ব্লাডি মেরি পশ্চিমা দেশগুলোর পুরনো একটি ব্ল্যাক ম্যাজিক গেম। অন্ধকার বাথরুমে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ১৩ বার মন-প্রাণ দিয়ে উচ্চারণ করতে হয় ‘ব্লাডি মেরি...ব্লাডি মেরি... ব্লাডি মেরি...’। ফিস ফিস করে এ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। তার পর নাকি আয়নায় ফুটে ওঠে এক বিকৃত নারী-অবয়ব।
পশ্চিমা দেশগুলোর টিন এজ মেয়েদের মধ্যে বহু পুরনো একটি রেওয়াজ হলো ‘স্লাম্বার পার্টি’। বাবা-মায়ের কাছ থেকে একরাতের জন্য ছুটি নিয়ে মেয়েরা সমবেত হয় কোনো এক বন্ধুর ফাঁকা বাড়িতে। সেখানে তারা আড্ডা মেরে রাত কাটায়। নেহাতই নিরীহ একটি ব্যাপার। বাবা-মাও মেয়েদের এই নিশিযাপনে উৎসাহ দেন। এই প্রথা দীর্ঘকাল ধরেই ইউরোপে চলে আসছে। তাদের কাছে ‘স্লাম্বার পার্টি’ মেয়ের বড় হয়ে ওঠার একটি ধাপ।
আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা যত নিরীহ বলে মনে হয়, সব স্লাম্বার পার্টি তেমনটা নয়। টিন এজ মেয়েরা বয়ঃসন্ধির কৌতূহলে এমন কিছু কাণ্ড ঘটায়, যা মাঝে মাঝে বিপদ ডেকে আনে। এসব বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়াও কষ্টকর হয়ে ওঠে। অনেক সময়েই মেয়েরা এই রাত-কাটানোর খেলায় না জেনেবুঝেই প্র্যাকটিস করতে শুরু করে কিছু নিষিদ্ধ খেলা, যার মধ্যে ‘সামনিং অফ ব্লাডি মেরি’ অন্যতম।
প্যারানর্মাল-বিদরা অনেকেই তাদের অ্যাকাউন্টে ব্লাডি মেরি-র পজিশনের কথা লিখেছেন। জনপ্রিয় সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার একটি গল্পে ব্লাডি মেরি পজিশনের এক ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে আয়না-নগরীর বাসিন্দা ব্লাডি মেরি তার আহ্বায়িকাকে গ্রাস করে এবং সেই বাড়িতে ঘটতে থাকে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। ব্লাডি মেরি পজিশন-কে কেন্দ্র করে হলিউডে বেশ কয়েকটি সিনেমাও বানানো হয়েছে। ১৯৮৮-এর ‘বিটলজুস’, ২০০৬-এর ‘ব্লাডি মেরি’ তার মধ্যে অন্যতম।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, ইংল্যান্ডের রানী প্রথম মেরি (১৫১৬-১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন রাজা অষ্টম হেনরির কন্যা। মেরি ইংল্যান্ডে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের অসংখ্য অনুসারীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে ব্লাডি মেরি নামে কুখ্যাত হন। যে কারণে ব্লাডি মেরির ৬ বছরের শাসনকালটিকে (১৫৫৩-১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দ) ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একটি কলংকজনক অধ্যায় বলে মনে করা হয়।
রানী মেরির ৪২ বছরের জীবনটিও ছিল হঠকারী সিদ্ধান্তে পরিপূর্ণ। ৩৬ বছর পর্যন্ত অবিবাহিত ছিলেন তিনি। তারপর স্পেনের যুবরাজ ফিলিপকে বিয়ে করেন। স্বামীর নির্দেশে তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে ফ্রান্সের কাছে ইংল্যান্ড তার ভূখণ্ড হারায়।
রানী মেরি এক পরিপূর্ণ ব্যর্থতার নাম। তার জীবনের কোনো স্বপ্নই সার্থক হয়নি। এমন কী কোনো উত্তারাধিকার না রেখেই মৃত্যুবরণ করেন ওই ধর্মান্ধ রক্তপিপাসু রানী। মেরির হাত প্রোটেস্টান্টদের রক্তে রঞ্জিত হলেও মৃত্যুর পর তার সৎ বোন রানী প্রথম এলিজাবেথ ইংল্যান্ডে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনেন।
তিনিই সেই ব্লাডি মেরি তিনি কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে ব্লাডি মেরি যিনিই হোন না কেন, তার এই মিথের পিছনে আসলে কি কোনো সত্যতা আছে? পশ্চিমের অনেক নারীই দাবি করেন, কম বয়সে তারা ব্লাডি মেরি রিচুয়াল প্র্যাকটিস করেছেন। অনেকেই জানান, মোমের আলোয় বাথরুমের আয়নায় তারা স্বচক্ষে দেখেছেন ফ্যাকাশে, বিকৃত এক নারী-অবয়বকে।
মনোবিদরা অবশ্য এর অন্য ব্যাখ্যা দেন। ইতালির মনোবিদ জিওভানি ক্যাপুতো এমন ৫০ জন মেয়ের উপরে সমীক্ষা চালান, যারা ব্লাডি মেরিকে দেখেছেন বলে দাবি করেন। তাদেরকে তিনি আয়নার দিকে ১০ মিনিট একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে বলেন। তাদের বেশির ভাগই হয় নিজেদের মুখকে বিকৃত অবস্থায় দেখেন, নয়তো কোনো অপরিচিত বিকৃত মুখচ্ছবি আয়নায় ফুটে উঠতে দেখেন।
কাপুতো জানান, চোখের নিউরন-ঘটিত সাময়িক সমস্যাই এই ‘বিকৃতি’-র জন্ম দেয়। তা ছাড়া, টিন এজ মেয়েদের কল্পনাপ্রবণতা তো রয়েছেই।
কিন্তু প্যারানর্মাল-বিদেরা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। তারা এক অতৃপ্ত আত্মার কথা বলেন, যিনি আয়নার ভিতরে কোনো রহস্য নগরীর বাসিন্দা। আত্মাটি নিজের বন্দিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তাকে জাগাতে প্রয়োজন আবছায়া আলো, বাথরুমের ঝাপসা আয়না আর একাগ্র চিত্তে ১৩ বার ডাক ‘ব্লাডি মেরি... ব্লাডি মেরি... ব্লাডি মেরি...
[ছবি ও তথ্য : সংগৃহিত]