলেক্সিয়েভনার সাথে পরিচয় হয়। তিনি খুব সুন্দর করে আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। চোস্ত রুশ নয় বরং খুব সহজ সহজ শব্দ ব্যবহার করে আমাদের বোধগম্য করে সব কথা বলছিলেন। উনার কাছে জানতে চাইলাম, আজ সকালের মেকানিক্স ক্লাসে ইউক্রেণীয় ছাত্র-ছাত্রীরা অনুপস্থিত ছিলো কেন?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ জানেন না? ইউক্রেণীয় ছাত্র-ছাত্রীরাতো একমাস অনুপস্থিত থাকবে।
আমিঃ কেন?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আমাদের এখানে নিয়ম আছে। ক্ষেতে ফসল ওঠার পর, ছাত্র-ছাত্রীরা সেই ফসল তুলতে যায়।
আমিঃ ফসল তো তুলবে কৃষকরা।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ সে আপনাদের দেশে হয়। আমাদের দেশে না।
আমিঃ বুঝলাম না, কৃষকের কাজ কৃষক করবে না, ছাত্ররা করবে?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ব্যপারটা সেরকম না। আপনাদের দেশে বেশীর ভাগ লোকই থাকে গ্রামে, আর কম ভাগ থাকে শহরে। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো, শতকরা নব্বই ভাগ থাকে শহরে এবং শতকরা দশ ভাগ থাকে গ্রামে। তাই কৃষিক্ষেত্রে আমাদের পর্যাপ্ত কর্মী নেই। কোনরকমে যন্ত্রপাতি ব্যবহার ফসল ফলানোর কাজ করা গেলেও, ফসল তোলার মানুষ পাওয়া যায়না।
আমিঃ তাই বুঝি ছাত্র-ছাত্রীদের যেতে হয়?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ হ্যাঁ সরকার এরকমই নিয়ম করে দিয়েছে।
আমিঃ এতক্ষণে বুঝলাম।
বিষয়টাতো বুঝলাম কিন্তু আমার মন ভালো লাগছিলো না। সেই ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখছি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবো। সেখানে কাটবে আমার গর্বিত রঙিন দিনগুলো। তা বিছমিল্লায়েই গলদ! ক্লাস শুরু হলো আধাআধি। ফুল ফ্লেজড্ ক্লাস করার জন্য এখনো একমাস অপেক্ষা করতে হবে!
পরবর্তি একমাস আসলে তেমন কোন ক্লাস হলোনা। আমরা জনা পনের বিদেশী টুকটাক কিছু ক্লাস করলাম। তার বেশীরভাগই ছিলো পূণঃপাঠ। বেশী এনজয় করতাম লুবোভ আলেক্সিয়েভনার রুশ ভাষার ক্লাস। তিনি সাহিত্যের শিক্ষিকা, আমারও সাহিত্যে আগ্রহ প্রচুর। তাই উনার সাথে সাহিত্য আলোচনা বেশ উপভোগ করতাম। রুশ সাহিত্য বিশ্বসেরা। সেই ছোটবেলা থেকেই লেভ তলস্তয়, দস্তয়ভ্স্কি, পুশকিন, গোর্কী, চেখভের সাথে পরিচিত। লুবোভ আলেক্সিয়েভনার সংস্পর্শে এসে সেই আনন্দময় জগৎকে আরো গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে থাকলাম।
দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল। সাজানো-গোছানো বিশাল খারকোভ শহরের ঘন গাছের পাতাগুলো সবুজ রঙ হারাতে হারাতে একসময় লাল, হলুদ, মেরুন ইত্যাদি নানা রঙ ধারন করলো। বন-বনানী জুড়ে ঠিকরে দিলো অপূর্ব বর্ণচ্ছটা। এই ঋতুটাকে ওরা বলে ওসিন (দন্ত স-এর উচ্চারণটা ইংরেজী s-এর মত হবে), ইংরেজীতে বলে ফল, আর আমরা বলি হেমন্ত। রিক্তের ঋতু। রিক্ততাই বলতে হবে। ঝাঁকড়া চুলওয়ালা একটি তরতাজা তরুণ যখন ধীরে ধীরে মাথার চুল হারিয়ে টেকো হয়ে যায়। তখন রিক্ত মস্তকে তাকে কি শ্রীহীন দেখায় না? এখানকার গাছগুলোর অবস্থাও তাই। ঝাঁকড়া সবুজ পাতাওয়ালা গাছগুলো প্রথমে রঙ পাল্টে বর্ণচ্ছটা তুললেও, একটি-দুটি করে পাতা ঝরতে ঝরতে এক সময় ঝাকে ঝাকে পাতা ঝরে চলার পথে পল্লবপ্রিতীর স্তুপ সৃষ্টি করলেও, গাছগুলোতে নিয়ে আসে একেবারেই শূণ্যতা। পত্রপল্লবহীন ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্ত গাছগুলোর জন্য তখন খুব মায়া হয়।
