সুরভি'র সাথে প্রথম দেখা হওয়ার গল্পটা আজ বলব।
টানা তিন মাস সুরভি'র সাথে শুধু ফোনে কথা হলো। এর মধ্যে একদিনও আমরা দেখা করিনি। সুরভি মুগ্ধ হয়ে আমার কথা শুনতো! রাত বারোটা থেকে আমাদের কথা শুরু হতো। ভোর হয়ে যেত তবু আমাদের কথা শেষ হতো না। বেশির ভাগ কথা আমিই বলতাম। সুরভি চুপ করে শুনতো। আমার তো কথা বলার বিষয়ের অভাব নেই। ধর্ম নিয়ে কথা বলি, রাজনীতি নিয়ে কথা বলি, সাহিত্য নিয়ে কথা বলি, মুভি নিয়ে কথা বলি। আমি যে গল্পই করি সুরভি মুগ্ধ হয়ে শুনে! বলতে দ্বিধা নেই- আমি কথা বলে, যে কাউকে মুহূর্তের মধ্যে আপন করে নিতে পারি। অতি তুচ্ছ একটা গল্পও আমি এমনভাবে উপস্থাপন করি- সুরভি এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে শূনে। অদ্ভুত একটা কথাও এমন ভাবে বলি, সুরভি ছোট বাচ্চাদের মতো করে জিজ্ঞেস করে তারপর কি হলো? তারপর? একটা উদাহরন দেই-
একদিন দুপুরবেলা সুরভিকে ফোন করে বললাম- তোমাদের বাসায় আজ কি রান্না হয়েছে?
তুমি খেতে আসবে?
অবশ্যই খেতে আসবো।
সুরভি মন খারাপ করে বলল- আজ আমাদের বাসায় কিছুই রান্না হয় নাই। আমি ছাড়া বাসায় সবাই এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছে।
আমি বললাম, তাহলে চট করে একটা ডিম তো বেজে দিতে পারবে? সাথে দু'টা শুকনা মরিচ তেলে ভেজে দিও। আর আচার হিসেবে যদি একটা চুমু...
সুরভি বলল, তুমি আসো। আমি যা পারি করছি।
আমি জানি, সুরভি অনেক কিছু আমার জন্য রান্না করে অপেক্ষা করে আছে। ঝটপট রান্না করার এক অলৌকিক ক্ষমতা সুরভি'র আছে। দুপুর পার হয়ে বিকেল হয়ে গেল- আমি যাই না। সুরভি ফোন করে, ফোনও ধরি না। মনে মনে হিমুর মতো ভাবি- সুরভি'র সাথে দেখা করার সময় এখনও হয়নি। তবে দেখা যথাসময়েই হবে। যাই হোক, এই রকম নাটক অসংখ্য বার আমি করেছি। যতবার বলেছি- রান্না করো, আমি আসছি। তত বারই সুরভি আমার জন্য রান্না করে অপেক্ষা করেছে। আমি যাইনি। আমি যা'ই বলি- সুরভি বিশ্বাস করে। পরে কোনো কিছু একটা বুঝিয়ে বলে দেই খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে।
একটা ঘটনা বলি- রাত তখন তিনটা। আমি সুরভি'র বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সুরভিকে ফোন দিলাম। ইচ্ছা করে আমি পরিস্থিতিটা এমন করলাম- কিছুক্ষন কথা বলার পরেই সুরভি নিজেই বলল- তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
আমি বললাম, তাহলে বেলকনিতে এসে দাঁড়াও আমাকে দেখতে পাবে।
সুরভি দৌড়ে বেলকনিতে আসলো।
আমি দূর থেকে হাত ইশারা করলাম।
অপ্রত্যাশিত এক আনন্দে সুরভি কান্না করে দিল।
ঘটনাটা কিভাবে ঘটালাম এখন সেটা বলি। আমার এক বন্ধুকে আগেই বলে রেখেছিলাম- বাইক নিয়ে রেডি থাকিস। রাতে কিছুক্ষনের জন্য এক জাগায় যাবো। রাত দুই টায় সুরভিকে ফোনে বললাম- তুমি অপেক্ষা করো। আমি কিছুক্ষন পর তোমাকে ফোন করছি। এই কিছুক্ষনের মধ্যে আমি চলে গেলাম সুরভি'র বাসার সামনে। এই রকম নানান রকম কর্মকান্ড করেছি। কতবার যে সুরভিকে চমকে দিয়েছি! সুরভি বলে- একদিন তুমি আমাকে হুট করে চমকে দিয়ে মেরেই ফেলবে।
