কিংবদন্তী ঢাকার মসলিন (পর্ব-২)
কিংবদন্তী ঢাকার মসলিন (পর্ব-৩)

পরবর্তীতে মসলিন রপ্তানীর ব্যবসা প্রায় পুরোটাই করায়ত্ত করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি। তাদের রপ্তানী হত মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করতো। পলাশীর যুদ্ধের পর মসলিন সংগ্রহের জন্য গোমস্তা নিয়োগ করা হয়, যারা ছিল কোম্পানির বেতনভুক্ত কর্মচারী। এই গোমস্তারা মসলিন সংগ্রহের জন্য হয়ে উঠে নিষ্ঠুর, চালাতে থাকে অমানুষিক অত্যাচার। মসলিন তাঁতীরা দিশেহারা হয়ে উঠে এই গোমাস্তাদের অত্যাচারে। এখানে লক্ষণীয় যে, দেশীয় গোমাস্তারাই হয়ে উঠেছিলো দেশের মানুষের শত্রু।
কিন্তু মসলিনের সাথে জড়িত আমাদের দেশের প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, তাঁতীকে নানাভাবে ঠকানো হত, নির্যাতন করা হত। গরীব চাষিকে টাকা ধার দিয়ে তার কাছ হতে খুব কম দামে কার্পাস নিয়ে যেত একশ্রেনীর দেশী মানুষ। দেশী মানুষরা যারা দালাল-পাইকার হিসেবে কাজ করতো তারাও তাঁতীদেরকে ঠকাতো নানা ভাবে। গোমস্তারাতো রীতিমত অত্যাচার করতো তাঁতীদেরকে। হিসেবে দেখা যায়, আনুমানিক ১৭৪০ সালের দিকে এক টাকায় পাওয়া যেত প্রায় একমণ চাল। আর একজন তাঁতী মসলিনের কাজ করে পেত মাসে দুই টাকা, অর্থাৎ দুই মণ চালের দাম! যাতে তার পরিবারের খাবারই ঠিকমত চলতো না, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যতো অনেক দূরের কথা।
কি ভীষন ট্রাজেডি, যারা তৈরি করতেন বাংলার গর্ব-যাদের তৈরি কাপড় গায়ে উঠতো সম্রাটের, রপ্তানী হত বিদেশে, তাঁর গায়েই থাকতো না কাপড়, পেটে পড়ত না ঠিক মত খাবার। আর সবচেয়ে দুঃখজনক বোধহয় এটাই যে-এই অবিচারের পিছে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলো এ দেশেরই দালার, পাইকার আর গোমস্তারাই।
প্রচলিত আছে যে- ইংরেজরা নাকি মসলিন তাঁতীদের আঙুল কেটে ফেলতো। আবার এও শোনা যায় যে- তাঁতীরা নিজেরাই নাকি নিজেদের আঙুল কেটে ফেলতো, যাতে করে এই অমানুষিক পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিকের কাজে তাদের বাধ্য না করা হয়। তবে আঙুল কেটে ফেলা ঘটনার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা প্রমানিত না হলেও কার্পাস কৃষক আর তাঁতীদের উপর কোম্পানী, ব্যবসায়ী, গোমস্তা আর পাইকাররা যে অমানুষিক অত্যাচার চালাত সেটি জাজ্বল্যমান সত্যি। আমাদের গর্বের এই মসলিনের সঙ্গে কালিমার মত লেপ্টে আছে এই রূঢ় সত্যটাও।
চার-পাঁচশো বছর আগে যে মসলিন হয়ে উঠেছিল পৃথিবী বিখ্যাত, মাত্র দেড়শো বছরের মধ্যেই তা হারিয়ে গেল কেন?
--
১৮৪৪ সালে ঢাকার কমিশনার আই. ডানবার কোম্পানীর সদর দপ্তরে মসলিন শিল্প বন্ধ হবার কারণ উল্লেখ করে একটি রিপোর্ট পাঠান। ডানবার
সাহেবের মতে মূল কারণগুলো ছিলঃ
১) ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সস্তায় সুতা আর কাপড় উৎপন্ন হতে থাকে। ফলে দামি মসলিনের চাহিদা কমে যায়।
২) বিলেতের সস্তা সুতা ঢাকায়, ভারতে আসতে থাকে, সে থেকে তৈরি হতে থাকে কাপড়, হারিয়ে যেতে থাকে মসলিন।
৩) বিলাতে ঢাকাই মসলিনের ওপরে উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়, ফলে মসলিনের দাম ওখানে বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। স্বভাবতাই বিক্রি কমে যায় মসলিনের।
--
মসলিনের পড়তির সময়টায় পতন ঘটতে থাকে আমাদের নবাব-সম্রাটদেরও। তাঁরা আর বেশি টাকা দিয়ে মসলিন কিনছেন না- চাহিদা কম ছিল অভ্যন্তরীন বাজারেও। তাছাড়া মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী-কেউই এ শিল্প রক্ষা কিংবা প্রসারে কোন সময়ই তেমন কোন উদ্যোগ নেননি, সব সময় চেষ্টা করেছেন কিভাবে কৃষক-তাঁতীদের যতটা সম্ভব শোষণ করে নিজেরা লাভবান হওয়া যায়- এই সব মিলিয়ে এভাবেই ধিরে ধিরে আমাদের আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মত হারিয়ে যায় মসলিনের স্বর্ণযুগও।
-- শেষ --
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১:০৫