অক্টোবরের তিন তারিখে অবশেষে এলো বহু প্রতিক্ষিত সময়। ইউক্রেণীয় আর বিদেশী সব ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে পূর্ণাঙ্গ ক্লাসরুমে ক্লাস করবো। সকালে বাসে উঠতে গিয়ে একটু ঝামেলায়ই পড়ে গেলাম। প্রচুর লোকজন। প্রথম বাসটায় উঠতে পারলাম না। দ্বিতীয় বাসটায় উঠলাম। ডরমিটরি থেকে চার কিলোমিটার দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবনে যখন গেলাম, তখন দশ মিনিট দেরী করে ফেলেছি। প্রাসাদোপম বিশাল ভবনটির মধ্যে দিয়ে গিয়ে লিফটে চড়ে যখন সাত তলায় ক্লাসরুমে পৌঁছলাম পনের-বিশ মিনিট দেরী করে ফেলেছি। শিক্ষক ইতিমধ্যে ক্লাস শুরু করে দিয়েছেন। আমি দরজায় দাঁড়াতো তিনি চোখের ইশারায় ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দিলেন। ভিতরে ঢুকে দেখলাম ক্লাস গমগম করছে। ইউক্রেণীয় বিদেশী মিলে জনা পচিশেক ছাত্র-ছাত্রী। সবাই মনযোগ দিয়ে ক্লাস করছে। ক্লাস করার ফাকে ফাকে আমি ইতিউঁতি তাকাচ্ছিলাম। ইউক্রেণীয় ছাত্র-ছাত্রীরা কেমন, কারা আমার সহপাঠি-সহপাঠিনী ইত্যাদি দেখছিলাম। ওরাও ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলো। পরে জেনেছিলাম, ওদের সকলেই খারকোভ বা তার মত বড় শহরের না। অনেকেই ছোট শহর এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেরও রয়েছে, যারা ইতিপূর্বে বিদেশী দেখেনি তাই ওদের আগ্রহও কম ছিলো না।
আমি আস্তে আস্তে সবার দিকে তাকাতে থাকলাম। যে জনা পচিশেক স্টুডেন্ট আমাদের গ্রুপে রয়েছে তার মধ্যে আমরা তিনজন বিদেশী ছেলে রয়েছি। তার মধ্যে এতদিন আমরা যে পনের জন ক্লাশ করেছি তাদের সবাইকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য ঠিকই আছে, আমাকে ডীন অফিসে আগে থেকেই বলেছিলো এই কথা। বাকীরা সবাই ইউক্রেণীয় অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য কোন ইউরোপীয়ান রিপাবলিকের হবে। সবাই শ্বেতাঙ্গ বলে আলাদাভাবে বোঝার উপায় নেই কে কোন রিপাবলিকের। যাহোক এক কথায় এদেরকে স্লাভিয়ান বলা হয়। ওদের মধ্যে বেশীরভাগই মেয়ে। এটা এই দেশে স্বাভাবিক, এই দেশে মেয়েদের সংখ্যা বেশী। এদেশে ছেলেরা বেশ দীর্ঘকায় হয়। মেয়েরাও কম যায়না, ওরাও বেশ লম্বা-চওড়া। যেসব মেয়েদের এখানে শর্ট ধরা হয় ওদের এভারেজ হাইটও পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির কম নয়। খুব অল্প মেয়েই পাওয়া যায় এর নীচের হাইটে। প্রতিটি মেয়েই চোখ ধাঁধানো সুন্দরী।
ছেলে মানুষ আমি প্রকৃতির নিয়মেই মেয়েদের দিকে চোখ যায় বেশী। প্রতিটি মেয়েই সুন্দর সত্যি, তবে কারো দিকেই আমার চোখ আটকালো না। এদিকে ক্লাস শেষ হ্য়ে যাওয়ার পর কয়েকজন আমার দিকে এগিয়ে গেলো। পরিচিত হওয়ার জন্য নিজেদের নাম বলে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। মেয়েদের মধ্যে থেকে দুজন এগিয়ে এলো একজনার নাম নাতাশা অপরজনার নাম তানিয়া। জানতে চাইলো আমি কোন দেশের।
তানিয়া বললো, "এর পরের ক্লাসটা বারো তলায় লেকচার থিয়েটারে হবে তুমি জানোতো?"
