এত দিন সাধারন জাপানিজদের জীবনযাপন বা কালচার নিয়ে লিখছিলাম। আজ ভাবছি এখানকার ইউনিভার্সিটিগূলোর ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে কিছু লিখব। এই কাজটা আগের গুলোর তূলনায় কিছুটা কঠিন/রিস্কি, কারণ বাংলাদেশ থেকে জাপানে যত মানুষ আসে তার সিংহভাগই আসে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করতে, তাদের প্রত্যেকের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে পারে। আমি শুধু আমার দেখা/শোনা কয়েকটি উইনিভারসিটির অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণনা করব।
দেশের ২ টা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ৯ বছর পড়েছি, আর ২ টা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ৬ বছরের বেশী পড়িয়েছি। সো, বাংলাদেশের সব ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে। জাপানে আসার পর ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ঢুকে আমার প্রথমে যেটা মনে হয়েছিল সেটা হচ্ছে, হয় আমরা ইউনিভার্সিটির সংজ্ঞা পাল্টিয়ে ফেলেছি অথবা ওরা! আমাদের দেশের ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের সাথে এখানকার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! কোথায় মিটিং মিছিল! কোথায় গ্রুপ বেঁধে আড্ডা দেওয়া! কোথায় জোড়ায়-জোড়ায় বসে থাকা! এতো দেখি বড় কোন কর্পোরেট অফিসের মত!
প্রথমে গেইট থেকে শুরু করি; আপনি যত বড় মানুষই হোন না কেন আপনাকে গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে, দারোয়ানকে ক্যাম্পাসের পার্কিংযের পারমিশন দেখিয়ে, মাথা ঝুকিয়ে তাকে সম্মান দেখিয়ে ঢুকতে হবে, বের হওয়ার সময়ও একই নিয়ম। এটা আমার কাছে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হলো কেন? তাহলে একটা গল্প বলি শোনেনঃ আমি যেখানে পড়াতাম, সেই ইউনিভার্সিটিতে আইডি কার্ড দেখিয়ে প্রবেশের নিয়ম ছিল। সেটা প্রয়োগ করতে গিয়ে কত যে সমস্যায় পড়তে হয়েছে তার ইওত্তা নেই। শিক্ষকদের কাছে আইডি কার্ড চাইলে তাদের সম্মানে (!) লেগে যেত আর স্থানীয় মাস্তান ছাত্রদের কাছে চাইলে তো রক্ষা নেই! একবার এলাকার এক বড় মাস্তানের কাছে আইডি দেখতে চাওয়ার অপরাধে বেচারা গার্ডকে ধরে নিয়ে উত্তম মাধ্যম দিয়ে শুধু জাংগিয়া পরিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল সেই মাস্তানের সাঙ্গপাংগরা!
এবার আসি ক্যাম্পাসে; আমি যে ইউনিতে পড়ি সেটা জাপানে র্যাঙ্কিং ২/৩ এর মধ্যে (চাঞ্ছে ভাব লইয়ে লইলাম ), এর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ও অনেক, কিন্তু শুধু লাঞ্চের সময় ছাড়া ক্যাম্পাসে মানুষের দেখা পাওয়া দুষ্কর। প্রথম প্রথম ভাবতাম এত লোক থাকে কোথায়! সব যার যার ল্যাবে বা ক্লাশে। ক্যাম্পাসে দল বেঁধে আড্ডা দেওয়া বা চায়ের দোকানে বাকি খাওয়ার মজা এরা বুঝল না, আফসোস! ক্যান্টিনে আড্ডা মূলত বিদেশিরা যার যার গ্রুপে বসে দেয়, জাপানিজরা মাঝে মধ্যে খেতে বসে গল্প করে যার অধিকংশ থাকে তাদের কাজ নিয়ে আলাপ। পারতপক্ষে ওরা আমাদের টেবিলে বসতে চায় না, আর বসলেও আমরা এমন ভাবে হৈ হুল্লড় করতে থাকি যেন বেচারা কোনমতে খেয়ে উঠতে পারলে বাচে! দেশের ইউনি গুলোতে ক্যান্টিনে খাওয়ার দাম সাধারণত কম থাকে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে মান খারাপ। কিন্তু এখানের ক্যান্টিনে বরং বাইরের চেয়ে খাবারের দাম বেশী। ফাও/বাকি খাওয়া?? সেটা আর না বলি ... প্রচুর সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী এখানে লাঞ্চের সময় পার্টটাইম চাকুরী করে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল, জাপান সরকার প্রচুর বিদেশী স্টুডেন্টদের স্কলারশিপ দিয়ে পড়ালেও জাপানী স্টুডেন্টদের জন্য স্কলারশিপ খুবই কম! ছাত্রছাত্রীদের অধিকংশ পড়ে বাবার টাকায় বা পার্টটাইম জব করে। এই নিয়ে ওরা নাকি ভিতরে ভিতরে আমাদের হিংসা করে! আর জাপানে পড়ার খরচ এবং লিভিং খরচ এত বেশী যে দেশ থেকে টাকা এনে বা এখানে পার্ট টাইম করে পড়াশুনা করা বলতে গেলে অসম্ভব!
