উইকিপিডিয়াতে কাজ করতে করতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা নিবন্ধটি ভালো করে পড়ছিলাম। ওখানে, এবং আরো অনেক স্থানে গর্ব করে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ একমাত্র কবি, যাঁর লেখা গান দুইটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে মর্যাদা পেয়েছে।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অন্য গান, "জন গণ মন" (যা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত) এর উপরে লেখা নিবন্ধটা পড়তে গেলাম। নিবন্ধে পেলাম ভারত সরকারের ওয়েবসাইটের একটা লিংক। কৌতুহলবশতঃ খুলে দেখলাম। কিন্তু একী! ভারত সরকারের দাবী, ১৯৫০ সালের ২৪শে জানুয়ারি তারিখে এই গানটির "হিন্দি সংস্করণ" ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়!!
The song Jana-gana-mana, composed originally in Bengali by Rabindranath Tagore, was adopted in its Hindi version by the Constituent Assembly as the National Anthem of India on 24 January 1950.
রবীন্দ্রনাথ আবার হিন্দি লিখলেন কবে? ঘাবড়ে গেলাম। চিরকাল পড়ে এসেছি, "জন গণ মন" গানটি বাংলাতে লেখা, ওটা আবার হিন্দি হয়ে গেলো কবে? ভাবলাম, হয়তোবা আমার জানাতে সমস্যা আছে, পালটে গেলেও যেতে পারে। তাই ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের অফিশিয়াল সংস্করণ বের করলাম - বাংলাতে লিখলে যা দাঁড়ায়
জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে
ভারত ভাগ্য বিধাতা
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা
দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা
উচ্ছল জলধি তরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে
তব শুভ আশিস মাগে
গাহে তব জয়গাথা
জন গণ মঙ্গল দায়ক জয় হে
ভারত ভাগ্য বিধাতা
জয় হে, জয় হে, জয় হে,
জয় জয় জয়, জয় হে॥"
চোখে আমার এখনো চশমা লাগেনি, কিন্তু তার পরেও সন্দেহ হতে লাগলো চোখ খারাপ হয়েছে, কেননা এর মধ্যে কোনো "হিন্দি" তো খুঁজে পেলাম না। রবীন্দ্র রচনাবলীও ঘেঁটে দেখলাম, দাড়ি কমা শুদ্ধ একই দেখাচ্ছে।
তাহলে ঘটনা কী? আসল ঘটনা জানতে আমার এক বন্ধু আর আমি ঘাঁটতে শুরু করলাম, ভারতের সাংবিধানিক সংসদের আলোচনার পূর্ন বিবরণ। পুরা বিবরণী ঘেঁটে বের করলাম, মূল সিদ্ধান্তটি -
CONSTITUENT ASSEMBLY OF INDIA - VOLUME XII
Tuesday, the 24th January 1950
The Constituent Assembly met in the Constitution Hall, New Delhi, at Eleven of the Clock, Mr. President (The Honourable Dr. Rajendra Prasad), in the Chair.
TAKING THE PLEDGE AND SIGNING THE REGISTER
The following Members took the Pledge and signed the Register :-
Shri Ratnappa Bharmappa Kurnbhar (Bombay States).
Dr. Y. S. Parmar (Himachal Pradesh).
STATEMENT RE: NATIONAL ANTHEM
Mr. President: There is one matter which has been pending for discussion, namely the question of the National Anthem. At one time it was thought that the matter might be brought up before the House and a decision taken by the House by way of a resolution. But it has been felt that, instead of taking a formal decision by means of a resolution, it is better if I make a statement with regard to the National Anthem. Accordingly I make this statement.
The composition consisting of the words and music known as Jana Gana Mana is the National Anthem of India, subject to such alterations in the words as the Government may authorise as occasion arises; and the song Vande Mataram, which has played a historic part in the struggle for Indian freedom, shall be honoured equally with Jana Gana Mana and shall have equal status with it. (Applause). I hope this will satisfy the Members.