আমিঃ লেকচার থিয়েটারে হবে রুটিনে দেখেছি, কিন্তু এটা যে কোথায় আমি জানিনা।
নাতাশাঃ আমরাও সঠিক জানিনা, চলো জিজ্ঞেস করে জেনে নেই।
ক্লাশরূম থেকে বেরিয়ে আমরা ছয়তলায় ডীন অফিসের দিকে গেলাম। ওখানে জিজ্ঞেস করে লেকচার থিয়েটারের এক্সাক্ট লোকেশনটা জানতে পারলাম। তারপর লিফট বেয়ে উঠে গেলাম বারো তলায়। ভিতরে ঢুকে রীতিমতো অবাক হলাম আমি। এযে বিশাল বড় অডিটোরিয়াম! তিন তলার সমান উঁচু গ্যালারী বা থিয়েটারে চার-পাঁচশ লোকের সহজেই বসার ব্যবস্থা হয়। সামনে বিশাল বোর্ড তার উপরে সিনেমার পর্দা, আবার দুপাশে টেলিভিশনের ব্যবস্থাও আছে। অর্থাৎ প্রয়োজনবোধে এখানে টেলিভিশনে ভিডিওতে অথবা বড় প্রজেক্টরে ফিল্ম দেখানোর ব্যবস্থা আছে। এতো অত্যাধুনিক পড়ার অডিটোরিয়াম আমি আগে কখনো দেখিনাই। পরে জেনেছিলাম, এই অডিটোরিয়ামটির নাম 'আউদিতোরিয়া সিনিলিকোভা'। সিনিলিকোভ নামের এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানীর নামে এটার নাম দেয়া হয়েছে। এরকম অডিটোরিয়াম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো কয়েকটা আছে। 'আউদিতোরিয়া সিনিলিকোভা' মুলতঃ ফিজিক্স ফ্যাকাল্টির জন্য বরাদ্ধকৃত।
আমি গিয়ে মাঝামাঝি একটা যায়গায় বসে পড়লাম। তানিয়া আর নাতাশা আমার পাশেই বসলো। আমি ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম,
আমিঃ এতো বড় অডিটোরিয়ামে হঠাৎ বসার ব্যবস্থা হলো কেন? আমরা তো মাত্র পচিশ জন?
তানিয়াঃ ওমা তুমি জানোনা? এখানে তো মাত্র পচিশ জন বসবো না। এখানে আমাদের সংখ্যা হবে দুইশো জনের মতো।
আমিঃ বুঝলাম না। দুইশো জন আবার এলো কোথা থেকে?
নাতাশাঃ আসেনি কোথাও থেকে। আমরা দুইশো জনই।
আমিঃ বুঝিয়ে বলো।
তানিয়াঃ আমরা এই বছর ফিজিক্স ফ্যকালটিতে ভর্তি হয়েছি দুইশো জন। সেই দুইশো জনকে আবার বেশ কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। আবার এ্যস্ট্রোনমারদের আলাদা একটা গ্রুপ।
আমিঃ তারপর?
নাতাশাঃ তারপর লেকচার ক্লাসগুলো হবে সবাই মিলে এই অডিটোরিয়ামে। সাধারনত সিনিয়ার প্রফেসররা লেকচার ক্লাসগুলো নেন। আর সেমিনার ক্লাসগুলো ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে বিভিন্ন ক্লাসরূমে হবে। সেখানে ক্লাস নিবেন জুনিয়র টিচাররা।
আমিঃ এরকমকরার কারণ কি?
