মহান বিপ্লবী কমরেড চে গুয়েভারা স্মরণে কিছু কথা
মহান বিপ্লবী কমরেড আর্নেস্তো চে গুয়েভারা শহীদ হন ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর। জনগণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক কমরেড চে জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৮ সালের ১৪ জুন।
ল্যাটিন আমেরিকাই শুধু নয়, গোটা বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত মুক্তিকামী মানুষের নেতা মহান বিপ্লবী কমরেড চে গুয়েভারা। কাপুরুষোচিতভাবে তাকে হত্যা করেছিল বলিভীয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য তার মৃতদেহ গুম করে ফেলেছিল তৎকালীন বলিভীয় সরকার। এতোদিন পর একটি গণকবরে পাওয়া গেছে চে'র দেহাবশেষ। আবার নতুন করে শুরু হয়েছে এই মহান নেতার জীবন, কর্ম ও মৃত্যু নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা। বিশেষ করে কমরেড চে গুয়েভারার মৃত্যু পরবর্তী পরিস্থিতির নানান দিক নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এই প্রবাদপুরুষ চে গুয়েভারা ছবি তুলতে চাইতেন না। অথচ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ছাপা হওয়া ছবির অন্যতম চের প্রতিকৃতি, দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ হিসেবে বিবেচিত।
আজ কমরেড চে গুয়েভারার ৪১ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলাদেশেও চে সংহতি নামে একটি সংগঠন তার স্মরণে ধানমণ্ডি রবীন্দ্র সরোবরে আলোচনা, আবৃত্তি ও গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমি এই বিপ্লবী মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি এবং তাদের আয়োজনকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। হয়তো সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত অনেক অনুষ্ঠানের ভিড়ে এ আয়োজন তত বর্ণাঢ্য নয়, তবুও এর গুরুত্ব অপরিসীম। চে গুয়েভারার ভাষায় বলতে হয় 'আজ আমার পরাজয়ের অর্থ এই নয় যে, কোনদিন বিজয় অর্জন করা যাবে না', অবশ্যই এই আয়োজন একদিন দারুণভাবে সফল হবে।
চে ছবি তুলতে না চাইলেও মৃত্যুর চার দশক পরও বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় আইকন মর্যাদা পাচ্ছেন তিনি। মাথায় তারকাখচিত ফৌজি টুপি, বাবরি দোলানো চুল, এলোমেলো দাড়ি-গোঁফ, হাতে জ্বলন্ত চুরুট আর দু'চোখে বিপ্লবের আগুন নিয়ে অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকা চে'র ছবি সবার কাছেই যেন চিরচেনা বিপ্লবীর প্রতিকৃতি। আর্জেন্টিনায় জন্ম নেয়া এবং একজন পেশাদার চিকিৎসক থেকে গেরিলা যোদ্ধায় পরিণত হওয়া এ বিপ্লবী কেবল ছবি নয়, কেবল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নয়, সে এখন বিপ্লবীর প্রতীক, সংগ্রামের প্রতীক। শহীদ হওয়ার ভেতর দিয়ে তার পুনরুত্থান। শহীদ হওয়ার পর বিপ্লবী আদর্শের অবিচল প্রতীক হয়েছেন চে। কিউবার পর বলিভিয়ায় বিপ্লব ঘটাতে গিয়ে ৩৯ বছর বয়সে নির্মমভাবে শহীদ হন তিনি। চে গুয়েভারার অকাতরে জীবনদান বিপ্লবের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করেছে, পরবর্তী প্রজন্মের তরুণদের।
যুগে যুগে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের প্রতীক এখন চে গুয়েভারা। চে গুয়েভারার এই অমরত্বের প্রমাণ নিতে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার দরকার নেই। তার অসম সাহস আর দোর্দণ্ড রণকৌশলে শত্রু শিবিরে তথা সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির সাথে যে শংকা ও ত্রাস জন্ম নিয়েছিল, তা প্রকাশ পেয়ে গেছে চে'র মৃতদেহ নিয়ে তাদের বাড়াবাড়ি রকমের লুকোচুরির ঘটনায়। আর সেটাই সাধারণ মানুষের মনে চে'র অবস্থান প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
অথচ চে গুয়েভারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার দোসর পুতুল সরকারগুলোর নাগপাশ থেকে ল্যাটিন আমেরিকার মানুষকে মুক্ত করতে তিনি ছুটে গেছেন, পেরু, ইকুয়েডর, কলোম্বিয়া, পানামা, কোষ্টারিকা, এলসালভাদর, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, গোটা ল্যাটিন আমেরিকার মাটিতে পড়েছে তার বিপ্লবী পদচিহ্ন। অবশেষে তাকে ধরা পড়তে হয়েছে নিজের দেশ বলিভিয়ার সাম্রাজ্যবাদী নেওটা সরকারের সৈন্যদের হাতে। সেখানেই সমাপ্তি ঘটেছে এই মহান বিপ্লবীর জীবনের। কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি তার অসাধারণ ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সংগ্রামের কথকতা।
কমরেড চে'কে নিয়ে সারা পৃথিবীতে তোলপাড় হয়েছে। কমরেড ক্যাস্ত্রো কমরেড চে'র অপোষহীন ভাবমূর্তিকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সব সময় আগ্রহী ছিলেন। কিউবার নিজের প্রয়োজনেই চে'র ভাবমূর্তিকে জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করেছেন। মার্কিন অবরোধের পরও ক্যাস্ত্রোর কিউবা এখনো আগের অবস্থানেই আছে। কবর থেকে তুলে আনা চে'র কংকাল ফিরে গেছে কিউবায়। যদিও সেখানে কোকাকোলা থেকে এ্যাডিডাস জুতো বিক্রি হচ্ছে মার্কিন ডলারে। কিউবায় চে' এখনও বিপ্লবের আদর্শ। কিউবার এই আর্জেন্টাইন বংশোদ্ভূত বিপ্লবীর মুখচ্ছবি এখন তাদের নিজেদের নেতা ক্যাস্ত্রোর মতই প্রাণবন্ত।
চে' তাই ফিরে ফিরে আসে বিপ্লবে।
তবুও জেগে থাকে এই অমর প্রাণ, দেশে দেশে বিপ্লবের প্রতীক হয়ে।
মৃত্যুর আগে চে বলেন, আমি জানি তোমরা আমাকে গুলি করে মারবে। আমি জীবিতাবস্থায় বেরুতে পারবো না। ফিদেলকে বলো এই পরাজয় বিপ্লবের শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বিপ্লবের বিজয় হবেই। সালেইদাকে (চের স্ত্রী) বলো ব্যাপারটি ভুলে যেতে, সুখী হতে বলো, বাচ্চাদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত না ঘটে, আর সৈন্যদেরকে বলো, যেন আমার দিকে ঠিকভাবে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে।
আজ লক্ষ প্রাণের আওয়াজ উঠেছে, চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়, তোমার মৃত্যু নেই যেমন মৃত্যু নেই বিপ্লবের।
তুমি জেগে আছো অমর প্রাণ।