উপরে কোথাও কি লেখা আছে, গানটাকে হিন্দিতে অনুবাদ করে তবেই জাতীয় সঙ্গীত করতে হবে? অনেক চেষ্টা করেও এরকম কোনো সিদ্ধান্ত খুঁজে পেলাম না।
এর পর কৌতুহল মেটাতে দ্বারস্থ হলাম, ভারতীয় বাঙালিদের। সবাই, প্রথমেই আকাশ থেকে পড়েন, আর বলেন এরকম মোটেও সম্ভব না, আর এহেন আজগুবি কথা কোথায় শুনেছি। জবাবে ভারত সরকারের ওয়েবসাইট এবং আরো অনেক প্রচারণার লিংক যখন দেই, তখন তাঁদের বিশ্বাস হয়, আর তখন জাতীয় সঙ্গীত কেনো হিন্দিতেই হওয়া উচিৎ, এই কথা বলেন অনেকে।
কিন্তু হাজারো প্রশ্নের পরেও জবাব পাইনা,
* আসল গানটার সাথে একটি শব্দে বা বাক্যেও কি ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের পার্থক্য আছে?
* গানটার যদি শব্দ, বাক্য ও ব্যকরণ না পালটায়, তাহলে "হিন্দি সংস্করণ" বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
কেউ কেউ বলেন, ভারতের হিন্দিভাষীরা বাংলা উচ্চারণ করতে পারেনা, তারা তাই নিজেদের মতো করে গানটার বাংলা শব্দ গুলো বলে, আর সেটাই "হিন্দি অনুবাদ"।
কিন্তু, প্রশ্ন জাগে, আমি যদি আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত বা মাইকেল জ্যাকসনের কোনো পপ গান গাই আমার বাঙালি উচ্চারণে, তাহলে কি ঐ গানটা বাংলা গান হয়ে যাবে?
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জনমানসের এক বিশাল অংশ। এই রবীন্দ্রনাথের লেখা বাংলা গানকে হিন্দি বানানোর অপচেষ্টা দেখে বাঙালি হিসাবে খুব খারাপ লেগেছে। আসুন, এই অপচেষ্টার প্রতিবাদ জানাই। যারা ভারতীয় বাঙালি, তাঁদের অনুরোধ করি, রবি ঠাকুরের গান এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে আপনারা সোচ্চার হন। বীর বাঙালি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে রক্ত দিয়েছে। সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসাবে এ যুগের বাঙালিদের অন্ততঃ এই প্রতিবাদটুকু করা উচিৎ।
(একটা কথা খোলাসা করতে চাই, ভারত সরকার যদি সত্যি কথা বলতো, যদি ১৯৫০ সালের ঐ সম্মেলনে আসলেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতেন যে গানটাকে হিন্দি করে তবেই জাতীয় সঙ্গীত করা হবে, তাহলে সমস্যা ছিলো না কোথাও। কিন্তু ঐ রকম সিদ্ধান্ত কোনোদিনই নেয়া হয়নি। বরং গোপনে গোপনে হিন্দির দৌরাত্তে বাংলার অবমাননা বাড়ার সাথে সাথে এই মিথ্যাচারটুকু এখন সরকারী প্রচারণার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে দূতাবাস - সর্বত্র এই কথা ফাটিয়ে প্রচার করা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এই গানটা হিন্দি। যেন, জাতীয় সঙ্গীত বাংলাতে হওয়াটা "সর্বভারতীয় চেতনা"র পরিপন্থী। বাংলা যেন অচ্ছ্যুৎ একটা ভাষা!!)
আবারো আহবান জানাই, আসুন, এই অপচেষ্টার প্রতিবাদ জানাই। বাংলা গানকে, বাংলা সংস্কৃতিকে অবমাননা করার, রবীন্দ্রনাথের গানকে বিকৃত করার এই হীন প্রয়াস অত্যন্ত নিন্দনীয়।