কথা বলতে বলতে সুরভি ঘুম, আমিও ঘুম- কতবার যে এমন হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একদিন রাতে কথা শেষ করে ঘুমোতে যাবার আগে সুরভিকে অবাক করে দিয়ে বললাম- আগামীকাল তোমার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে। সকাল ১১ টায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে থাকবে। সুরভি প্রচন্ড অবাক! তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ফোন কেটে দেই।
সুরভি ঠিকই ১১ টায় ৩২ নম্বরে এসে পড়েছে। তখন আমি একটা হাফ প্যান্ট পড়ে আমার বাসার সামনে একটা চায়ের দোকানে আরাম করে বসে চা খাচ্ছি। সুরভি ফোন দিল, তখন মনে পড়লো আজ সুরভি'র সাথে দেখা করার কথা। হাফ প্যান্ট পড়েই ছুটলাম আমি। সেদিন রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। আমি একবার সিএনজি'তে, একবার বাসে, একবার পায়ে হেটে, একবার রিকশায়। আড়াই ঘন্টা পর দুপুর দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে যেতে সক্ষম হলাম। সুরভি আমাকে দেখেই হেসে ফেলল। আমি কসম খেয়ে বলতে পারি- মোনালিসার হাসিও এত সুন্দর না।
অনেকদিন আগে সুরভিকে কথায় কথায় বলেছিলাম, আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হবে- সেদিন তুমি নীল শাড়ি পড়বে, চোখে মোটা করে কাজল দিবে, দুই হাত ভরতি থাকবে কাঁচের চুড়ি আর কপালে একটা বড় টিপ। সুরভি ঠিক সেভাবেই সেজে এসেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে সুরভিকে আড় চোখে দেখছি। সুরভি বলল- লুকিয়ে দেখার দরকার নেই। এখন ভাবতেও লজ্জা লাগে, আমি একটা মেয়ের পাশে ধানমন্ডি লেকে হাফ প্যান্ট পড়ে হাটছি। রাস্তার সব মানূষ আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
সুরভিকে এমনভাবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে একটা গল্প বানিয়ে বলেছি- যেন হাফ প্যান্ট পড়ে আসাটাই স্বাভাবিক এবং আড়াই ঘন্টা দেরী করাটাও স্বাভাবিক। অন্য কেউ হবে পাঁচ ঘন্টা দেরী করতো। আমি বলেই দ্রুত আসতে পেরেছি। মনে মনে নিজেকে বাহবা দেই। মিথ্যা বলাটাও একটা আর্ট। সবাই সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না। তাছাড়া আমি কালো মিথ্যা বলি না। আমি বলি সাদা মিথ্যা। কালো মিথ্যায় মানুষের ক্ষতি হয়। সাদা মিথ্যায় কারো ক্ষতি হয় না, বরং আনন্দ পাওয়া যায়। সাদা মিথ্যায় পাপও হয় না।
তিন টায় আমরা দুপুরের খাবার খাই। খাবারের বিল সুরভি'ই দিল। ধানমন্ডি আসতে গিয়ে, বাস-রিকশা- সিএনজি করতে গিয়ে আমার পকেট খালি। তাছাড়া আমি তো প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। হুট করে রাস্তা থেকেই চলে আসছি। অবশ্য আমি সেদিন সুরভিকে বলেছিলাম- আজ তুমি আমাকে খাওয়ালে। এই জন্য আমি তোমাকে একশ' দিন খাওয়াবো। আমি কথা দিলে কথা রাখি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:২৯