ক্যাম্পাসে প্রেম পিরীতি?? আগে কোন একটা পোষ্টে বলেছিলাম জাপান ফ্রি সেক্সের দেশ হলেও এরা প্রকাশ্যে প্রেমিক/প্রেমিকার সাথে হাত ধরাধরি করে হাটেও না, জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকাতো কল্পনাও করা যায় না। এখানে সাধারণত ছেলে মেয়ে একসাথে আড্ডাও দেয় না, ছেলেরা ছেলেদের সাথে মেয়েরা মেয়েদের সাথে। কারো সাথে কারো প্রেম থাকলে তার আদান-প্রদান বাসায় বা পার্টিতে, ক্যাম্পাসে বা রাস্তাঘাটে নয়! এদের ক্লাসমেটদের মধ্যে বন্ধুত্বও অনেকটা ফরমাল। স্টুডেন্ট লাইফে আমরা যেমন বন্ধুদের সাথে হই-হুল্লোড় করতাম, উলাটাপাল্টা নাম ধরে ডাক্তাম, এক সাথে গলা ছেড়ে গান গাইতাম ... এর কিছুই নেই এদের মাঝে। বরং, বন্ধুর সাথেও এরা অনেক বেশি ফরমালিটিজ দেখায়, বিনয় দেখায়। যেমন, একজন আরেকজনকে দরজা খুলে দিয়ে আগে যেতে অনুরোধ করা, একসাথে লিফটে উঠলে সামনে যে থাকবে সে বাটন টিপে সবার নামার পরে নামা, লিফটের মাঝে কোথাও নামলে বের হওয়ার সময় ক্লোজ বাটন টিপে যাওয়া, ল্যাবে ডূকে সবাইকে ওহাইও (শুভ সকাল) বলা, যাওয়ার সময় উস্কারে সামা ... (সরি, তোমার আগে আমাকে যেতে হচ্ছে) ইত্যাদি বলা।
ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি?? সেটা এদের ডিকশনারিতে নেই! শিক্ষকদের মধ্যে কম্পিটিশন আছে, কিন্তু সেটা মূলত রিসারস রিলেটেড। অন্য গ্রুপের ছাত্রকে নম্বর কম দিয়ে সেই শিক্ষক কে টাইট দেওয়া বা কোন ছাত্রকে শিক্ষক বানানোর জন্য বেশী নম্বর দিয়ে ফাস্ট বানানো – এসব জিনিষ আমাদের ব্রেইনের যে সব সেলে থাকে, এদের মাথায় সে সব সেল ই নেই!
আমাদের ইঞ্জিনিয়রিং ফ্যাকাল্টিতে (৪+২) বছরে অনার্স, মাস্টার্স, যার মধ্যে ৩ বছর কোন না কোন ল্যাবের সাথে কাজ করতে হয়। খুব কম সংখ্যক ছাত্র পি এইচ ডি করতে চায়। সাধারণত ১ বছর বাকি থাকতেই এদের চাকুরী হয়ে যায়, জব ফেয়ারের মাধ্যমে। এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা আমাদের মতই, তবে এরা যে যেটা নিয়ে কাজ করে সে সম্পর্কে খুব ভাল জানে, অন্য বিষয়ে গ্যান ততধিক কম। এমন অনেক বার হয়েছে যে কাওকে ক্যাম্পাসের কোন বিল্ডিং কোথায় সেটা শুনলাম সে সাথে সাথে তার ফোন বের করে ইন্টারনেটে ম্যাপ খুজা শুরু করে দিল! বহির্বিশ্ব সম্পর্কেও এদের জানা খুব কম, এমন অনেক স্টুডেন্ট আছে যারা বাংলাদেশ কোথায় সে সম্পর্কে সামান্যতম ধারনা নেই। এদের আর একটা জিনিষে ভয়ঙ্কর দুর্বলতা, সেটা হলো ইংলিশ! ৯০ ভাগের বেশী ছাত্র-ছাত্রী, এমন কি অনেক প্রফেসরও ইংলিশে কথা বলতে পারে না।
এবার যথারীতি বিজ্ঞাপন বিরতী
----------------------------------------------------------
সাধারণ জাপানিজদের আচার ব্যবহার নিয়ে লেখা আমার পূর্বের ব্লগ গূলোঃ
জাপানিজঃ আজব এক জাতি !!!