তানিয়াঃ আগে তুমি লেকচার শুনবে। বিষয়টি সম্বন্ধে ধারনা পাবে। তারপর তার উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন প্রবলেম সলিউশন, কেস স্টাডি ইত্যাদি হবে সেমিনার ক্লাসে। অর্থাৎ যেটা লেকচার ক্লাসে তুমি থিওরেটিকালি জানছো, সেটাই আবার হাতে কলমে শেখানো হবে সেমিনার ক্লাসগুলোতে।
বাহ্ বেশ ভালো সিস্টেম তো! মনে মনে ভাবলাম।
লেকচার দিতে ঢুকলেন একজন বয়স্ক শিক্ষক। ফুল প্রফেসার ডি,এস,সি, ডিগ্রীধারি এই গুনি শিক্ষকের নাম ইরমালয়েভ। তিনি আমাদের ক্লাসিকাল মেকানিক্স পড়াতে শুরু করলেন। ক্লাসিকাল মেকানিক্স আমার প্রিয় সাবজেক্ট। মনযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ শোনার পর আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। কারণ ভাষাগত সমস্যার কারণে, কিছু বুঝতে পারছিলাম আর কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ফিজিক্সের এই জটিল বিষয়গুলো হানড্রেড পারসেন্ট না বুঝলে ভালো লাগে না।
অমনোযোগী ছাত্রের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। হ্যাঁ এখানে শ'দুয়েক স্টুডেন্টই জমা হয়েছে। আমাদের গ্রুপের ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন যায়গায় বসে লেকচার শুনছে। আমার সাথের বাকী বিদেশী স্টুডেন্টদেরও দেখলাম। অনতিদূরে বসে থাকা মেক্সিকান মারিয়া তেরেসা মেয়েটি আমাকে দেখে হাসলো। এখানেও মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চাইতে বেশী। দুশো জনের মধ্যে একশো বিশ জন মেয়ে হবে।
ইতি-উঁতি তাকাতে তাকাতে হঠাৎ আমার বাঁ দিকে নীচে একটি আসনে গিয়ে আমার চোখ আটকে গেল। ও বাবা! এদেশের মেয়েরা সব চোখ ধাধানো সুন্দরী হয় জানি। ওদেরকে পরী বললে ভুল হবেনা কিছু। কিন্তু ওখানে বসে থাকা মেয়েটিতো সবাইকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতো সুন্দরী মেয়ে হয়! এযে সাক্ষাৎ বেহেশতী হুর! ইউক্রেণীয় মেয়ে যেহেতু রঙতো সাদাই তবে ওর সাদা রঙের সাথে একটা গোলাপী আভা আছে। ঐ আভা ওর মধ্যে বিকেলের রক্তিম আকাশের সৌন্দর্য্য এনে দিয়েছে। অদ্ভুত নীল চোখের দীপ্তি ওকে একটি রক্তনীলায় পরিনত করেছে। মেয়েদের ঠোটের দিকে সাধারনতঃ আমি তাকাই না, তবে ওর ঠোটের দিকে দৃষ্টি চলে গেল, বসরাই গোলাপের দুটো পাঁপড়ি বললে ভুল হবেনা। স্কুলজীবনে পড়া একটি কবিতা মনে পড়ে গেলো, There is a garden in her face, where roses and white lilies grow. এমন রূপে মর্তের মানুষ মুগ্ধ ও সম্মোহিত না হয়ে পারেই না।
আমি ঠিক এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তারপরেও এটা ঘটে গেলো। মেয়েটিকে আমার প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গেলো। একে কি লাভ এ্যট ফার্স্ট সাইট বলবো? জানিনা। লাভ হয়তো না কিন্তু ভালো যে লেগেছে একথা অস্বীকার করতে পারবো না। মেয়েটার দিকে অনেকটা এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ মেয়েটা ঘুরে আমার দিকে তাকালো। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। নাহ্ কাজটা ভালো হয়নি। ওরকম হা করে তাকিয়ে থাকা ঠিক হয়নি। মেয়েটা এখন কি ভাববে? আমি অনেকটা জড়োসড়ো হয়ে গেলাম। প্রফেসর ইরমালয়েভ-এর মেকানিক্স ক্লাসটা ঐদিন ঠিকমতো করাই হলোনা। চোখের সামনে ও মনের মাঝে সারাক্ষণ ঐ মেয়েটির ছবি। কে ঐ মেয়েটি?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনার মূল দায়িত্ব যদিও আমাদের রুশ ভাষায় দক্ষ করে দেয়া, কিন্তু সাহিত্যের শিক্ষিকা বলে তিনি মাঝে মাঝে আমাদের পড়ে শোনাতেন খ্যাতিমান কবি আলেকজান্ডার পুশকিন ও লেরমন্তভ্ ও অন্যান্য রুশ কবিদের কবিতা। আমার সাহিত্য রসে আগ্রহ আছে বলে, তার ক্লাসে আনন্দ পেতাম। একদিন প্রশ্ন করলাম, "আপনি তো কেবল রুশ কবি সাহিত্যিকদের লেখা পড়ে শোনান, আমরা তো বসবাস করছি ইউক্রেণে, আপনি নিজেও জাতিবিচারে ইউক্রেণীয়, এখন যেভাবে জাতীয়তাবাদের জয়গান চলছে, খুব শীগগীরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেতে পারে। তা আপনাদের ইউক্রেণীয় কিছু কবি-টবি আছে কি?" আমার ঠেস দেয়া টাইপ প্রশ্নে তিনি মোটেও বিচলিত হলেন না। এটা ম্যাচিউরিটির গুন। বললেন,
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আসলে আমি জাতিবিচারে ইউক্রেণীয় হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি রুশ সাহিত্য নিয়ে। আর আপনাদেরও তো পড়াচ্ছি রুশ ভাষা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এখানে রুশ লেখক-কবিদের কথা আসবে। তাছাড়া দস্তয়ভ্স্কি, পুশকিনতো পৃথিবী জোড়াই খ্যাতিমান। আপনি নিজেও তো বলেছেন যে, দেশে থাকতেই আপনি উনাদের অনেক লেখা পড়েছেন। আপনাদের রবীন্দ্রনাথ-কেও তো আপনারা বিশ্বকবি বলেন। কবি-সাহিত্যিকদের কি জাতিভেদের বেড়াজালে আটকে রাখা উচিৎ?
অত গভীর কথা বোঝার মত ম্যাচিউরিটি আমার তখনো হয়নি। তারপরেও একটু লজ্জাই লাগলো। বললাম
আমিঃ না, মানে, জাস্ট জানতে চাচ্ছিলাম ইউক্রেণীয় বড় মাপের কোন কবি আছে কিনা?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আমাদের এই অঞ্চলে রুশ ভাষার প্রভাবই ছিলো সব চাইতে বেশী। তাই ঐ ভাষার সাহিত্যই বেশী বিকশিত হয়েছে। তারপরেও আমাদের ইউক্রেণীয় কবিদের মধ্যে সবচাইতে খ্যতিমান হলেন শিভ্চেনকো।
আমিঃ ও হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। আমাদের ইউনিভার্সিটির অনতিদূরেই রয়েছে শিভ্চেনকো পার্ক। সেখানে অপূর্ব একটি ভাষ্কর্য্য রয়েছে। যার মূল মুর্তিটি কবি শিভ্চেনকো-র।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ঐ ভাষ্কর্য্যটিকে বিশ্বের সুন্দরতম ভাষ্কর্য্যগুলোর একটি ধরা হয়।
আমিঃ তাই? তাতো জানতাম না। হওয়াটা স্বাভাবিক, খুব সুন্দর ভাষ্কর্য্যটি।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ তোমাদের সাহিত্যের ইতিহাস কেমন?
আমিঃ আমাদের সাহিত্যতো অনেক পুরাতন!
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ জানি। তোমাদের সভ্যতা গ্রীক সভ্যতার চাইতেও পুরাতন। সুতরাং তোমাদের সাহিত্য পুরাতন হবে এটাই স্বাভাবিক।
আমিঃ আমাদের প্রাচীনতম লিখিত সাহিত্য চর্যাপদ, মিনিমাম এক হাজার বছরের পুরাতন।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ বৌদ্ধদের কিছু?