গাড়ীর হর্ন ঃ জাপানীজ স্টাইল !!! (২)
নিরবাচনী প্রচারণা ঃ জাপানীজ স্টাইল (৩)
ময়লা ফেলা ঃ জাপানীজ স্টাইল (৪)
জাপানীজ ওন্সেন বা গন গোছল (৫)
জাপানিজদের ধর্ম পালন (৬)
জাপানীজদের কুকুর প্রীতি এবং আদিম নিসংসতা! (৭)
-------------------------------------------------------------
ল্যাবের ব্যাপার টা বলা মুশকিল! ল্যাব নির্ভর করে প্রফেসরের উপর। তবে একটা জিনিষ কমন, ডিউটি/কাজ ফাস্ট, পরে অন্য বিষয়। জাপান থেকে ডিগ্রি নিয়ে গেছে অথচ খুব বেশী জানে না এটা হয়ত অনেক ক্ষ্রেত্রে সত্য, কিন্তু কম পরিশ্রম করে গেছে এটা অসম্বব। জাপানিজদের একটা জিনিষ দিয়ে খুশি করা যায়, তা হলো পরিশ্রম! আপনাকে দিয়ে জোর করে পরিশ্রম না করালেও আপনি নিজেই সেটা করবেন, কারণ আপনার সামনে দেখবেন আপনার প্রফেসর আপনার থেকে অনেক বেশী পরিশ্রম করছে। প্রফেসররা অপছন্দ করেন আনপোলাইট ব্যাবহার, অসততা আর মাতবরী। জাপানে প্রফেসরেরা যত সিনিয়র হন তত বেশী পরিশ্রম করে্ন, যা আমাদের দেশ সহ অনের দেশ হতে উল্টো। এখানে অসংখ্য প্রফেসর আছে এমন যাদের ফ্যামিলি লাইফ বলে কিছু নেই। বছরের ৩৬০ দিনের বেশি তারা সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত ল্যাবে থাকে। অনেকে আছে রাত ১২ টার সময় বাসায় গিয়ে স্টুডেন্টদের সাথে মেইলে রিসারস নিয়ে ডিসকাশন শুরু করে, তা চলে ভোর পর্যন্ত; পরদিন আবার ৯টার আগে ল্যাবে হাজির! নিজেরা যেমন ফ্যামিলিকে কাজের মধ্যে নিয়ে আসে না, তেমনি অন্য কারো ফ্যামিলি কাজের জন্য বাঁধা হোক সেটাও চায় না। বউ হসপিটালে ডেলিভারি কেইস এ ভর্তি হয়েছে, ছুটি চাইলে বলে, তুমি কি ডাক্তার? ওখানে গিয়ে কি করবা? এমন অনেক উদাহরন আছে। এক সিনিয়র ভাই এখানে ৪ বছর একা ছিলেন, এক বাচ্চা সহ ভাবী থাকতেন দেশে, প্রফেসর বউ আনা পছন্দ করতেন না তাই আনতে পারতেন না। একবার তিনি তাঁর প্রফেসরের কাছে গিয়ে একটু অনুনয় বিনয় করছেন, প্রফেসর তাকে বললেন, বউ এনে কি করবা, তোমার দরকার হয় এখানে একটা বিয়ে করে নাও! উনি কথাটা রেগে গিয়ে বা মজা করে বলেননি, সিরিয়াসলী বলেছিলেন। অবশ্য, সংসারী ভাল প্রফেসরও আছেন। আল্লাহর রহমতে আমার ভাগ্যে ভাল মানুষ পড়েছে; উনি তাঁর বাসায় আমার ফ্যামিলি সহ একাধিক বার দাওয়াত দিয়েছেন, আমাদের বাসায় এসেছেন; মাঝে মধ্যে আমার ফ্যামিলির খোজ-খবর নেন।
যায় হোক, আমরা বাঙ্গালিরা এক সাথে বসলে অনেকে জাপান বা জাপানের ল্যাব নিয়ে অনেক অসন্তুষ্টির কথা বলেন। জাপানিজরা যে ক’টা টাকা দেয় তা আমাদের দিয়ে খাটিয়ে উসুল করে নেই! জাপান স্কলারশিপ দিয়ে আমাদের মেধাগুলোকে কিনে নিয়ে ওদের উন্নতি তে লাগাচ্ছে! নন-ন্যাটিভ দেশে ডিগ্রি করতে এসে জীবনটাই বরবাদ, ইউরোপ আমেরিকা গেলে কত ভাল হতো! ইত্যাদি ইত্যাদি... আমি সাধারণত এসব আলচনায় চুপচাপ থাকি। কারণ আমি চিন্তা করি জাপান আমাকে বলতে গেলে নিঃস্বার্থ ভাবে অনেক দিয়েছে, শুধু আমাকে নয় আমার ফ্যামিলিকে ৫ বছর যথেষ্ট সচ্ছল ভাবে ভরণপোষণ দিয়ে রেখেছে, আমাকে ফ্রি পড়াচ্ছে, ডিগ্রি দিচ্ছে ... সেই তুলনায় আমি তাদের তেমন কিছুই দিতে পারছি না। আমার মেধা সেই পর্যায়ের না যে বিশাল কিছু আবিষ্কার করে জাপানকে ধন্য করে যাব। তাই আমি বিনা বিতর্কে জাপানের প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ।
দেশতো মায়ের মত, তারপরে যদি কোন দেশ কে ভালবাসতে হয়, কৃতজ্ঞ থাকতে হয়, আমার কাছে সেটা জাপান!!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৫