আমিঃ (একটু অবাক হয়ে) হ্যাঁ, আপনি জানলেন কি করে?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আমি জানি, আপনাদের ওখানে বৌদ্ধ দর্শন খুব সম্মৃদ্ধ ছিলো। আসলে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানতো বাংলাদেশ থেকে স্টোন থ্রো ডিসটেন্সে। গ্রেটার বেঙ্গলের ভিতরেই। আর বুদ্ধের ভাষা তো বাঙলার আদিরূপই। খুব সম্ভবতঃ সেই ভাষার নাম 'পালি'।
আমিঃ ওরে বাব্বা! আপনি তো অনেক কিছু জানেন! আমাদের ভাষা সম্পর্কে এতো কিছু জানলেন কি করে?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ (নির্মল হেসে বললেন) বারে আমি ভাষাতত্বের শিক্ষিকা, সাহিত্যের শিক্ষিকা, আমি জানবো না? আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ফিলোসফি তো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ি। আপনারাও পড়বেন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলে।
আমিঃ ও।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আপনাদের কাব্য সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলুন।
আমিঃ মধ্যযুগের বাঙলা কাব্যসাহিত্যের সূচনা, পুষ্টি আর লালন শুরু হয় সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্-এর শাসনামলে ও তার পরবর্তি সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় তা বিকশিত হয়। এটা না হলে বাঙলা কাব্য এমন স্বতস্ফুর্ত বিস্ময়কর প্রকাশ ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমানের পূর্ণ প্রস্ফুটিত সুষমাময় রূপের সাক্ষাৎ লাভ করতো না।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ মুসলিমদের কিছু?
আমিঃ (আবারও বিস্মিত হয়ে) আপনি জানলেন কেমন করে?
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ঠিক একই সময়ে, তেমনি করেই মুসলিম আমীরদের উৎসাহে ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনে স্প্যনিশ কাব্যের স্বচ্ছন্দ উৎসরণ ও উজ্জিবন শুরু হয়। শুধু স্পেন নয়, গোটা আন্দালুজিয়ায় মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জাগরণ এবং সাহিত্যিক তথা সর্বাত্মক মন-মনিষার প্রসার এবং পুষ্টি লাভ পশ্চিম ইউরোপের উমাইয়া খেলাফতের (৭১২ থেকে ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) প্রত্যক্ষ শাসন সংযোগের একটি অনিবার্য ফলশ্রুতি স্বরূপ।
আমিঃ তাই? আমিতো এর কিছুই জানতাম না।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ শুধু তাই না। ইউরোপের অন্ধকার যুগে মুসলমান সুলতান ও মনিষীগণ জ্ঞানের বার্তা এবং বর্তিকা প্রসারিত ও প্রজ্জ্বলিত রেখেছিলেন বলেই মধ্যযুগের প্রান্তভাগে ইউরোপে রেঁনেসা বা মনন-প্রজ্বলন সম্ভবপর হয়। এ সবই ইতিহাসের কথা।
আমার ভিনজাতি ও ভিনধর্মী শিক্ষিকার জ্ঞানের গভীরতা ও নিরপেক্ষতা দেখে উনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেলো।
তারপর হঠাৎ লুবোভ আলেক্সিয়েভনা আমার দিকে তাঁকিয়ে, চোখে কৌতুক নাচিয়ে বললেন।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ তা কবি তুষার (একবার উনাকে আমার লেখা একটা কবিতা উপহার দিয়েছিলাম, সেই থেকে উনি মাঝে মাঝে আমাকে কবি বলে ডাকেন। বিব্রত হই, আবার ভালোও লাগে), আপনার কবিতার নায়িকার কি খবর?
আমি চুপ করে রইলাম।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ নায়িকা খুঁজে পেয়েছেন জানি। তা নায়িকা কি তার নায়কের মনের কথা জানে?
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ এখনো বলেননি তাকে আপনার মনের কথা?
আমি আবারো না সূচক মাথা নাড়লাম।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আপনার মধ্যে বাঙালী জড়তা রয়ে গেছে। এটা ইউরোপে অচল। তাকে আপনার মনের কথা বলতে হবে।
আমিঃ লজ্ঝা পাই, ভয় হয়।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ ওটাকে লজ্জ্বা না বলে জড়তা বলাই ভালো। সেই জড়তা কাটিয়ে ওঠার কথাই বলছি। আর ভয়! কিসের ভয়? সে যদি রিফিউজ করে?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
এটা একটা কমোন ব্যপার
আমিঃ ধরুন মেয়েটা রিফিউজ করলো। আবার দশজনে তা জেনেও গেলো, তখন খুব লজ্জ্বার ব্যাপার হবে।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ এ ব্যপারে বারট্রান্ড রাসেলের লেখা একটা প্রবন্ধ আছে, ‘জনমত ভীতি (Fear of Public Opinion)’, পড়ে নিয়েন।
আমিঃ আচ্ছা পড়ব।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ আসলে এটা সাহসের ব্যাপার। আপনি খুব দূরে একটা রেখা দেখেন, যেখানে আকাশ আর মাটি মিশে গিয়েছে। ঐ রেখাটার নাম কি?
আমিঃ রুশ ভাষায় গরিজোন, ইংরেজীতে হরাইজোন আর বাংলায় দিগন্ত।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ গুড। ওটাকে ধরা যায়?
আমিঃ নাতো। কি করে ধরবো? আমি ওটার দিকে যতই অগ্রসর হবো, ওটা আমার কাছ থেকে ততই দূরে সরে যাবে।
লুবোভ আলেক্সিয়েভনাঃ সাহস করে এগিয়ে যান না, দেখুন না ধরতে পারেন কিনা।
আমি মনে মনে ভাবলাম, এগিয়ে যাবে সে সাহস ক'জনার আছে?
(চলবে)
♫♪আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি
আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি।
বাজে কিনিকিনি রিনিঝিনি
তোমারে যে চিনি চিনি
মনে মনে কত ছবি এঁকেছি।।
ছিলো ভাবে ভরা দুটি আঁখি চঞ্চল
তুমি বাতাসে উড়ালে ভীরু অঞ্চল।
ওই রূপের মাধবী মোর সংশয়ে রেখেছি।।
(যেন) কস্তুরী মৃগ তুমি
আপন গন্ধ ঢেলে
এ হৃদয় ছুঁয়ে গেলে
সে মায়ায় আপনারে ঢেকেছি।
ওই কপোলে দেখেছি লাল পদ্ম
যেন দল মেলে ফুটেছে সে সদ্য।
আমি ভ্রমরের গুঞ্জনে তোমারেই দেখেছি।।♫♪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর
লেখক বলেছেন: অনেক পাঠকই গল্পটা পড়েছে, তবে কেউ মন্তব্য করেনি, আপনিই প্রথম। খুব ভালো লাগলো আপনার মন্তব্য পেয়ে। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
লেখক বলেছেন: অনেক দিন পর গল্পটি কেউ পড়লো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আমার অনেকগুলো লেখাই অসমাপ্ত পড়ে আছে। সময় হলেই লিখে ফেলবো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আমার অনেকগুলো লেখাই অসমাপ্ত পড়ে আছে। সময় হলেই লিখে ফেলবো।
আলোচিত ব্লগ
ভারতীয় পতাকার অবমাননা
বাংলাদেশের ২/১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় পতাকার অবমাননা আমার কাছে ছেলেমী মনে হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে প্রচন্ড রকমের ভারত বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে।
কিন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভিসা বন্ধ করায় ভারতকে ধন্যবাদ।
ভারত ইদানীং ভিসা দিচ্ছেনা; তারা ভিসা না দিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়! তাদের করদ রাজ্য হাতছাড় হওয়া খুবই নাখোশ, এতোই নাখোশ যে মোদী মিডিয়া দিনরাত বয়ান দিচ্ছে এই দেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতের চিকিৎসা বয়কট এবং
ভারতের এক হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কোন রুগিকে তারা চিকিৎসা দিবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে হাসপাতাল থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ
চামচা পুঁজিবাদ থেকে দেশ চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র করেছে।
সোমবার... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে তবে............
শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বিচারের জন্য ভারতের কাছে ফেরত চাইতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে প্রতিহিংসামূলক বিচারপদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিচারে শেখ হাসিনা যাতে ন্যায় বিচার পান বাংলাদেশকে আগে তা নিশ্চয়তা... ...বাকিটুকু পড়ুন
১. ১৬ ই জুন, ২০১৩ সকাল ১০:০২ ০
বাহ্ ! খুব ভালো লাগলো গল্পটি পড়তে। গল্পের সাথেই থাকার চেষ্টা করবো।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।